আমরা শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে অনেক বিতর্ক করেছি। এখনও করছি। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, কোনো জাতীয় ঐকমত্যে (ন্যাশনাল কনসেনসাস) পৌঁছতে পারছি না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো অগ্রগতি নেই। আলবৎ অগ্রগতি আছে। সাক্ষর জ্ঞান ও শিক্ষিতের হার বেড়েছে। নানা ক্ষেত্রে প্রসারও ঘটেছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে পিছিয়েছেও। অনেকে শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। সেটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তবে সে আলোচনায় যাব না। এ লেখায় আমি শিক্ষায় বৈষম্য ও বিভক্তির বিষয়টিতেই থাকতে চাই। বুধবার (১২ জুন) দৈনিক সমকালে প্রকাশিত নিবন্ধে এতথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন আবু সাঈদ খান।
ষাটের দশকে যে শিক্ষা আন্দোলন হয়েছিল, যার মর্মবাণী ছিল- বৈষম্যহীন সর্বজনীন আধুনিক শিক্ষা। যার প্রতিফলন সংবিধানেও রয়েছে। পাকিস্তান আমলে বৈষম্যের ক্ষেত্র ছিল- একদিকে সাধারণ স্কুল, অপরদিকে অধিক সুবিধাপ্রাপ্ত জিলা স্কুল, সরকারি স্কুল ও ক্যাডেট স্কুল। তখন সাধারণ শিক্ষার বাইরে আলিয়া ও কওমি মাদরাসা ছিল, যদিও সংখ্যায় কম।
ইংলিশ মিডিয়াম বলে আলাদা কোনো ধারা ছিল না। স্কুলেই ইংরেজি শিক্ষার ওপর জোর দেওয়া হতো। ব্রিটিশ আমলে আলিয়া মাদরাসায় ইংরেজি, অঙ্ক, যুক্তিবিদ্যা, দর্শন ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হতো। আমরা অনেকে জানি না, নওয়াব আবদুল লতিফ, সৈয়দ আমীর আলী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আকরম খাঁ, আতাউর রহমান খান, বিচারপতি মাহবুব মোরশেদ, কুদরাত-এ-খুদা প্রমুখ কীর্তিমান ব্যক্তি আলিয়া মাদরাসা ছাত্র ছিলেন।
আলিয়া মাদরাসার প্রথম অধ্যক্ষও ছিলেন একজন ইংরেজ। তখন আলিয়া মাদরাসার সঙ্গে আধুনিক শিক্ষার দূরত্ব কম ছিল। দেওবন্দ মাদাসায়ও উদার ও মানবিক চর্চার ক্ষেত্র প্রসারিত ছিল। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী দেওবন্দের ছাত্র ছিলেন। দেওবন্দের মওলানারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছিলেন।
ব্রিটিশ ভারত ও পাকিস্তান আমলে শিক্ষাব্যবস্থায় আজকের মতো বিভাজনরেখা ছিল না। ব্রিটিশ শাসক মুসলমানদের জন্য আলিয়া মাদরাসা ও হিন্দুদের জন্য হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করলেও পরে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আধুনিক সেক্যুলার শিক্ষায়ই মূলধারায় পরিণত হয়। বিংশ শতাব্দীর বিশ-ত্রিশের দশক থেকেই সচ্ছল মুসলমানরা ছেলেদের স্কুল-কলেজে পাঠান; মাদরাসায় নয়। কারণ তারা উন্নতির জন্য আধুনিক বা ইংরেজি শিক্ষার কথা ভেবেছেন। সে ভাবনা পাকিস্তান আমলেও ছিল। তখন মাদরাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের এত দাপট ছিল না।
স্বাধীন বাংলাদেশে এখন শিক্ষা প্রধানত তিন ধারায় বিভক্ত- সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা ও ইংরেজি মাধ্যম। এক ডজনের বেশি উপধারা রয়েছে। আমরা কি ইউরোপ-আমেরিকার দেশ, এমনকি এশিয়ার দেশ চীন ও জাপানের মতো দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত (অগত্যা অষ্টম শ্রেণি) জাতীয় ইতিহাস-ঐতিহ্য সংবলিত অভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবতে পারি না? উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অবারিত করা যেতে পারে, তা নিয়ে কথা নেই।
নীতিনির্ধারকরা বলছেন, তারাও এমনটা চান। তবে চটজলদি সম্ভব নয়। তর্কের খাতিরে মানলাম। প্রশ্ন হলো- সমন্বিত শিক্ষা পাঠক্রম চালু করা কি কঠিন কিছু?
