শিক্ষা নিয়ে মতবিনিময় কেন কার সঙ্গে? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা নিয়ে মতবিনিময় কেন কার সঙ্গে?

গোলাম কবির |

সামাজিক বা রাজনৈতিক, স্থানীয়, জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক যে পর্যায়েই হোক না কেন, মানববিদ্বেষী স্বার্থপরতার ভিন্ন মতের কারণে সংসারে স্থিতিশীলতা ও শান্তি বিঘ্নিত হয়। তাই স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক পর্যায় পর্যন্ত মতবিনিময় ফলপ্রসূ হতে দেখা যায়।

তবে একগুঁয়েমির কারণে কিছু শুভ চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেছে। তার নজির মানবসভ্যতার ইতিহাসে কম নেই। এতদসত্ত্বেও মতবিনিময় বা সমঝোতার শান্তিপূর্ণ বিকল্প পন্থা আজও উদ্ভাবিত হয়নি। পরিণতিতে মতান্তর বা ঐকমত্য যাই হোক এখন পর্যন্ত এটাই স্বীকৃত ও সুশীল পন্থা।
আমরা শিক্ষার মান উন্নয়ন বা পুনরুদ্ধারের জন্য মতবিনিময় সভার আয়োজন করছি। প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়েও মেধাবী এবং শিক্ষাব্রতী শিক্ষকের ভয়াবহ সংকটের দিনে এসব আলোচনা কতটুকু ফলপ্রসূ তা আগেই ভেবে দেখা দরকার। শিক্ষা দান করবেন শিক্ষক। তাঁর মান ও মানসিকতা যাচাইয়ের আগে কিছু শিক্ষক নামের পেশাজীবীর সঙ্গে মতবিনিময়ে বসা উলুবনে মুক্তো ছড়ানোর মতো। কেননা এ কথা বিশ্বাস্য সত্য যে শিক্ষকতা পেশা নয়।

মহান ব্রত। এই ব্রতধারী শিক্ষকরা একদা সমাজে সবার কাছে অবিমিশ্র সমীহের পাত্র ছিলেন। আর এখন?
শিক্ষাব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম নিয়ে মতবিনিময় শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে। ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে মাত্র ৩১ বছর বয়সে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োজিত হওয়ার পর তিনি শিক্ষাকে সর্বজনীন ও সহজবোধ্য করার জন্য শিক্ষাব্রতী সহকর্মী ও বিদ্বজ্জনের সমন্বয়ে মতবিনিময় করতেন অনাড়ম্বরভাবে। তিনি স্বয়ং সে কাজে হাত দিয়ে সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা সহজভাবে বাংলা ভাষায় রচনা করেন। এ জন্য তাঁর শিক্ষক প্রেমচন্দ্র তর্কবাগীশ তাঁকে ভর্ত্সনা করেন। তিনি দমেননি। কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতান্তরের জন্য বিদ্যাসাগর মাত্র ৩৮ বছর বয়সে চাকরি ছেড়ে দেন।

দরিদ্র ব্রাহ্মণের ছেলে তেজস্বী পুরুষ রামজয় তর্কভূষণের পৌত্র বিদ্যাসাগর আর চাকরির উমেদারি করেননি। এ সময় তাঁর সঙ্গে অক্ষয় কুমার দত্ত, রাজনারায়ণ বসু প্রমুখ শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি দেশীয় শিক্ষা বিস্তারের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। তাঁদের সঙ্গে ছিল নিবেদিতপ্রাণ বিজ্ঞ শিক্ষকসমাজ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৮৯২ সালের ২৬ নভেম্বর রবীন্দ্রনাথ রাজশাহী কলেজে শিক্ষার কঠিন আবরণ সহজ করার জন্য মতবিনিময় সভায় শিক্ষার হেরফের নামের একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সভায় গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষানুরাগীদের মধ্যে প্রমথ চৌধুরী, জগদিন্দ্রনাথ রায়, অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়সহ সমকালীন রাজশাহী কলেজের স্মরণীয় শিক্ষকরা উপস্থিত ছিলেন। লেখা বাহুল্য, তাঁরা সবাই শিক্ষার মান সম্পর্কে অবহিত। এখন আমরা শিক্ষক হওয়ার মতো যথার্থ শিক্ষিত কি না তা প্রশ্নসাপেক্ষ। সুতরাং শিক্ষার মান বিচার করব কী দিয়ে? স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধু গঠিত শিক্ষা কমিশনের প্রধান প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও যশস্বী শিক্ষক ড. কুদরাত-এ-খুদা এবং শিক্ষাবিদ ফেরদাউস খান এসেছিলেন রাজশাহী কলেজে শিক্ষা নিয়ে মতবিনিময়ের জন্য। সে মতবিনিময়ের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে কোন ধরনের শিক্ষা প্রবর্তন করলে মানুষ তার মানবমহিমা ফিরে পাবে। তখনো শিক্ষা কিংবা শিক্ষকের মান নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। ওই সময় রাজশাহী কলেজে শিক্ষক থাকার সুবাদে অনুষ্ঠানে সক্রিয় অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়েছিল এই নিবন্ধ লেখকের। রবীন্দ্রনাথের আগমনের ১৩৮ বছর পর ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসের ৩ তারিখে রাজশাহী কলেজে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হলো। এর ফলে বিচার করবে গোপনে গোপনে কাজ করে যাওয়া ইতিহাস।

