দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত বর্ণবাদ বিরোধী নেতা প্রয়াত নেলসন ম্যান্ডেলার একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। শিক্ষা সম্পর্কে তিনি বলেন 'শিক্ষা এমন এক হাতিয়ার যা পৃথিবীকে মুহুর্তে বদলে দিতে পারে।' তার উক্তিটি নিঃসন্দেহে বাণী চিরন্তনী হয়ে যুগে যুগে মানুষের মুখে উচ্চারিত হবে। এতে কোনো আধিখ্যেতা নেই। শিক্ষার জন্য এটি এক অসাধারণ উক্তি। আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে যতো ইতিবাচক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, সে কেবল শিক্ষার কারণে।
বিপ্লবের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার এই শিক্ষা। এর দ্বারা মানব সভ্যতা এ পর্যন্ত বিকশিত ও প্রস্ফুটিত হয়েছে। এ কারণে মানুষ স্রষ্টার সৃষ্টির মধ্যে সেরা জীবের মর্যাদায় আসীন হতে পেরেছে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষা এক সুদুর প্রসারী চিন্তাধারার সমষ্টি। এ চিন্তাধারার পেছনে পৃথিবী সৃষ্টির গুঢ় রহস্য নিহিত। স্বয়ং সৃষ্টিকর্তা ইসলামের পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআন শুরু করেন এই বলে-'পড়ো, তোমার প্রভুর নামে। যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন।' স্রষ্টাকে জানা সৃষ্টির এক অপরিহার্য কাজ। স্রষ্টাকে না জানলে নিজেকে জানা সম্ভব হয়ে উঠেনা। বিশ্ববিখ্যাত গ্রীক মনীষি সক্রেটিস তাই নিজেকে চেনার তাগিদ দিতে গিয়ে বলেন-'know thyself'. তার এ অমর কথায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই ফুটে উঠে।
আমাদের জাতির জনক হাজার কোটি বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি উক্তি দিয়ে আজকের মূল বিষয়ে যেতে চাই। তিনি বলেছেন,'শিক্ষিত জনশক্তি দেশের সম্পদ।আমি বাংলাদেশে এমন ব্যবহারিক শিক্ষার প্রসার চাই যা দ্বারা প্রতিটি নাগরিক দেশের প্রয়োজন ও চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে পারে।' শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির স্থপতি যে সুদুরপ্রসারী ও দুরদর্শী চিন্তা পোষণ করে গেছেন তা মাথায় রেখে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অগ্রসর হতে হবে। আমাদের শিক্ষায় জাতির জনকের ধ্যান-ধারণার উন্মেষ ও প্রতিফলন ঘটাতে হবে। দেশ ও জাতির চরম দুর্ভাগ্য যে, আমরা স্বাধীন দেশে আমাদের জনককে খুব বেশি দিন ধরে রাখতে পারিনি। হাতে পর্যাপ্ত সময় পেলে তিনি আমাদের শিক্ষায় যে বিপ্লবটি ঘটিয়ে যেতেন সেটি কল্পনা করাও আজ হয়তো সম্ভব নয়। কেবল বঙবন্ধুর ন্যায় তীক্ষ্ম মেধা ও দুরদর্শি সম্পন্ন চিন্তাধারার রাষ্ট্রনায়কের পক্ষে এরকম চিন্তা-চেতনা লালন করা যেমন সম্ভব ছিলো তেমন এর বাস্তবায়ন ও সফল প্রয়োগ কোনো কঠিন কাজ ছিলো না।
আমাদের সৌভাগ্য এই যে, শ্বাপদসংকুল দুর্গম মরুপথ পেরিয়ে হলেও জাতির জনকের তনয়া শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।যোগ্য পিতার সুযোগ্য উত্তরসুরী। সেপাইকা ঘোড়া আর বাপকা বেটির মতন। জাতির জনকের চিন্তা চেতনার কার্বন কপি। অমিত সাহসী জনক তনয়া শেখ হাসিনা। তার হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আরো এগিয়ে যাবে। জাতির আস্থা ও বিশ্বাসের অনন্য এক বাতিঘর তিনি। তার মাধ্যমেই দেশের শিক্ষায় এক সুদিনের আশায় পুরো বাংলাদেশ। 'শিক্ষা নিয়ে গড়বো দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'-স্লোগানটি আমাদের বড় বেশি আশান্বিত করে। অচিরেই আমাদের শিক্ষার সকল দুর্নাম ঘুচিয়ে বঙবন্ধু বাংলাদেশের জন্য যে শিক্ষাটি চেয়েছিলেন সেটিই বাস্তবে রুপায়িত হবে।
বঙবন্ধু বিশ্বমানের শিক্ষা চেয়েছিলেন। বাঙালিকে বিশ্বমানের নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। দেশ ও জাতির যে কোন প্রয়োজনে সাহস নিয়ে দাঁড়াবার মতো নাগরিক গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। একটি ব্যবহারিক শিক্ষার প্রসার চেয়েছিলেন। তাইতো যুদ্ধ বিধ্বস্ত বিরান ভুমিতে দাঁড়িয়ে শিক্ষার শক্ত ভিত তৈরির জন্য প্রাথমিক শিক্ষাস্তর জাতীয়করণ করেছিলেন। সার্বজনীন ও অবৈতনিক শিক্ষা চালু করেছিলেন বলে আজ আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাস্তর উঁচু ও মজবুত একটা ভিতের উপর দাঁড়াতে পেরেছে। এখন প্রতিটি প্রাইমারি স্কুলে চার পাঁচজনের অধিক শিক্ষক। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষক মহিলা। মায়ের আদর স্নেহে তারা আমাদের আগামী প্রজন্মকে গড়ে তুলছেন। এখন হাই স্কুল ও কলেজ ছেড়ে অনেক অনার্স মাস্টার্স পাস করা শিক্ষকও প্রাইমারিতে চলে আসতে দ্বিধাবোধ করেন না।
আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরকেও এমন একটি ভিতের উপর দাঁড় করানোর সময় অনেক আগেই গত হয়েছে। এতদিনে আমাদের অর্ধেক পথ পেরিয়ে যাবার কথা। কিন্তু আমরা আজ পর্যন্ত শুরুই করতে পারিনি। আমাদের মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরকে এমন একটি পর্যায়ে দাঁড় করাতে হবে যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও এখানে এসে শিক্ষকতা করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন। মাধ্যমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন ও অবৈতনিক ঘোষণা করে সে কাজটি করা যেতে পারে। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে ব্যবহারিক শিক্ষা উন্মুক্ত ও প্রসারিত করা চাই। মুখস্ত বিদ্যার এখন আর কোন মুল্য নেই। সময়ও নেই। এখন সময় আইসিটি ও কারিগরি শিক্ষার। সেটি মাথায় রেখে মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর ঢেলে সাজালে অতি অল্প সময়ে সুফল পাওয়া যাবে। এমন একটা সুদিন আশা করা অন্যায় কিংবা অযৌক্তিক হবে না। আমরা সেই সুদিনের আশায় উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।