সবারই জানা- মাদ্রাসা, বিশেষ করে কওমি মাদরাসা ও ইংরেজি মাধ্যমের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। কওমি মাদ্রাসায় মধ্যযুগের দরস-ই-নিজামী এবং ইংরেজি মাধ্যমে ব্রিটিশ ও মার্কিন সিলেবাস অনুসৃত হচ্ছে।
ক্ষমতাসীনরাসহ প্রায় সব রাজনৈতিক দল মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নের কথা বলছে। তবে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষায় পরিবর্তনের কথা বলছে না। কারণ, ওপরতলার মানুষ সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছেন। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চটাতে চাইছে না। কিন্তু আমরা কি ভেবে দেখছি- দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি-বিবর্জিত শিক্ষাব্যবস্থা কি দেশের সুনাগরিক তৈরি করতে পারে? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে- ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পরমুখী, এমনকি ইদানীং উগ্রবাদীও তৈরি হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বলা আবশ্যক, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা ভারতেও চালু আছে। তাদেরকে বাধ্যতামূলক দেশীয় পাঠক্রমের ইংরেজি ভার্সন পড়াতে হচ্ছে।
কওমি মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থার এই কারিকুলাম অনুসরণের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আধুনিক জীবনবোধ গড়ে উঠছে না। দক্ষ জনশক্তিও তৈরি হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে এক ভদ্রলোকের কথা বলতে চাই। আমার এলাকার এক মাওলানা (একটি মাদ্রাসার প্রধান) দেখা করতে এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে বললেন, তিনি তার ছেলেদের, এমনকি মেয়েকেও কলেজে পড়িয়েছেন।
তার ভাষায়- মাদরাসা ও সাধারণ শিক্ষা দুটিই ত্রুটিপূর্ণ। মাদ্রাসা শিক্ষা কর্মহীন আর স্কুল-কলেজের শিক্ষা ধর্মহীন। বলতে চেয়েছিলাম, স্কুল-কলেজে অধর্মের কী দেখেছেন? বলিনি এই ভেবে- তিনি আর না হোক, মাদ্রাসার শিক্ষক হয়ে মাদরাসাশিক্ষার ত্রুটির একটি দিক উপলব্ধি করেছেন। এই বোধ কওমি মাদ্রাসার পরিচালক আলেম-ওলামাদের মধ্যে জাগরিত হয়নি। তারা বলছেন, সরকারের কাছ থেকে দাওরা হাদিসের সনদ নেবেন; কিন্তু কারিকুলামে হাত দিতে দেবেন না। এ যেন রাষ্ট্রের মধ্যে আরেক রাষ্ট্র!
আলিয়া মাদরাসা সরকার পরিচালিত। সেখানকার পরিবেশ উন্নয়নে অনেক কিছু করার আছে। উন্নত পাঠক্রমের সঙ্গে শিক্ষকদের দক্ষতা ও মানসিকতার উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ। আমার জানা মতে, অমুসলিম শিক্ষক নিয়োগে আইনগত বাধা নেই। শুনেছি, কোনো কোনো মাদ্রাসায় বাংলা, অঙ্ক, ইংরেজি বিষয়ে হিন্দু শিক্ষক আছেন।
অমুসলিম শিক্ষক নিয়োগে জোর দিলে তা হবে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ গড়ায় সহায়ক। এমনকি ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাধারণ স্কুলের পূর্ণাঙ্গ পাঠক্রম চালু হলে হিন্দু বা অমুসলিমদের সেখানে ভর্তিতে বাধা থাকবে না। সম্রাট আকবর মাদরাসায় হিন্দুদের পড়ার বিধান চালু করেন। ফলে হিন্দুদের মধ্য থেকে আরবি ও ফারসি ভাষায় অনেক সুপণ্ডিতও হয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মাদ্রাসায় সাধারণ কোর্স চালু থাকায় হিন্দু ছেলেমেয়েরাও সেখানে পড়ছে। অধিক সংখ্যক নারী শিক্ষক নিয়োগের কথাও ভাবতে হবে। ফুলগাজীর যে মাদ্রাসায় নুসরাত পড়ত, সেখানে নারী শিক্ষক থাকলে নুসরাত ও অন্যরা তাদের কাছে যৌন নিপীড়নসহ সুবিধা-অসুবিধার কথা সহজে বলতে পারত, যা পুরুষ শিক্ষকের কাছে বলা কঠিন।
এটি স্বীকার্য যে, শিক্ষার সমস্যা ও বিভাজনরেখা ঘোচাতে শর্টকাট রাস্তা নেই। চাই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ও আন্তরিক প্রয়াস।
