শিক্ষা : মানসিকতায়, না পরীক্ষায়? - দৈনিকশিক্ষা

শিক্ষা : মানসিকতায়, না পরীক্ষায়?

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া জীবনের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়ার কথা। এখানে একজন শিক্ষার্থী একটি প্রতিষ্ঠানের অংশ হয়ে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাবে অর্থাৎ লেখাপড়া করবে। একেকজন শিক্ষার্থী তার মেধা এবং আগ্রহের ওপর নির্ভর করে একেকরকম দক্ষতা অর্জন করবে। একটি প্রতিষ্ঠানের কাজ হলো, একজন শিক্ষার্থীকে লেখাপড়ার উপযুক্ত একটি পরিবেশ দেওয়া। যেন একজন শিক্ষার্থী নিজের মেধা ও আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে নিজেকে ভবিষ্যতের জন্য মানানসই করে গড়ে তুলতে পারে। একজন শিক্ষার্থী মেধাবী হলেই ওর লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ থাকবে, এ রকম নয়। আমাদের সন্তানদের সবারই কমবেশি মেধা আছে; কিন্তু লেখাপড়ার প্রতি সবার আগ্রহ সমান নয়। একটি প্রতিষ্ঠান এবং অভিভাবকদের বড় একটি দায়িত্ব হলো, একজন শিক্ষার্থীর মাঝে লেখাপড়ার আগ্রহ জাগিয়ে দেওয়া। এটা খুব কঠিন একটি দায়িত্ব। এর সহজ কোনো সমাধান নেই, প্রাইভেট বা কোচিং থেকে লেখাপড়ার প্রতি খুব একটা আগ্রহ শিক্ষার্থীর মাঝে আসে না। বরং অনেক ক্ষেত্রে ওদের আগ্রহও কমে যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শুক্রবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

লেখাপড়া করতে গেলে বই পড়তে হয়। বই পড়ে কিছু বুঝতে গেলে লিখতেও হয়। এতে করে একটি বইয়ের জ্ঞান ধীরে ধীরে একজন শিক্ষার্থীর চিন্তায় এবং মননে ছাপ ফেলে। এভাবেই পড়তে ও লিখতে গিয়ে একজন শিক্ষার্থী বইয়ের জ্ঞান অর্জন করে। বইয়ের অর্জিত জ্ঞানকে জীবনে কাজে লাগানোকেই শিক্ষা বলতে পারি। এখন একজন শিক্ষার্থী বইয়ের জ্ঞান কতটুকু অর্জন করেছে, এ জন্যই নানা উপায়ে পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। লেখাপড়ার একটি ওতপ্রোত অংশই হলো পরীক্ষা। একটি পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু পরীক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞানের পরিমাপ করা হয় না; এতে করে একজন পরীক্ষার্থীর মেধারও চর্চা করা হয়ে থাকে। পরীক্ষা নেওয়ার বহু উপায় আছে। একটি বই পড়ার পর একজন শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, সে কতটা শিখেছে। বইয়ে থাকা প্রশ্নের উত্তর লিখতে দিয়ে জানতে পারি, কতটা বুঝতে পেরেছে। এমনকি বইটিতে থাকা কোনো একটি বিষয়ের ওপর রচনা লিখতে দিয়েও জানতে পারি, বইটা সম্পর্কে ওর সামগ্রিক ধারণা কেমন। এ রকম অনেক উপায়েই একজন শিক্ষার্থীর অর্জিত জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। এটি একটি স্বাভাবিক ধারণা যে, পরীক্ষা না থাকলে একজন শিক্ষার্থী সঠিক গভীরতায় একটি বই পড়তে চাইবে না। এই পরীক্ষার মাধ্যমেই একজন শিক্ষার্থী ধাপে ধাপে নিজেকে গড়ে তোলে  পরবর্তী ধাপের জন্য। কেননা কোনো একটি নির্দিষ্ট ধাপের লেখাপড়ার জন্য আগের ধাপের জ্ঞান খুবই অপরিহার্য।

