হিরোশিমায় বোমাবর্ষণের পর নীচের ধ্বংসলীলা প্রত্যক্ষ করে যুদ্ধবিমানের কো-পাইলট রবার্ট লুইস মন্তব্য করেছিলেন ” গু এড়ফ যিধঃ যধাব বি ফড়হব?” তার এই ক’টি শব্দে বর্ণিত ভয়ংকরা দৃশ্যাবলী আজও বিশ্বব্যপী প্রতিধ্বনিত হচেছ। বিশ্বের সিংহভাগ জনগন ’যুদ্ধ নয়, শান্তি চায়’। কারা যুদ্ধ চায়? পৃথিবীর কোন দেশের সাধারন নাগরিকগন কখনও যুদ্ধ চায়না। তারা কোন ধরনের সংঘাত চায়না, শান্তিই চায়। সাধারন মানুষের সাথে যারা রাজনীতির খেলা করে দেশের অভ্যন্তরে, তারাই দেশের বাইরে আন্তর্জাতিক মন্ডলে যুদ্ধের খেলা করে। যুদ্ধের খেলা মানে চরম মানবিক বিপর্যয়, মানবজাতির চরম দুর্ভোগ ও দুর্দশা।
যুদ্ধবাজদের কে দিয়েছে এই অধিকার? এ পৃথিবী কাদের? মানুষের না অমানুষদের? যারা যুদ্ধ নিয়ে খেলা করে তারাতো অমানুষ, মানুষ নয়। এই পৃথিবী মানুষের জন্য, অমানুষদের জন্য নয়। স্রষ্টা এ পৃথিবীতে অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন, সবকিছুই মানব কল্যাণে। কিন্তু এই যুদ্ধবাজরা নিজেদের সামান্য স্বার্থের কারনে এই সুন্দর পৃথিবীকে নরকে পরিণত করে। হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে মানব সৃষ্ট চরম নিষ্ঠুরতা গোটা পৃথিবীকে হতবাক করে দিয়েছিল, মুহুর্তের মধ্যে ধমকে গিয়েছিল সারা বিশ্ব, বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল সারাবিশ্বের বিবেকবান মানুষ কিন্তু যুদ্ধের আসল নাটের গুরুদের কোন ভাবোদয় হয়নি। ট্রুম্যান একটুও অনুতাপ করেনি এতো বিশাল ধ্বংসযজ্ঞ, রক্তপাত আর পরিবেশের এই বিশাল ক্ষতির জন্য-বুঝাই যাচ্ছে তার হৃদয় বলতে কিছু ছিলনা, হৃদয় থাকলেই মানবতা থাকবে। এই হৃদয়হীন মানুষেরাই যুদ্ধবাজ, তারাই গোটা পৃথিবীর অশান্তির জন্য দায়ী।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম ঘটনা ঘটেছিল ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে এবং তিনদিনের ব্যবধানে ৯ই আগস্ট নাগাসাকিতে। ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে বোমা বিস্ফোরণের ফলে হিরোশিমাতে প্রায় ১৪০০০০ লোক মারা যান, নাগাসাকিতে প্রায় ৭৪ হাজার লোক মারা যান। এই দুই শহরে বোমার পাশ্বপ্রতিক্রিয়ায় সৃষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরও ২১৪০০০ মানুষ। সব মিলিয়ে বিভিন্ন রোগে যা বোমার প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি হয়েছিল হিরোশিমায় মোট ২৩৭০০০ এবং নাগাসাকিতে ১৩৫০০০ লোকের মৃত্যু ঘটে। তারা প্রায় সবাই বেসামরিক লোক। বোমার তেজস্ক্রিয়তা এবং বিষাক্ততা আজও সেখানকার মানুষ বয়ে বেড়াচেছ। কতবড় নারকীয় ঘটান যে, ৬৭-৬৮বছর পরেও তার বিষ মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতি করে চলছে। সুন্দর পৃথিবীকে যারা বিভৎস বানিয়েছে এবং বানানোর পায়তারা করছে এখনও, তারাই মানবতার শত্রু। এই শত্রুরাই বাধিয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