উপরোল্লিখিত বিভক্তির বাইরে আরও একটি নির্মম বিভক্তি আছে, যা সরকারসৃষ্ট। সেটি হলো রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বণ্টনে বৈষম্য। এর ফলে মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা তিন ভাগে বিভক্ত হয়েছে- সরকারি, এমপিওভুক্ত ও নন-এমপিও। সাধারণত শহর ও উপজেলায় অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি, অগত্যা এমপিওভুক্ত। আর শহর থেকে দূরের পল্লীতে অবস্থিত ১০-১২ হাজার স্কুল-কলেজ এখন নন-এমপিও। এর মধ্যে ৯ হাজার প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির জন্য অনলাইনে আবেদন করার সুযোগ পেয়েছে। সরকার বলছে, দুই হাজার আবেদন বিবেচনায় রয়েছে।
নন-এমপিও শিক্ষকদের দাবি, তারাও এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মতো পড়ান, পরিশ্রম করেন। একই কাজে বৈষম্য কেন? তারা কেন ন্যায্য বেতন পাবেন না? কথাটি যৌক্তিক।
এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা অধিক সুযোগ পাচ্ছেন। তারা তা কেন পাবেন না? এ কথারও যুক্তি আছে। একই সঙ্গে যুক্তিপূর্ণ যে, শিক্ষার্থীরা কেন সমান সুযোগ
পাবে না? বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় চেতনায় শিক্ষা দয়াদাক্ষিণ্য নয়; প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার। সংবিধান অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রের কাছ থেকে সমসুযোগের অধিকারী।
প্রশ্ন হচ্ছে- এমপিওভুক্ত হলে শিক্ষকরা বেতন পাবেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কী পাবে? সে বিবেচনায় সরকারীকরণই সমাধান। অনেকে সরকারীকরণের দাবি করছেন। তবে সরকারীকরণের দাবি তুলে এমপিওভুক্তির বিষয়টি পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। এমপিওভুক্তির প্রক্রিয়া চলমান রেখেই সরকারীকরণের কথা ভাবা উচিত। সরকারীকরণ হলে বদলির মাধ্যমে অনিয়ম দূর করা এবং মানের সমতা আনাও সম্ভব।
এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে সরকার চারটি বিষয় বিবেচনার কথা বলছে। সেগুলো হলো- একাডেমিক স্বীকৃতি, ছাত্রসংখ্যা, পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার। তবে আমি মনে করি, সর্বাগ্রে বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত- প্রতিষ্ঠান থেকে একই মানের প্রতিষ্ঠানের পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দূরত্ব, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা, মহাবিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে নিকটবর্তী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ও মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা। স্থাপনা ও পাঠদানের অনুমতির ক্ষেত্রে এ বিষয় দুটি অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। স্থাপনা ও পাঠদানের ক্ষেত্রে বিবেচ্য বিষয়গুলো এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রেও ভাবতে হবে।
বলা আবশ্যক যে, নিয়ম-বহির্ভূতভাবেও অনেক প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। একই এলাকায় যেখানে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থাকার নিয়ম, সেখানে একাধিক প্রতিষ্ঠান করা হয়েছে। এমনও আছে, একই গ্রামে রাস্তার এপারে একটি এবং ওপারে আরেকটি প্রতিষ্ঠান। এ বিষয়টিরও সমাধান প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে সাবেক শিক্ষা সচিব এনআই খানের সঙ্গে কথা হয়েছিল। তিনি 'রেশনালাইজেশন'-এর কথা বলেছিলেন। কম দূরত্বের একাধিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করা যেতে পারে। এটি যৌক্তিক বলে আমিও মনে করি। এতে ব্যয় কমে আসবে; বাড়বে মানও।
প্রসঙ্গক্রমে, কারিগরি শিক্ষার প্রসার সময়ের দাবি। সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সে কারিগরি শিক্ষা কার্যক্রম যুক্ত করলে তা হবে ব্যয় সংকোচন এবং দ্রুত কারিগরি শিক্ষার প্রসারে যৌক্তিক পদক্ষেপ।
সাংবাদিক ও লেখক