শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে

আবদুল বায়েস |

ধারা মানে পথ। একজন মানুষ বা একটা জাতি যেই ধারায়ই অগ্রসর হয় না কেন, কিছু না কিছু উন্নতি তো আশা করতেই পারে।

তবে নিশ্চিত যে সনাতন ধারার চেয়ে নবধারা অনেক গুণ বেশি কার্যকর এবং ফলদায়ক। নবধারা মানেই খোলনলচে বদলে ফেলে ধ্বংসের ওপর নতুন নির্মাণ নয়; এমনকি পুরনো জিনিসের নতুন আঙ্গিকে ব্যবহারও একধরনের নবধারা। আমরা যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শম্বুকগতিতে চলছি তার প্রধান কারণ আমাদের চিন্তাচেতনা কিংবা কর্মকাণ্ড বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেকেলে; যৎসামান্য যা এগিয়েছি তা হয়তো ক্ষেত্র বিশেষে নবধারাকে আলিঙ্গন করেছি বলেই।
দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে মিতব্যয়ী নবধারা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নিবেদিত একটা প্ল্যাটফর্ম বা মঞ্চের নাম ‘ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম’। প্রায় প্রতিবছর এই মঞ্চ থেকে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর নতুন নতুন চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটানো হয়। কম খরচে বেশি উৎপাদন নিমিত্তে বয়স, শিক্ষা অথবা লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার সৃজনশীল চিন্তাভাবনাকে যথাযথ গুরুত্ব দেয় এই মঞ্চ; বিভিন্ন দেশ এতে অংশ নেয়। এই মঞ্চের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ উৎসাহদাতাদের মধ্যে আছে ইউকে এইড, অস্ট্রেলিয়ান এইড, গ্লোবাল স্কুলস ফোরাম ও ব্র্যাক। এই বছর তিন দিনব্যাপী কর্মসূচিতে তিনটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজা হয়েছে—গুণগত শিক্ষণ নিশ্চিত করে এমন অনুকরণীয় নবধারামূলক পদ্ধতি শনাক্ত করা; পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে কোন ধরনের ব্যয়-সাশ্রয়ী মডেল বিস্তার করা যাবে তা পরখ করা এবং একবিংশ শতকের দক্ষতা অর্জনে পাঠ্যসূচি পরিবর্তন ও সবচেয়ে ভালো পদ্ধতি গ্রহণ। যা হোক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মুস্তাফিজুর রহমান গুরুত্বপূর্ণ সম্মেলনটির উদ্বোধন করেন আর ব্র্যাকের সিনিয়র ডিরেক্টর আসিফ সালেহ স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন।

এবারের বিষয় ছিল একটু নির্দিষ্ট ধরনের—গুণগত শিক্ষার প্রসার। নবধারামূলক ব্যবস্থাপনায় গুণগত শিক্ষা বিস্তারে কী কী পদক্ষেপ বা কৌশল নিলে কম খরচে কাঙ্ক্ষিত ফসল ঘরে তোলা যাবে। অবশ্য নোবেল বিজয়ী কৈলাস সত্যার্থী মনে করেন না যে সম্পদের কোনো ঘাটতি আছে। এক সপ্তাহের প্রতিরক্ষা খরচ বাঁচাতে পারলে যেখানে বিশ্বের সব শিশুকে স্কুলে পাঠান যায় সেখানে সম্পদের অভাব হয় কী করে? যা হোক, মনে রাখতে হবে শিক্ষার পরিমাণগত পরিব্যাপ্তি নয়, বরং গুণগত শিক্ষার বিস্তৃতি এখন বড় কথা।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে পরিমাণগত পরিমাপে কোনো দেশই পিছিয়ে নেই, বাংলাদেশ তো আরো নয়। আমাদের দেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে অন্তর্ভুক্তির হার ঈর্ষণীয়, ৯৫ শতাংশ! অবশ্য অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানেই টিকে যাওয়া নয়। অনেক কারণে অনেকে ঝরে পড়ে। দারিদ্র্য তো একটি শক্তিশালী উপাদান, তার মধ্যে শিক্ষার নিচু মান ও শিক্ষকের অবহেলা কম দায়ী নয়। শিক্ষার পরিমাণগত উন্নতির বাইরেও অন্তর্ভুক্তিবিষয়ক বেশ কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন—জিএনপির গড়পড়তা ১-২ শতাংশ শিক্ষায় খরচ হয়; অথচ ১০-১২ শতাংশ ব্যয় করা হয় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর প্রতিরক্ষা খাতে। দক্ষিণ এশিয়ায় আট থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় দেড় কোটি শিশু এখনো স্কুলের বাইরে। ২০১৬ সালে ইউনেসকোর এক সমীক্ষা অনুযায়ী সারা বিশ্বে ২৬ কোটির ওপর শিশু ও যুবক তাদের জন্মাধিকার শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষেত্রে এ সংখ্যাটা প্রায় সাড়ে তিন কোটি।

হ্যাঁ, এটি সত্যি কথা যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে। কিন্তু গুণগত শিক্ষা যে বাড়েনি, তা নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ আছে বলে মনে হয় না। খাবার মানেই যেমন স্বাস্থ্য না, তেমনি শিক্ষা মানেই আলো নয়। ২০১২ সালের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামীণ ভারতের পঞ্চম গ্রেডের প্রায় অর্ধেক শিশু দ্বিতীয় গ্রেডের পাঠ্য বই পড়তে পারে না। ২০১৫ সালে বাংলাদেশে পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির দুই-তৃতীয়াংশ বাংলায় ও অঙ্কে তাদের যথাযোগ্য দক্ষতা প্রদর্শন করতে পেরেছে। আর যত ওপরের ক্লাসে উঠছে ততই দক্ষতা কমছে।