১৯১৮ সালের ২৮শে জুন বসনিয়ার রাজধানী সারায়েভো শহরে আষ্ট্রিয়ার যুবরাজ আর্কডিউক ফার্ডিনান্ড সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হলে অষ্ট্রিয়া সার্বিয়াকে দায়ী করে এবং হত্যাকান্ডের একমাস পরেই অর্থাৎ ২৮শে জুলাই সার্বিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। তাদের সাথে যুক্ত হয় দুই দেশের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এবং দুই পক্ষে শুরু হয় যুদ্ধ।অষ্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, তুরস্ক ও জার্মানীকে নিয়ে কেন্দ্রীয় শক্তি ও সার্বিয়া, ফ্রান্স, রাশিয়া, বৃটেন, জাপান, ইটালি ও আমেরিকাকে নিয়ে গড়ে ওঠে মিত্র শক্তি। এ যুদ্ধে জার্মানীর নেতৃত্বাধীন বাহিনী পরাজিত হয়। ১৯১৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত চলে এই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ যা বিশ্বের ইতিহাসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। অবশেষে ১৯১৯ সালের ১০ই জানুয়ারি ভার্সাই চুক্তির মাধ্যমে শেষ হয় এই যুদ্ধ। দীর্ঘস্থায়ী এই যুদ্ধে ৮৫ লাখ লোক নিহত হয় এবং দুই কোটি দশ লাখ লোক মারাত্মকভাবে আহত হয়। প্রকৃতি আমাদের কেন ক্ষমা করবে আমরা যখন এভাবে একে অপরের বিরুদ্ধে ধ্বংসের খেলায় যখন মেতে উঠি?
এ যুদ্ধ শেষ হবার বিশ বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৯ সালের ১লা সেপ্টেম্বর জার্মানী পোলান্ড আক্রমণ করে বসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরাজয় ও অপমানের প্রতিশোধ নিতে। শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এ যুদ্ধে জাপান জার্মানীর পক্ষে অবস্থান নেয়। জার্মানী, জাপান, ইটালি, রোমানিয়া ও বুলগেরিয়াকে নিয়ে গড়ে ওঠে অক্ষ শক্তি। অপরদিকে আমেরিকা, বৃটেন, ফ্রান্স, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, নরওয়ে ডেনমার্ককে নিয়ে গড়ে ওঠে মিত্রশক্তি। টানা ছয় বছরের যুদ্ধে জাপান, জার্মানী ইটালির নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তি পরাজিত হয়। কিন্তু জাপান আত্মসমর্পন করতে বিলম্ব করায় জাপানকে সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনার জন্ম দেয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা।
মার্কিন বোমারু বিমান বি-টুয়েন্টি নাইন ইনোলা গে ‘লিটল বয়’ নামে একটি পারমাণবিক বোমা হিরোশিমার ওপর বর্ষন করে ১৯৪৫ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮ টা ১৫মিনিটে। হিরোশিমা শহর থেকে ৫০০ মিটার ওপরে সেটি বিস্ফোরিত হলে মুহুর্তের মধ্যে শহরটির প্রায় ষাট শতাংশ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়, সাথে সাথে নিহত হয় ৭৫হাজার মানুষ। মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে তিনিয়ন দ্বীপ থেকে বি-টুয়েন্টি নামে একটি বিমান দ্বিতীয় বোমাটি নিয়ে নাগাসাকির উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ বোমাটির নাম দেয় হয়েছিল ’ফ্যাটম্যান’। বোমাটি ছিল গোলাকার প্লুটোনাম ক্ষেপনাস্ত্র যা লম্বায় ছিল ৪ মিটার এবং ব্যস ছিল ২ মিটার। নাগাসাকি শহরে ৯ই আগস্ট রাতে ঘুমন্ত মানুষদের ওপর নিক্ষেপ করা হয় এই অভিষপ্ত বোমা। মাটি থেকে ৫০০ মিটার ওপরে। নিমিষে ঝরে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার প্রাণ। বোমার তেজস্ক্রিয়তায় শিশুদের মাথার চুল পর্যন্ত উঠে যায়। শিশুরা খাওযার শক্তি হারিয়ে ফেলে। আর বোমার আঘাতে আহতরা দীর্ঘদিন কষ্ট ভুগতে ভুগতে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরে। ১৯৫০সাল পর্যন্ত মৃত্যের সংখ্যা দেড়লাখে পৌঁছেছিল।
হিরোশিমায় বোমা বিস্ফোরনের স্থানটি ছিল বাণিজ্যিক ও অফিস আদালতের স্থান। বিস্ফোরণের সাথে সাথে ৫০০ মিটার বৃত্তের মাঝে সুরম্য অট্টালিকাগুলো চোখের পলকে নেতিয়ে পড়ে। ৫বর্গমাইল এলাকা ছাই ও ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। বিস্ফোরনের সময় নগরীতে লোকসংখ্যা ছিল তিন লক্ষ পঞ্চাশ হাজার। মার্কিন একটি গবেষণায় দেখানো হয় যে, ১৫-২০ শতাংশ বিকিরণ অসুস্থতা, ২০-৩০শতাংশ ফ্লাশ পোড়া ও অন্যান্য আঘাত থেকে, ৫০-৬০ শতাংশ অসুস্থতা দ্বারা মারা গেছে। তাই হিরোশিমা-নাগাসাকি দিবস উপলক্ষে আমাদের প্রত্যাশা গোটা পৃথিবী থেকে পারমাণবিক বোমা নির্বাসিত করা হোক, নিশ্চিত হোক অস্ত্রের ঝনঝনানিমুক্ত নির্মল পৃথিবী।
বোমার তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে হিরোশিমা আর নাগাসাকির মতো মানুষকে যেন মৃত, পঙ্গুত্ববরণ ও বিকলাঙ্গ হতে না হয়। কিন্তু কে করবে এই কাজটি? শক্তি ও ক্ষমতা সব দেশে এবং গোটা পৃথিবীতে কুক্ষিগত থাকে শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ, অসৎ ও অসাধু মানুষদের হাতে। তারাই দেশের অভ্যন্তরে এবং দেশের বাইরে ঘটিয়ে চলে দ্বন্দ, সংঘাত, যুদ্ধ ও মানবকল্যাণ বিমুখী যত কাজ-কারবার। তাই, আমাদের শিশুদের ও শিক্ষার্থীদের শেখাতে হবে কিভাবে মানুষকে ভালবাসতে হয়, স্রষ্টার সৃষ্টিকে ভালবাসতে হয়, দ্বন্দ-সংঘাতের অশুভ পরিণামের কথা শিশুদেরকে পরিবারে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শেখাতে হবে। শিক্ষার আসল উদ্দেশ্যই হচেছ মানুষের কল্যাণ করা, বিশ্বের কল্যাণ সাধন করা, মানুষকে প্রকৃত অর্থে ভালবাসা, প্রকৃতিতে ভালবাসা। এই শিক্ষা যেন আমরা সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সব ধরনের শিক্ষার্থীদের দিতে পারি সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে খেয়াল রাখতে হবে।
১৯৪৯ সালে হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি পার্ক নির্মান করা হয়, হিরোশিমা প্রিফেকচারাল শিল্প উন্নয়ন হল, জেনবাকু বা পরমাণু অট্টালিকা নির্মান করা হয়, হিরোশিমা শান্তি স্মৃতি জাদুঘর ১৯৫৫ সালে নির্মান করা হয়। ১৯৪৯ সালে জাপানি পার্লাামেন্ট দ্বারা হিরোশিমাকে শান্তি শহর ঘোষণা করা হয়। জাপানের নাগাসাকি শহরে স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪৭মিনিটে বোমা বর্ষণ করা হয় তখনই সবাই গভীর ঘুমে বিভোর। সেই ঘুম থেকে অনেকেই চিরনিদ্রায় চলে গিয়েছে। প্রতিবছর যখনই ৬ ও ৯ আগস্ট ফিরে আসে জাপানীরা মনে করে মার্কিনের সেই নির্মমতার কথা, তারা কোনদিন ভুলতে পারবেনা এই নিষ্ঠুরতার কথা।
