আজ ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন তথা শিশু-নারী-পুরুষ হত্যা, মানবতার চরম অবমাননার প্রেক্ষাপটে আজ বিশ্বব্যাপী দিনটি পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব এন্টোনিও গুটারেস এ উপলক্ষে তার বাণীতে বলেছেন : ‘বিশ্ব এখন অনেক গুরুতর সমস্যায় নিপতিত। সংঘাত ও বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। পরিবেশের অবস্থা চরম। অসহিষ্ণুতা মারাত্মক। আণবিক মারণাস্ত্রসহ নিরাপত্তার জন্য নানা হুমকি বিদ্যমান। কিন্তু এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমাদের উপকরণ ও সম্পদ দুটোই আছে। যা দরকার তা হল প্রবল ইচ্ছার। বিশ্বে সমস্যার কোনো সীমা নেই। মতবিরোধের ঊর্ধ্বে উঠে আমাদের ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে পারলে তারাই একটি শান্তিপূর্ণ, টেকসই ও ন্যায়ভিত্তিক বিশ্ব গড়ে তুলতে পারবে।’ বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গে গুটারেস বলেছেন, এটি বিশ্বের দ্রুততম জরুরি সমস্যা, মানবাধিকার যেখানে দুঃস্বপ্ন। অগ্নিসংযোগ, নারী ও শিশুহত্যা, নিষ্ঠুর জাতিগত ধ্বংসলীলা যেখানে প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। খোলা চোখে সবটাই দৃশ্যমান।
এদিকে আগামী বছর (২০১৮) সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ৭০ বছর পূর্তি হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার জায়েদ রা’দ আল হোসেন ১০ ডিসেম্বর প্যারিসের মেয়র অ্যান হিদালগোকে সঙ্গে নিয়ে ১৯৪৮ সালের এই দিনে সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণা অনুমোদনের স্থানটিতে বিশেষ কর্মসূচি পালন করবেন। এ পূর্তি উপলক্ষে বিশ্বব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হবে।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্য
বাংলাদেশের ১২টি প্রধান দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত মানবাধিকার লঙ্ঘন সংক্রান্ত প্রতিবেদনের আলোকে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তথ্যমতে, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ৬ মাসে চার সহস্রাধিক মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮৫৫টি হত্যাকাণ্ড, ৫২ জন গুম বা নিখোঁজের শিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার ৮৩ জন, ১২৯টি শিশুহত্যা আর ১২৩টি শিশু নির্যাতনের শিকার। এর বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অমানবিক শাস্তির শিকার ১২৭ জন শিশু শিক্ষার্থী। নারীর ওপর সহিংসতাও বেড়েছে। বছরের প্রথম ৬ মাসে ৩০৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। যৌন নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা, এসিড নিক্ষেপসহ আরও বিভিন্নভাবে সহিংসতার শিকার হয়েছেন ২৯৯ জন নারী। অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৯৩ জন। অমানবিক নানা ঘটনা-দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ৯৩ জন শ্রমিক। ৬ মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ১ হাজার ৮৫৩ জন যাত্রী ও পথচারী। মাসভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এপ্রিলে সবচেয়ে বেশি ৮৫৭টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আর সবচেয়ে কম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে জানুয়ারিতে।
মানবাধিকার ঘোষণা থেকে এসডিজি
১৯৪৮ সালের সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণার ২৬ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে : প্রত্যেকের শিক্ষার অধিকার আছে। শিক্ষা হবে নিখরচায়, অন্তত প্রাথমিক ও মৌলিক পর্যায়গুলোতে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে বাধ্যতামূলক। কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষা সাধারণভাবে সহজলভ্য হবে এবং উচ্চশিক্ষায় সবার অভিগম্যতা থাকবে, যা হবে মেধার ভিত্তিতে। দীর্ঘ ৬৭ বছর পর ২০১৫ সালে প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘে আনুষ্ঠানিক সভায় মিলিত হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বকে বদলে দিতে ১৭টি লক্ষ্য অনুমোদন করেছেন, যেখানে কারিগরি, বৃত্তিমূলক ও উচ্চশিক্ষাকে যুক্ত করা হয়েছে।
মানবাধিকার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ
২০০৯ সালে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক কাইচিরো মাতসুরা, ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউশন্স অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস অব দি অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো-অপারেশন ইন ইউরোপের পরিচালক জেনেস লেনারকিক, কাউন্সিল অব ইউরোপের সেক্রেটারি জেনারেল টেরি ডেভিস, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের কমিশনার নাভানিথেম পিল্লে ‘হিউম্যান রাইটস এডুকেশন ইন দ্য স্কুল সিস্টেম অব ইউরোপ, সেন্ট্রাল এশিয়া অ্যান্ড নর্থ অ্যামেরিকা : এ কম্পেনডিয়াম অব গুড প্র্যাকটিস’ নামের একটি বইয়ের ভূমিকা লিখে দেন। ওই বইতে প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শিক্ষক, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোয় মানবাধিকার চর্চা বা অনুশীলনের ১০১টি ভালো দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হয়। মানবাধিকার শিক্ষার সংজ্ঞা প্রসঙ্গে ওই বইতে বলা হয় : ‘সার্বজনীন মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে প্রয়োজন শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও তথ্যের। সমন্বিত মানবাধিকার শিক্ষা শুধু মানবাধিকার সম্পর্কে জ্ঞান সরবরাহ ও তা রক্ষার প্রক্রিয়া সম্পর্কে আলোকপাত করে না, দৈনন্দিন জীবনে তা কীভাবে দক্ষতার সঙ্গে প্রয়োগ, সুরক্ষা ও উন্নয়ন করতে হয় তারও শিক্ষা দেয়।’ মানবাধিকার শিক্ষা সম্পর্কিত বইটিতে শতাধিক ভালো দৃষ্টান্তের উল্লেখ অত্যন্ত গুরুত্ববহ এ কারণে যে, শিশু, যুবা, বৃদ্ধ সবাইকে তত্ত্বের চেয়ে বাস্তব দৃষ্টান্ত অনেক বেশি আকৃষ্ট করে। অন্যদিকে প্রাথমিক অবস্থায় মানবাধিকার শিক্ষা একবার মনে দাগ কেটে গেলে তা সারা জীবনের জন্য স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে।
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিত
আমাদের দেশে মানবাধিকার শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। ২০১৩ সালে ও এর পরে প্রকাশিত প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে মানবাধিকার বিষয়টি আগের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। শিশু, নারী ও প্রবীণের অধিকার সেখানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ষষ্ঠ শ্রেণীর বইতে বলা হয়েছে: ‘প্রতিটি নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে পাঁচটি অধিকার দাবি করতে পারে : খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা। এগুলো একজন মানুষের মৌলিক চাহিদা। আবার এগুলো তার মৌলিক অধিকারও। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল নাগরিকদের জন্য এ অধিকারগুলো পাওয়া নিশ্চিত করা। সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতির শিশুদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ধর্ম, ভাষাচর্চার অধিকার রক্ষা করতে হবে। প্রতিটি শিশুর অবকাশ যাপন, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের অধিকার রয়েছে। অর্থনৈতিক শোষণ এবং যে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে শিশুর বিরত থাকার অধিকার রক্ষা করতে হবে। শিশুকে কেউ যেন অন্যায় কাজে ব্যবহার করতে না পারে। শিশুর শারীরিক-মানসিক-নৈতিক ক্ষতি যাতে না হয় রাষ্ট্রকে তার ব্যবস্থা নিতে হবে। কোনো শিশুকে যুদ্ধে বা সরাসরি সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে দেয়া যাবে না।
শিক্ষার্থীদের শাস্তি : দায় কার
২০১০ সালের ৯ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করার বিষয়ে জারিকৃত পরিপত্র এবং ২০১১ সালের ২১ এপ্রিল সরকার কর্তৃক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি রহিত করার বিষয়ে জারিকৃত নীতিমালা ২০১১ অনুযায়ী, শিশুদের প্রতি যে কোনো ধরনের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রদান বেআইনি। শিশু আইন ২০১৩-এর ধারা ৭০ অনুসারে কোনো শিশুকে আঘাত, উৎপীড়ন, অবহেলাসহ এ ধরনের ব্যবহারের মাধ্যমে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যৌক্তিক আহ্বান ও আবেদনে সাড়া দিয়ে সরকারের নেয়া এসব সিদ্ধান্ত প্রশংসার দাবি রাখে। তবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে এ ধরনের বিধিনিষেধ সত্ত্বেও দেখা যায়, শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেত, ডাস্টার, স্কেল দ্বারা শারীরিক নির্যাতন, মৌখিকভাবে শাস্তির হুমকি ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গবেষণায় দেখা যায়, ৬৯ শতাংশ পিতা-মাতা বা অভিভাবক মনে করেন, নিয়মানুবর্তিতার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তি প্রয়োজন, ৫৫ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি শিশুকে ভালো পথে নিয়ে যায়, ২৭ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি ছাড়া শিশুরা বখে যায়, ২৫ শতাংশ মনে করেন, শাস্তি দেয়ার ফলে শিশুরা শিক্ষকদের কথা শোনে (সূত্র : ব্লাস্ট)।
মানবাধিকারের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক শুধু অবিচ্ছেদ্য নয়, প্রকৃত শিক্ষাই মানবাধিকার প্রশ্নে শিশু, যুবা, বৃদ্ধ সবার চোখ খুলে দেয়। শিক্ষার এ বিশ্বজনীনতাই মানবাধিকার ঘোষণার মূল কথা। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিটি মুহূর্তে তা অপরিহার্য। শিক্ষার সঙ্গে সৃজনশীলতা, দক্ষতা, মানবিক মূল্যবোধ ও আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি যুক্ত না হলে তা হয়ে যায় লক্ষ্যহীন। সব সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানায় এবারের মানবাধিকার দিবস। যার মূল বাণী : সবার উপরে মানুষ সত্য।
কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষাবিদ; চেয়ারম্যান, ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি)
সৌজন্যে: যুগান্তর