‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড‘ এই বাক্যটি শুনে এসেছি বাল্যকাল থেকে। তবে আজকের বাস্তবতায় এ বাক্য খানিকটা বদলে গেছে। এখন বলা হয় ‘সুশিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড‘।
সভ্যতার ঊষালগ্নে মানুষ যখন শিক্ষার পথে পা বাড়ায়, তখন থেকে পরবর্তী বহুকাল পর্যন্ত শিক্ষিত লোকজনের মাঝে সুশিক্ষাই বিরাজমান ছিলো। তারা উন্নত নৈতিকতাসহ আদর্শবাদী ব্যক্তিবর্গ হিসেবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের নিকট সমাদৃত ছিলেন। তারা সর্বদা সত্যকথা বলতেন; সহজ-সরল পথে চলতেন; মানুষের কল্যাণে নিজেদের উৎসর্গ করতেন। আর কেউ যদি অনিচ্ছা সত্ত্বেও সামাজিকভাবে অন্যায় কোনো কাজ করে বসতেন, তাহলে তিনি নিজেই তা স্বীকার করতেন। সাক্ষীর প্রয়োজন হতো না। সে পর্যন্ত শিক্ষিত মানুষকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হতো এবং এটা ছিল সর্বজনস্বীকৃত।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে শিক্ষিতজনদের কারও কারও মাঝে দেখা দিতে শুরু করে অনৈতিক কর্মকাণ্ড। সময়ের ব্যবধানে শিক্ষিত অনৈতিকদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। লোভ-লালসা ও বিভিন্ন প্রকার স্বার্থ চরিতার্থে তারা অর্জিত শিক্ষাকে ঠেলে দেয় পায়ের নিচে। এসব অনৈতিক ব্যক্তিকে আবারও নৈতিকতার জায়গাতে নিয়ে আসার লক্ষ্যে উদ্ভব ঘটে সুশিক্ষা কথাটির। সুশিক্ষা হচ্ছে শিক্ষার এমন এক অবস্থা যা শিক্ষার্থীদের সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে এবং যথাসময়ে স্বশিক্ষায় রূপান্তর করে। জ্ঞানীগুণীদের মতে, সুশিক্ষা মানেই স্বশিক্ষা। আর সুশিক্ষা অর্জনের মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে; হয়ে ওঠে খাঁটি দেশপ্রেমিক। তাদের সার্বক্ষণিক পদচারণায় সত্য ও সুন্দরের ময়দান আলোকিত হয়ে ওঠে। তারা পরিণত হয় জাতির অমূল্য সম্পদে। অতএব, সুশিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করি, সুশিক্ষা মানুষকে স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে রাখে; কর্মক্ষেত্রে নীতিবান হতে সাহায্য করে এবং সৎ পথে উপার্জনে উদ্বুদ্ধ করে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষিতজনদের ভেতরেও সুশিক্ষার বড় অভাব পরিলক্ষিত হয়। চিন্তা করতে হবে কীভাবে তাদেরকে সমাজের জন্য আশীর্বাদ করে গড়ে তোলা যায়। এ ক্ষেত্রে বেশ কটি পথ খোলা রয়েছে বলে আমি মনে করি। যেমন ...
১. বিদ্যার্জনের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের ওপর নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলকভাবে আরোপ করা।
২. মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করে এমন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা।
৩. শিক্ষা সহায়ক কার্যক্রমে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা।
৪. স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলাধুলা নিশ্চিত করা হয়।
৫. সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার সুনিশ্চিতপূর্বক তা বাস্তবায়ন করা ইত্যাদি।
তূলনামূলক বিচারে পঞ্চমটির গুরুত্ব অধিক। কেননা, সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত হলে দুনীতি; স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি অপকর্ম সমাজ থেকে বিদায় নেবে। তখন সেখানে উদ্ভব হবে নতুন মূল্যবোধের যা তাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে সুশিক্ষার রাস্তা দেখাবে। আর প্রথম চারটি মানবীয় গুণ এক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
বিশ্বের বেশ কিছু দেশ সুশিক্ষার আলোয় আলোকিত । এসব দেশের নাগরিকেরা স্ব স্ব অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন। তাছাড়াও তারা কর্মঠ। লোভ-লালসা তাদেরও আছে। কিন্তু তা চরিতার্থে তারা কোনো অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করেন না। কঠোর পরিশ্রম করেন । কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমেই তারা নিজেদের উন্নতিসহ তাদের জাতীয় উন্নতিতে অবদান রাখেন এবং নিজেদের দেশকে উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাপী।
একমাত্র সুশিক্ষা তাদের কোথায় নিয়ে গেছে ভাবতে গেলেও অবাক হতে হয়। আমাদের দেশে সুশিক্ষিত ও সৃজনশীল জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বাধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবীয় গুণাবলির সমন্বয়ে সুশিক্ষার টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হলে জাতীয় অর্থনীতির দিক থেকে নিকট ভবিষ্যতে আমরাও আকাশ স্পর্শ করবো।
লেখক : প্রকাশক, লেকচার পাবলিকেশন্স লি.