৬৭ বছর পরেও তারা বোমার তেজস্ক্রিয়তার ধকল বয়ে চলেছে। এই ধরনের ঘটনা যেন পৃথিবীর ইতিহাসে আর না ঘটে সেজন্য সকল বিবেকবান, শান্তিপ্রিয় ও সুশিক্ষিত মানুষদের অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে কারণ অমানুষরা যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলার জন্যই প্রষÍত থাকে, তারা এই মাদকতায় আসক্ত। নিউক্লিয়াস ক্লাবের সর্বাধিনায়ক হচেছ যুক্তরাষ্ট্র। তার বাসনা ও কামনা হচেছ বিশ্বে তিনি ছাড়া আর কেউ যাতে নিউক্লিয়ার বোমার অধিকারী হতে না পারে। ইরাকের কাছে নিউক্লিয়ার বোমা তৈরির সরঞ্জাম আছে এই অযুহাতে ইরাকে প্রবেশ করে শুধু দেশটিকে নয় গোট মধ্যপ্রাচ্যকে গুলিয়ে দিয়েছে তাদের সব হিসেবে নিকেশ। তার ধকল সইতে হবে আরও কয়েক যুগ।
যুদ্ধ ধ্বংসযজ্ঞের পাহাড় গড়ে তোলে, হানাহানির তীব্রতাকে আরও বাড়িয়ে তোলে, মানুষ হারিয়ে ফেলে মানবতা। বিশ্বের শান্তিকামী মানুষ নিরাপদে জীবন যাপন করতে চায়। আণবিক বোম মানব জাতির জন্য আিভশাপ। এ বোমার ভয়াবহতা বর্ণনাতীত। এই বোমা আর যাতে পৃথিবীতে বিস্ফোরিত না হয় সে জন্য বহু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের আণবিক শক্তিকে কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় আই এ ইএ -যার গুরুত্বপূর্ন প্রস্তবনাগুলোর মধ্যে হচেছ- পরমাণু শক্তিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কাজে লাগাতে হবে, অস্ত্র তৈরির কাজে নয়।
আই এইএ র চুক্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে সকল পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্রকে। দক্ষিণ আফ্রিকা ও আলবেনিয়া পরমাণু অস্ত্রের অধিকারী হয়েও তারা ধ্বংস করে দেয় তাদের পারমানবিক স্থাপনা, তাদের মতো ইতিহাস সৃষ্টি করে মানবতাকে রক্ষা করতে হবে সব আণবিক শক্তির অধিকারী দেশগুলোকে। আজও বিশ্বের লক্ষ কোটি শিশু অনাহারে –অর্ধাহারে দিন কাটায়, না খেয়ে ঘুমোতে যায়, বিনা চিকিৎসায় মারা যায় আর যুদ্ধবাজরা কোটি কোটি ডলার ব্যয় করে সামরিক খাতে, অস্ত্র ও যুদ্ধ বিমান ক্রয়খাতে। উদ্দেশ্য নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখা লক্ষ-কোটি নিরীহ মানুষের জীবন সংহারের মাধ্যমে। আসুন এগুলো নির্বাসনে দিয়ে বিশ্বের লক্ষ কোটি নিরন্ন মানুষদের মুখে খাবার তুলে দেই, অসহায় মানুষদের মুখে হাসি ফোটাই, দুস্থদের পাশে দাঁড়াই চিকিৎসা সরঞ্জাম নিয়ে, সত্যিকারের ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দিই সকল অসহায় মানুষদের দিকে।
মাছুম বিল্লাহ: ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।