মিতব্যয়ী নবধারা মঞ্চের একটা আকর্ষণীয় বিতর্কের বিষয় ছিল এমন—সরকারের উচিত হবে উচ্চশিক্ষার চেয়ে দক্ষতা প্রশিক্ষণে গুরুত্ব বেশি দেওয়া। মূলত যাঁরা শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেন কিংবা এজাতীয় প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত, শুধু তাঁরাই ছিলেন তার্কিক। স্বভাবতই প্রস্তাবের বিপক্ষে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তাঁদের যুক্তি সেই সনাতনি, লোকরঞ্জন ও আবেগী যুক্তি—যেমন বিশ্ববিদ্যালয় সভ্যতার প্রতীক, সুতরাং বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এর বিপরীতে অর্থাৎ কারিগরি শিক্ষা বা দক্ষতা উন্নয়নে জোর দেন দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে থাকা কয়েকজন। ব্র্যাকের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পের ফারজানা কাশফি তথ্যবহুল উপস্থাপনার মাধ্যমে জানালেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা ও কর্মসংস্থানের মধ্যকার দূরত্ব কী করে বেকারত্ব বাড়ায়; জানালেন, আরো এ দেশের উদ্যোক্তাদের তিন-চতুর্থাংশ মনে করে নিয়োগ দেওয়ার মতো মানসম্পন্ন ছাত্র-ছাত্রী তারা পায় না। এই নিবন্ধের লেখক মনে-প্রাণে বিশ্বাস করেন, আগামী দিনগুলোতে দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে দক্ষতা প্রশিক্ষণের বিকল্প আপাতত নেই। দেশের প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় স্তরেও শিক্ষক তথা প্রশাসকদের জন্য দক্ষতা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকা উচিত, যাতে জানতে পারেন কী করে ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ বাড়ানো যায়।

শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা প্যানেল আলোচনার বিষয়বস্তু খুবই প্রাসঙ্গিক ও উপভোগ্য হয়েছে বলে মনে করি। আলোচনায় অংশ নেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক মুহাম্মাদ মুসা, নিউ ক্যাসল ইউনিভার্সিটির জেমস টুলি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আনির চৌধুরী। মুহাম্মাদ মুসার মতে, আগামী দিনগুলোতে শিক্ষাব্যবস্থা তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা অনেক : গুণগত শিক্ষা প্রদানে একটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার; প্রযুক্তিতাড়িত শিক্ষাব্যবস্থা ও মানুষের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সংগতি রেখে পাঠদান ও শিক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজানো। গুণগত শিক্ষার জন্য মানুষ পয়সা খরচ করতে রাজি। মানসম্পন্ন পণ্য ও সেবার চাহিদা এতটাই বিস্তৃত যে একজন রিকশাচালকও চান তাঁর সন্তান ভালো কিছু শিখুক, ভালো একটা বিদ্যালয়ে যাক। জেমস টুলি শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে; বাজারভিত্তিক শিক্ষা সবচেয়ে বেশি কল্যাণ আনে। আনির চৌধুরী পরিসংখ্যান দিয়ে দেখালেন, কী করে এবং কতটুকু শিক্ষা এখন প্রযুক্তির পাদদেশে। বস্তুত সব কিছুই প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে উঠছে। কারখানাগুলোতে মানুষের বিপরীতে রোবটের কর্মসংস্থান চিন্তার ব্যাপার।

অনুজপ্রতিম আসিফ সালেহর নেতৃত্বে একঝাঁক তরুণ-তরুণী ৯ থেকে ১১ নভেম্বর যা দেখাল, তা সত্যি অবাক করার মতো। এক মুহূর্তের জন্যও মনে হলো না যে হলঘরটিতে কেউ উসখুস করছে বা দুপুরে ভরাপেট ভোজনের পর হাই তুলছে। সনাতনি ধ্যানধারণা যে নবধারায় ফেলে উৎপাদনশীলতা বহুগুণ বৃদ্ধি করা যায় মঞ্চ তা-ও প্রমাণ করল। ঘরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কাগজের টুকরা, সুতা কিংবা প্লাস্টিকের চিকন পাইপ দিয়ে কী করে ‘পাইড পাইপার অব হ্যামিলন’ সেজে বাচ্চাদের দলে ভেড়ানো যায়, সেই নবধারামূলক শিক্ষার উপকরণ তৈরি প্রদর্শন করে দেখালেন ভারত থেকে আগত অরভিন্দ গুপ্ত। মনে হচ্ছিল, কোনো এক জাদুকরের জাদু দেখছিলাম। তিনি মূলত গ্রামের স্কুলে কম খরচে বিজ্ঞান শিক্ষার নিমিত্তে নবধারামূলক চিন্তাভাবনা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।

গাড়িতে বসে ভাবছি, এককালে বিতর্কের বিষয় ছিল অসি বড়, না মসি বড়। এখন বিতর্কের বিষয় হওয়া উচিত, অর্থ বড়, না চিন্তা বড়। চিন্তা থাকলে অর্থ আপনাআপনি আসে, অথচ অর্থ থাকলে চিন্তা না-ও আসতে পারে। সৃজনশীল চিন্তাভাবনার মাধ্যমে শিশুদের মধ্যে কম ব্যয়ে বেশি শিক্ষা দেওয়া যায়। বাংলাদেশে অর্থ বরাদ্দ নিয়ে যত অনর্থক হৈচৈ করা হয়ে থাকে তার সিকি ভাগও যদি নবধারামূলক ভাবনা নিয়ে হতো, তা হলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক এমনকি উচ্চতর শিক্ষার গুণগত মান বহুগুণ বৃদ্ধি করা যেত বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

লেখক : সাবেক উপাচার্য

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030801296234131