শিশুর সঙ্গে মায়েরাও পড়েন - দৈনিকশিক্ষা

শিশুর সঙ্গে মায়েরাও পড়েন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

মেয়ের পাশে বসেই পরীক্ষা দিচ্ছেন মা। মেয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে, মা–ও। একই পরীক্ষা, ইংরেজি। শুধু একজন মা এবং আর একজন মেয়ে নয়; অনেক ছেলে, অনেক মেয়ে, অনেক মা। আবার এখানে পড়ার জন্য কাউকে বেতনও দিতে হয় না। অন্য রকম এই পাঠশালার পরীক্ষা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল সম্রাট নেপোলিয়নের কথা। ২০০ বছর আগে একটি শিক্ষিত জাতির প্রত্যাশায় তিনি একজন শিক্ষিত মা চেয়েছিলেন। সেই মায়ের অভাব আমাদের আজও ঘোচেনি। একজন আবু জাফর যেন সেই অভাব দূর করার লড়াইয়ে নেমেছেন। বস্তির বাচ্চাদের জন্য খুলেছেন পাঠশালা। এখন সেখানে শুধু বস্তির নয়, সব বাচ্চাই আসে। আবার শুধু বাচ্চারাই আসে না, তাদের মায়েরাও পড়তে আসেন। শনিবার (২৮ সেপ্টেম্বর) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আবুল কালাম মুহম্মদ আজাদ।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, জাফরের এই পাঠশালার নাম ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন’। রাজশাহীর নগরের ছোটবনগ্রাম পশ্চিমপাড়া কৈইটাপুকুর নতুন বাইপাস মোড়ে ইজারা নেওয়া একখণ্ড জমিতে বাবার পেনশনের টাকায় গড়ে তুলেছেন এই প্রতিষ্ঠান। সব মিলিয়ে শিশুশিক্ষার্থী এখন চার শতাধিক। সঙ্গে অর্ধশত মা–ও পড়েন।

পাঠশালার পড়াশোনা

পাঠশালায় কক্ষ আছে চারটি। তিন পালায় চলে এই পাঠশালা। সকাল আটটা থেকে সাড়ে নয়টা পর্যন্ত শিশু শ্রেণি। এরপর বেলা ১১টা পর্যন্ত কেজি, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি এবং শেষে বেলা একটা পর্যন্ত তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান চলে। এর বাইরে চলে জাফরের আসল পাঠদান। সেটি হয় বিকেলবেলায়। নগরের বারোরাস্তার মোড়ে লাল ভাইয়ের আমবাগানে, গাছের নিচে। আশপাশের ১৫টি বস্তির বাচ্চা ও মায়েরা সেখানে আসে। সেখানে তাদের প্রথম বর্ণপরিচয় করানো হয়। বর্ণপরিচয় পেলে তারা পাঠশালায় আসে।

পাঠশালার জমির জন্য বছরে ২০ হাজার টাকা এবং পাঁচজন শিক্ষককে কিছু সম্মানী দিতে হয়। জাফরের নিজের একটি ইলেকট্রনিকসের দোকান আছে। দুই ভাই মিলে দোকানটি চালান। দোকানের আয় থেকেই তিনি পাঠশালার ব্যয়ভার বহন করেন। জাফরের বয়স এখন ৪০। বিয়ে করেছেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে। স্ত্রী কানিজ ফাতেমা প্রথম দিকে আপত্তি করলেও এখন স্বামীর সেবাধর্মকে মেনে নিয়েছেন। বললেন, ‘এটা বড় কাজ। এখন আমিও কিছু সহযোগিতা করি।’

জাফরের বাড়ি রাজশাহী নগরের ছোটবনগ্রাম প্রফেসরপাড়ায়। বাবা মহসীন-উল-বারী রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের উপমহাব্যবস্থাপক ছিলেন। জাফর রাজশাহী কলেজ থেকে সমাজবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন। শিশুদের পড়ানোর নেশায় ভালো চাকরি পেয়েও করেননি।

শুরুটা যেমন ছিল

জাফরের বাড়ির পাশেই ছিল বড়সড় এক বস্তি। সেখানকার বাচ্চারা সারা দিন দুষ্টামি করে বেড়ায়, পড়াশোনা করে না। এই শিশুদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে জাফর তাদের পড়ালেখা শেখাতে চান। সে বছর ষোল আগের কথা। কিন্তু কেউ জাফরকে পাত্তা দেয় না। বাচ্চারা তো কথা শোনেই না। জাফর তখন চকলেট দিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব জমানো শুরু করলেন। দেখতে দেখতে ৪০–৫০ জন বাচ্চা জুটে যায়। জাফর তাদের বই–খাতার ব্যবস্থা করেন। ভাঙারি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পুরোনো খাতা কেজি দরে কিনে ভেতরের অব্যবহৃত সাদা পাতাগুলো দিয়ে খাতা বানিয়ে দিতেন। কোনো বন্ধুকে ধরে হয়তো কলম কেনার ব্যবস্থা করতেন।