কোনো কারণে যদি একটি নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ করে দেওয়া হয়, তাহলে একজন শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রে কী করে বুঝব, সে পরবর্তী ধাপের জন্য উপযুক্ত কি-না? এই পরীক্ষা না থাকার মানে কী কী হতে পারে? একজন শিক্ষার্থীকে কি ক্লাসে কোনো কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না, ক্লাসে কোনো একটি প্রশ্ন করে শিক্ষার্থীকে উত্তর লিখতে বলা যাবে না, কোনো বাড়ির কাজ দেওয়া যাবে না, নাকি প্রশ্নপত্রে কোনো পরীক্ষা নেওয়া যাবে না- এগুলোর সবই কিন্তু পরীক্ষার আওতায় পড়ে। প্রতিটি শিক্ষার্থীরই কিছু না কিছু পরীক্ষা-ভীতি থাকে। ছাত্রজীবনে এই ভীতিটারও দরকার আছে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা কেনই-বা পড়তে চাইবে! সাধারণত পরীক্ষা দিয়েই শিক্ষার্থীদের মাঝে ভালো করার একটি সুস্থ প্রতিযোগিতাও তৈরি করা যায়। একটি নির্দিষ্ট সময়ের আগে এই দেশে বোর্ডের প্রথম পরীক্ষা ছিল এসএসসি। সঙ্গে অবশ্য ক্লাস ফাইভ এবং ক্লাস এইটের বৃত্তি পরীক্ষা হতো, যেগুলো বোর্ডের পরীক্ষা। এই দুটি বৃত্তি পরীক্ষায় ক্লাসের অল্প কিছু মেধাবী ছাত্রই অংশগ্রহণ করত। কিন্তু ক্লাস ফাইভ আর ক্লাস এইটে বোর্ডের সাধারণ পরীক্ষা চলে আসাতে আমাদের দেশে এক অহেতুক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। যখন এসএসসি প্রথম বোর্ডের পরীক্ষা ছিল, তখন অভিভাবকরা শিক্ষার্থীর লেখাপড়ার ব্যাপারে বিশেষ তৎপর হতেন ক্লাস এইট বা নাইনের দিকে। এখন এটা শুরু হয়ে গেছে ক্লাস থ্রি বা তারও আগে থেকে। এখানে তৎপর বলতে অভিভাবকরা নিজেরা তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার বিশেষ যত্ন নিচ্ছেন, তা নয়। তাদের একটি বড় অংশ চলে গেল শিক্ষকদের কাছে; স্কুল শিক্ষক, প্রাইভেট বা কোচিং শিক্ষক- এসব অভিভাবকের কথা একটাই, কীভাবে আমার সন্তান গোল্ডেন জিপিএ ৫ পাবে। এর জন্য স্কুলের পর স্কুলে কোচিং আছে, বাড়িতে প্রাইভেট টিউটর আছে, ক্লাসের শিক্ষকের বাসায় বা কোচিংয়ে গিয়ে অতিরিক্ত পড়ার ব্যবস্থা আছে। একজন শিক্ষার্থী এতবার শিক্ষক বা কোচিং সেন্টারে গেলে নিজে পড়ার সময় কোথায়? আর বন্ধুদের সঙ্গে লেখাধুলা, বাড়ির কিছু কাজ করা- এগুলো ধীরে ধীরে লোপ পেতে যাচ্ছে। এটা রীতিমতো একটি অসুস্থ ধারার লেখাপড়া। একদিকে পরীক্ষা তুলে দেওয়ার কথা চলছে; অন্যদিকে ভালো স্কুলগুলোতে ভর্তির জন্য একেবারে ছোট শিক্ষার্থীকেও পরীক্ষার জন্য নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। 'আমার সন্তানকে ভালো স্কুলে পড়তে হবে' এবং 'আমার সন্তানকে ভালো করতেই হবে'- এ ধাঁচের মানসিকতা যেন আমাদের চিন্তাধারাকে একেবারে স্থবির করে দিয়েছে। একটি নির্দিষ্ট ধাপ পর্যন্ত পরীক্ষা বন্ধ হলো; কিন্তু তার পরের ধাপ থেকেই যদি পরীক্ষা থাকে, তাহলে 'আমার সন্তানকে ভালো করতেই হবে' এই মানসিকতার জন্য আমরা নতুন করে কোচিং বা নতুন করে বাচ্চার ওপর আলাদা চাপ কি সৃষ্টি করব না? পরীক্ষাবিহীন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি  যে ছাত্রের ওপর পরীক্ষাযুক্ত প্রাইভেট বা কোচিংয়ের ব্যবস্থা যে আমরা করব না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে?

লেখাপড়ার সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নীতি-নৈতিকতা। আর প্রশ্ন ফাঁস ও নকলের কারণে খোদ শিক্ষাব্যবস্থাতেই নীতি-নৈতিকতা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এর থেকে অচিরেই পরিত্রাণের উপায় বের করতে না পারলে এর জন্য পুরো জাতিকে একদিন চরম মূল্য দিতে হবে। সাধারণ প্রশ্নপত্র দিয়ে উত্তর লেখার বাইরেও অন্য রকম পরীক্ষা দিয়ে একজন ছাত্রের মেধা এবং জ্ঞানের অগ্রগতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে একজন শিক্ষার্থীর পেছনে অনেক সময় দিতে হবে। কিন্তু একজন শিক্ষকের পক্ষে কতজন ছাত্রছাত্রীর ওপর নজর রাখা সম্ভব? যেখানে লেখাপড়ার জন্য অনেক অভিভাবকই নিজের সন্তানকে সময় দিতে না পেরে প্রাইভেট আর কোচিংয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, সেখানে একজন স্কুল বা কলেজশিক্ষক একজন ছাত্রের জন্য কতটা সময় দেবেন? কোনোভাবেই যেন বিশ্ববিদ্যালয় লেভেলের ভর্তি পরীক্ষা বাতিল না করা হয়। এখানেও প্রশ্ন ফাঁস, নকল, ভর্তি পরীক্ষা না দিয়েই ভর্তি হওয়ার মতো অনেক কিছুই ঘুণপোকার মতো বাসা বেঁধেছে। একটি দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে সব ব্যবস্থাতেই থাকা দরকার একটি স্থিরতা। শিক্ষাক্ষেত্র কেমন অস্থির হয়ে আছে! পরীক্ষা পদ্ধতি, সিলেবাস,  প্রাইভেট, কোচিং, নকল, প্রশ্ন ফাঁস- এগুলোর সবকিছুই শিক্ষাব্যবস্থাকে বারবার নাড়িয়ে দিচ্ছে। এর পেছনে দায়ী হলো আমাদের অসুস্থ মানসিকতা। এর থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। সমস্যার সমাধান করতে হলে দৃষ্টি দিতে হবে উৎসে।

মোহাম্মদ আসাদ উজ জামান : সহযোগী অধ্যাপক, গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি - dainik shiksha চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সচিবের বিরুদ্ধে মাউশির তদন্ত কমিটি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.015136003494263