রাজশাহী কলেজে অনুষ্ঠানটি ছিল শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য মতবিনিময়ের। সবার জানা, কোনো বিষয়ের মান থাকলে তার উন্নয়নের প্রশ্ন ওঠে। এখনো শিক্ষা নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁদের মতে বর্তমানে শিক্ষার মান তলানিতে। সুতরাং তলানির মান উন্নয়নের কথা না ভেবে, শিক্ষার মান পুনরুদ্ধারের চিন্তা মাথায় রাখা উচিত। আর শিক্ষার মান পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন নিবেদিতপ্রাণ মেধাবী শিক্ষাব্রতী শিক্ষকসমাজ। দুঃখের বিষয় তাঁরা এখন শিক্ষকতা পেশায় আসতে আগ্রহী নন। যে কজন এখনো অবশিষ্ট আছেন, তাঁরা অবহেলিত, উপেক্ষিত।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, দেশভাগের পর অনেক কৃতবিদ্য শিক্ষক দেশান্তরি হন। তখনকার বাস্তবতার প্রয়োজনে যাঁরা শিক্ষক নিয়োজিত হয়েছিলেন, তাঁদের যোগ্যতা নিয়ে তেমন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়নি। স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় ট্র্যাজেডির পর রাজনীতিকে কঠিন করার যাঁরা কারিগর এবং রাজনীতিকে সোপান হিসেবে ব্যবহার করে ওপরে ওঠার সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী কিছু ব্যক্তির পরামর্শে স্কুল-কলেজ বাছবিচার না করে সরকারীকরণের জন্য অনেক শিক্ষাহীন ব্যক্তি শিক্ষকতায় আসায় শিক্ষার অধোগতির দশা শুরু হয়। আজও সে ধারা চলছে।

মনে রাখা দরকার, শিক্ষা ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন’ নয়। নিরবধি সাধনার ফল। দেশ স্বাধীন হলে স্বাধীনভাবে নকল করে পরীক্ষা দেওয়ার মহোৎসব শুরু হয়। কিছু শিক্ষকও তাতে যুক্ত হন। পঁচাত্তরের জাতীয় ট্র্যাজেডির পর শ্রেষ্ঠ শিক্ষক বিবেচিত হন তাঁদের অনেকে। আর নকলবাজরা অন্য কোনো চাকরিতে সুবিধা করতে না পেরে গ্রামে-গঞ্জে স্কুল-কলেজ খুলতে শুরু করে। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসে, তাদের কৃত্রিম সমর্থক সেজে প্রথমে এমপিওভুক্ত তারপর পথে নেমে প্রতিষ্ঠানটি সরকারি করে নেয়। এরা লেজুড়বৃত্তি করে, কখনো নগদ নারায়ণের বিনিময়ে, দেশের সেরা কলেজ ও শিক্ষা প্রশাসনে জায়গা করে নিয়েছে। এই ধারা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত।

দেশ ও জাতির উন্নয়নের জন্য শিক্ষিত মানুষের প্রয়োজন। আর শিক্ষিত মানুষ তৈরি করবেন, সমাজের সবচেয়ে মেধাবী ব্যক্তিরা। তাঁরাই যেন শিক্ষার সর্বস্তরে প্রাধান্য পান। বয়স কিংবা অন্য কোনো প্রক্রিয়ায় নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে এ নিয়ম কঠিনভাবে অনুসরণ করা হলে আর শিক্ষার মান উন্নয়নের বা পুনরুদ্ধারের জন্য মতবিনিময়ের তেমন প্রয়োজন হবে না। প্রয়োজন হবে কোন পদ্ধতিতে শিক্ষার গতিবিধি নির্মাণ করলে শিক্ষার মাধ্যমে মানব মহিমা ফিরে আসবে। এসব নিয়ে মতবিনিময় হোক যথার্থ।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.008289098739624