২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের কথা। বাবার পেনশনের বকেয়া বিল পাওয়া গেল ৫০ হাজার টাকা। বাবা মারা যাওয়ার আগে তাঁকে বলেছিলেন, নিজের ক্ষতি না হয়, এভাবে যতটুকু পারো মানুষের সেবা করবে। এ কথা মাকে মনে করিয়ে দেওয়ার পর পেনশনের পুরো টাকাই মা রাহেলা বেগম ছেলেকে দিয়ে দেন। এবার জায়গা খোঁজেন জাফর। বস্তির বাচ্চাদের বিদ্যালয় করার কথা শুনে কেউ জায়গা দিতে চায় না। এই বাচ্চারা মহল্লার পরিবেশ নষ্ট করবে। অবশেষে সাধু নামের এক ব্যক্তি বার্ষিক ২০ হাজার টাকা ইজারায় তাঁর পাঁচ কাঠা জমিতে বাচ্চাদের জন্য ঘর করতে দিয়েছেন। এ কাজ করতে দেখে লোকে জাফরকে ‘পাগল’ বলতে লাগল। কেউ বলল, কোচিং সেন্টার করলে বড়লোক হয়ে যাবে। তবে এর মধ্যেও রাজশাহী মহিলা কলেজের শিক্ষক সারোয়ার জাহান তাঁকে ১০ জোড়া বেঞ্চ ও একটি শৌচাগার করে দেন। মহসীন আলী ও নূর-ই-ইসলাম নামের দুই ব্যক্তি ঘরের মেঝে করে দেন। সবচেয়ে কম দামের টিন কিনে ঘর করা হয়। শুরু হয় ‘আলোর পথে বিদ্যানিকেতন’–এর যাত্রা।

নূর-ই-ইসলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরীরচর্চা বিভাগের জ্যেষ্ঠ উপপরিচালক। তিনি বলেন, জাফর প্রাণের টানে কাজটা করেন। তাঁর এই টান বুঝতে পেরে তিনি যতটুকু পারেন সহযোগিতা করেন। সমাজের শিক্ষিত মানুষেরা যদি এগিয়ে আসেন, তাহলে জাফর সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আরও এগিয়ে নিতে পারবেন।

পাঠশালায় একদিন

সম্প্রতি আলোর পথে বিদ্যানিকেতনে গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছোট ছোট খুপরির ভেতরে একেকটি শ্রেণিকক্ষ। গরমে সেখানে টেকা দায়। তার মধ্যেই দেখা গেল, মেয়ে নুসরাত খাতুনের পাশে বসে মা রাহিনা বেগম পরীক্ষা দিচ্ছেন। লাজুক হাসি হেসে রাহিনা বেগম বলেন, মেয়ের সঙ্গে তিনিও চেষ্টা করছেন। একটু যদি লিখতে–পড়তে পারেন, তাহলে মন্দ হয় না।

মা পুষ্প দাস তৃতীয় শ্রেণিতে পড়েন। তাঁর মেয়ে সুষ্মিতা দাস পড়ে প্রথম শ্রেণিতে। পুষ্প দাস বলেন, ‘নিজে কিছুই জানতাম না। বাচ্চাকে যে বাড়িতে একটু বর্ণ পরিচয় করাব, সেটুকুও জানতাম না। এখানে এসে শিখেছি। আমিও পড়ি, আমার সন্তান পড়ে। এখানকার স্যার-ম্যাডামেরা অনেক ভালো। এমনি পড়ান। না পারলে আবার বুঝিয়ে দেন।’ একই ধরনের কথা বললেন শিক্ষার্থী বিপাশার মা শীলা রানি, হাবিবার মা রশিদা বেগমসহ অনেকে।

পাঠশালার দেয়ালে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা লেখা। তার মধ্যে আছে, ‘বাল্যবিবাহ বন্ধ কর, অকাল মৃত্যু রোধ কর,’ ‘বেশি করে গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান,’ হাত ধোয়ার সঠিক নিয়মসহ অনেক কিছু।

অন্যরা যা বললেন

পাঠশালায় শিক্ষকতা করছেন সাব্বির হোসেন, শরিফা খাতুন, রাবেয়া খাতুন, মুন্নী ইসলাম ও মো. সিদ্দিক। সাব্বির হোসেন বলেন, সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য শুরু থেকেই আছেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘আমরা নামমাত্র পারিশ্রমিক পাই। তবে তার চেয়ে বড় কথা, এই শিশুরা আগামী দিনে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে—এটাই আমাদের স্বপ্ন।’

আবু জাফরের পাঠশালাটি রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে পড়েছে। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তৌহিদুল হক জানান, পাঠশালাটি তিনি দেখেছেন। তাঁর খুব ভালো লেগেছে। আবু জাফর নিঃস্বার্থভাবে কাজটি করছেন। প্রতিষ্ঠানটি এলাকায় আলো ছড়াচ্ছে। তবে ওখানে যাওয়ার রাস্তা নেই। বাচ্চারা কাদার ভেতর দিয়ে কষ্ট করে যায়। তিনি রাস্তাটি করে দেয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছেন।

আবু জাফর ঢাকায় চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে চলে এসেছেন। চাকরি ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘বাচ্চারা দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমার বুক ভরে যায়। আমি বাচ্চাদের ছেড়ে কোথাও যেতে পারব না।’

নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রমের ৩১ পাঠ্যবইয়ে ১৪৭ ভুল বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ - dainik shiksha বজ্রপাতে মাদরাসার ২১ ছাত্র আহত, হাসপাতালে ১১ যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি - dainik shiksha যতো লিখেছি, ছিঁড়েছি তার বেশি তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি - dainik shiksha তত্ত্বাবধায়ককে বাধ্য করে ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ - dainik shiksha সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুই কবির জন্মবার্ষিকী পালনের নির্দেশ শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই - dainik shiksha শিক্ষকদের চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী - dainik shiksha বিদ্যালয়ের ক্লাস থামিয়ে ভোট চাইলেন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.024606943130493