শিক্ষা প্রশাসনের লোভনীয় পদে থাকা কর্মকর্তাদের সম্পর্কে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ভুল ও ইচ্ছেমাফিক তথ্য সরবরাহ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। আবার কোনও কোনও কর্মকর্তার তথ্য একেবারেই চেপে যাওয়া হয়েছে। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে চার পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের কলেজ শাখার একজন অতিরিক্ত সচিব এসব বিষয় বুঝেও না বোঝার ভান করছেন। শিক্ষা ক্যাডারের সচেতন ও প্রতিবাদীরা এই অতিরিক্ত সচিবকে ‘নাটের গুরু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। শিক্ষা প্রশাসনের লোভনীয় পদ হিসেবে বিবেচিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড, ঢাকা; জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর, কারিগরি শিক্ষা বোর্ড এবং জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি (নায়েম)। শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তথ্য ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব আর্কাইভে থাকা তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে লোভনীয় পদধারীদের কৌশল সম্পর্কে জানা গেছে।
দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা অধিদপ্তরে ১৯৬৫ জনবল নিয়োগ কমিটির সহায়ক হিসেবে উপ-পরিচালক (সাধারণ প্রশাসন) মো: শফিকুল ইসলাম সিদ্দিকিকে বাদ দিয়ে বেসরকারি কলেজ শাখার উপ-পরিচালক অধ্যাপক মো: মেজবাহ উদ্দিনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ২০১৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। নিয়োগ সংক্রান্ত অনিয়ম দুর্নীতিতে বশিরউল্লাহ, মাসুমে রাব্বানী, কামাল উদ্দিন হায়দারসহ বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার সমিতির কতিপয় নেতার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন ওই নিয়োগের যাবতীয় তথ্য চেয়েছে সম্প্রতি। অতি গোপনে আংশিক তথ্য দেয়া হয়েছে বলে জানা যায়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখায় গত ৩০ বছর যাবত সহকারি ও সহযোগী অধ্যাপকদের পদায়ন দেয়া হয়। কিন্তু অধ্যাপক মেজবাহ উদ্দিনই এই নিয়ম ভেঙ্গেছেন। মেজবাহকে সর্বাত্মক সহায়তা করছেন শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএসর ‘লোক’ হিসেবে শিক্ষা প্রশাসনে পরিচিত সেই ‘নাটের গুরু’। মেজবাহকে একই পদে রাখার পেছনে মন্ত্রণালয়ের ‘নাটের গুরুর’ হাত থাকার অভিযোগ রয়েছে। ২০১০ খ্রিস্টাব্দ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের বেসরকারি কলেজ শাখায় কর্মরত মেজবাহ। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো তথ্যে ২০১০ খ্রিস্টাব্দের আগে মেজবাহ উদ্দিনের পদায়ন কোথায় ছিলো তা লেখা হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, অধিদপ্তরের সাবেক সফল মহাপরিচালক অধ্যাপক মো: নোমান উর রশীদ মেজবাহর দুর্নীতি ও অনিয়ম চিহ্নিত করেন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে। শাস্তি না হলেও কলেজে বদলি করা হয় মেজবাহকে। কিন্তু নাটের গুরুর ‘জালালী’ হাতের স্পর্শে মেজবাহকে কলেজে যেতে হয়নি। ওই আদেশ বাতিল করা হয়। মেজবাহ এখনও টিকে আছেন শিক্ষা অধিদপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ উপ পরিচালক পদে।
‘নাটের গুরুর’ পছন্দে অধিদপ্তরের সরকারি কলেজ শাখার বিদায়ী উপ-পরিচালক ড. মোহাম্মদ মোস্তফা কামালকে দিয়ে জাতীয়করণ ও সরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির ননী-মাখন খাওয়ার পর ফের গুরুত্বপূর্ণ পদে দেয়া হয়েছে সম্প্রতি। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় অবস্থিত নায়েমের পরিচালক (অর্থ) পদে গতমাসে যোগদান করেছন মোস্তফা কামাল। ২০১৫ ও ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে কয়েকমাস কুমিল্লা বোর্ডের পরিদর্শক থাকাকালে বিস্তর অভিযোগ থাকা মোস্তফা কামাল মন্ত্রণালয়ের ‘নাটের গুরুর’ একই বিশ্ববিদ্যালয় (চট্টগ্রাম), মিরপুরের একই বাড়ি ও খুলনার একই কলেজে চাকরি করার অভিজ্ঞতা রয়েছে।
শতকোটি টাকার কেনাকাটার কাজে নিয়োজিত অর্থ ও ক্রয় শাখার মোহাম্মদ আনিছুর রহমান ও ড. ফারহানা বেগম। আনিছ বর্তমান পদে এসেছেন ২০১৬-তে। তার আগে কোথায় কতদিন ছিল তা উল্লেখ্ নেই। নিজ কক্ষের কম্পিউটার চুরির তদন্তে দোষী করা হয় অধিদপ্তরের তিনজন আনসারকে। কিন্তু ২০১৪ থেকে সহকারি পরিচালক ও জাতীয়কৃত শিক্ষক ফারহানা নির্দোষ!
কৃষিবিজ্ঞানের সহকারি অধ্যাপক মুহাম্মদ আবুল কাশেম। তাঁর মূল পরিচয় তিনি একজন বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত সরকারি কলেজ শিক্ষক। বিধান অনুযায়ী তিন বছরের বেশি এক কর্মস্থলে থাকতে পারেন না তিনি। তবে, ‘নাটের গুরুর’ জাদুতে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আইন কর্মকর্তা হিসেবে তবিয়তে বহাল আছেন এই কাশেম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষা অধিদপ্তরে জটবাধা মামলার সংখ্যা প্রায় আট হাজার। আইনের জটিল বিষয় ও ইংরেজিতে লেখা উচ্চ আদালতের রায় অথবা নোটিশ কিংবা রুল নিশির জবাব লিখতে ভালো লাগে না এখানে নিযুক্ত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের! তাই কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে ব্যারিস্টার হায়ার করতে হয়েছে অধিদপ্তরকে।
অধিদপ্তরের আইন শাখার এই যখন হাল, ঠিক তখন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়াধীন একটি বেসরকারি কলেজ থেকে আইনে তৃতীয় বিভাগের সনদধারী সহকারী অধ্যাপক আল আমিন সরকারও আইন কর্মকর্তা হিসেবে পদায়ন বাগান। পদায়নের ফাইলে আল আমিনকে ‘আইন বেত্তার’ তকমা দেয়া হয়। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাস থেকে অদ্যাবধি আইন শাখায় কর্মরত তিনি। এখানেও নাটের গুরুর জাদু! দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, আইন শাখা মতামত নির্ভর করে ঘুষের টাকার পরিমাণের ওপর। আল আমিন ও কাশেম দুজনই বি সি এস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সদস্য।
অভিযোগ রয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তরের শিক্ষা কর্মকর্তা [মাধ্যমিক-২] পদে রয়েছেন ইতিহাসের সহকারি অধ্যাপক আফসার উদ্দিন। পদটি প্রভাষকের। শিক্ষা ক্যাডারে হাজার হাজার প্রভাষক থাকলেও সহকারি অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার সাড়ে তিন বছর পরও একই পদে তবিয়তে বহাল রয়েছেন আফসার।
আগামীকাল পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব।