যে যা-ই বলুন, ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কে এখন পুরো দেশ। প্রথমে রাজধানী ঢাকায় শুরু হলেও ক্রমেই ডেঙ্গু সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়েছে। গুজবের ভয় দেখিয়ে ডেঙ্গু ঠেকানো যায়নি, যায়ও না। কিন্তু আমরা সবকিছুকে হালকা করে দেখতে অভ্যস্ত। সঙ্গে আবার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। এসব উপসর্গ আমাদের বিরাট ক্ষতি করে। প্রথমত, এ ধরনের মানসিকতা সমস্যার গভীরে যেতে চিন্তাকে বাধা দেয়, তাই সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। কথায় বলে, সময়ের এক ফোঁড়, অসময়ের দশ ফোঁড়। আমজনতার অভিজ্ঞতাজাত জ্ঞানে কর্তাদের বেজায় ঘেন্না!
ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত না নিতে পারলে মাশুল দিতে হয় সবাইকে। ডেঙ্গু নিয়ে মিডিয়া সোচ্চার অনেক আগে থেকেই। বারবার লেখা হয় আগাম সতর্ক করে। কিন্তু কেউ কানে তোলেনি সেসব কথা। এমনকি, ডেঙ্গু যখন সাক্ষাৎ যম হয়ে হাজির, তখনো কত কথাই না শুনতে হয়েছে আমাদের। বুধবার (৭ আগস্ট) প্রথম আলোয় প্রকাশিত নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধনটি লিখেছেন আমিরুল আলম খান।
কিন্তু বাস্তবতা হলো, আজ রাজধানী ঢাকা তো বটেই, সারা দেশে ডেঙ্গু আতঙ্ক। ইতিমধ্যে দেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রায় ৩০ হাজার! সংকট মশা নিধনের উপযুক্ত ওষুধের, ডেঙ্গু কিটসের। হাসপাতালে যেমন তিল ধারণের ঠাঁই নেই, তেমনি চিকিৎসা ব্যয়ও সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় যথেষ্ট অভিজ্ঞতাও নেই দেশের সব চিকিৎসকের। মফস্বলের অবস্থা আরও খারাপ।
দেশজুড়ে মশার উৎপাত সারা বছর। কিন্তু মশা নিধনে কারও মাথাব্যথা আছে, তা মনে হয় না। শুধু এখানেই শেষ নয়, কাজের দায়িত্বটা কার, সেটা নিয়েও অনর্থক হাজার তর্কবিতর্ক। কাজটা কারা করবে—স্থানীয় সরকার? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? যদি তা নির্দিষ্ট করে কোথাও বলা না থাকে অবলম্বে তা নির্দিষ্ট করা হোক। দেশ মশকমুক্ত করুন। সব জাতের মশা থেকে মুক্তি চাই আমরা। এনোফ্লিশ, কিউলেক্স, এডিস—সব জাতের মশা থেকে মুক্ত হতে চাই আমরা।
আমাদের মন্ত্রী, মেয়র মহোদয়েরা আমাদের নিত্য উপদেশ খয়রাত করে চলেছেন। কেউ কেউ আবার হুমকি দিয়ে কথা বলতে পারঙ্গম। তারা নিশ্চয় দেশের মানুষকে পাগল গণ্য করেন। না হলে এসব অমৃতবচন আমাদের শুনতে হতো না।
যেকোনো রোগের প্রাদুর্ভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে শিশু ও প্রবীণেরা। তাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম। তা ছাড়া তাদের চিকিৎসা করাও কিছুটা কঠিন। তারা আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকিও বেশি হয়। অন্যান্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তো আছেই। তাই যখনই কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে, স্বাভাবিকভাবেই সবাই শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় থাকে পরিবারের সদস্যরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এখন অনেক বেশি সক্রিয়। সেখানে চোখ বুলালেই বোঝা যায় দেশের মানুষের উৎকণ্ঠার পারদ কতটা চড়া। সংবাদমাধ্যম অহর্নিশ জানাচ্ছে দেশের পরিস্থিতি। মনে হচ্ছে, সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লেও কর্তাদের ঘুম ভাঙছে না।
আমাদের স্কুল-কলেজগুলো কখনোই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন নয়। সেখানে মশার উপদ্রব স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু শিশুদের আমরা স্কুলে পাঠাচ্ছি, কোচিংয়ে পাঠাচ্ছি। একবারও ভেবে দেখছি না, এর কী মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। আমরা নানা উপলক্ষে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দিই। কিন্তু এখন ঠিক বিপরীত অবস্থা। যেন স্কুল-কলেজ বন্ধ করলে দেশের লেখাপড়া গোল্লায় যাবে। তাই তারা পণ করেছেন, কোনো ক্রমেই স্কুল বন্ধ করা হবে না। মানুষের জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলা বাংলাদেশেই সম্ভব।
আমাদের শিশুদের নিরাপত্তা দরকার সবার আগে। স্কুল ছুটি ঘোষণা করা দরকার ছিল অনেক আগেই। আমরা এখনো বিশ্বাস করি, আর দেরি না করে সরকার আজই দেশের সব স্কুল-কলেজ ছুটি ঘোষণা করবে। একটি দিনও যদি বাঁচে, তাহলে অনেকেই ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে রক্ষা পাবে, এই সরল সত্যটা বুঝতে পারতে হবে। ঈদের পরও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত এমন ব্যবস্থা বহাল রাখা যায়।
আমিরুল আলম খান: লেখক এবং যশোর শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান।