বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষা স্তরে ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে, যা ২০২৬ সালের মধ্যে ৪ দশমিক ১ মিলিয়নে উন্নীত হবে বলে আশা করা যায়। বলাবাহুল্য, শিক্ষায় বিনিয়োগ অন্য যে কোন সেক্টরের তুলনায় সর্বদাই অর্থবহ। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ সৃষ্টি।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান আগের তুলনায় কমেছে এটা আমরা মুখে না বললেও আমাদের সামনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ সিনেট অধিবেশনের বাজেট বক্তৃতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশকিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সান্ধ্যকালীন কোর্স নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছিলেন। তার মতে, এসব কোর্সে কখনও কখনও ভর্তি পরীক্ষা ছাড়াই নিম্নমানের শিক্ষার্থী ভর্তি করার অভিযোগ রয়েছে। সিনেট সভায় তিনি সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এই কোর্সের মাধ্যমে শুধু ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল ও অর্থ লাভের আশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অসংখ্য নিম্নমানের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করছে। এর মাধ্যমে একশ্রেণীর শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম ক্ষুণœ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যও অনুরূপ মন্তব্য করে বলেছিলেন : ‘বিশ্ববিদ্যালয় কোন অবস্থাতেই বাণিজ্যকেন্দ্র নয়। এটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।’
উল্লেখ্য, বহির্বিশ্বের ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষার গুণগতমান বিচারে বেশ ক’বছর আগে থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অপরাপর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে কোন কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়কে পছন্দের তালিকায় শীর্ষে রাখছে। যদিও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক ব্যবস্থা নিয়েও নানা প্রশ্ন সমাজে বিদ্যমান রয়েছে। এটা ঠিক যে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে নিত্যনতুন বিভাগ খোলার পরিবর্তে বিদ্যমান বিভাগগুলোকে যুগোপযোগী শিক্ষার আওতায় আনা অধিক জরুরী। বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও অধিকতর গবেষণাক্ষেত্র তৈরি করারও কোন বিকল্প নেই। অভিভাবকরা প্রত্যাশা করেন শিক্ষকম-লী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অতিরিক্ত সময় না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়কে আরও খানিকটা সময় দিয়ে এর মানোন্নয়নে যথাযথ ভূমিকা রাখবেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে গবেষণা করেছেন ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার পিএইচডি গবেষক ম্যাট হুসেইন। তার গবেষণার ফল হলো বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মানসম্মত শিক্ষা দিতে পারছে না। বহুবিধ কারণের একটা হলো তারা ‘রিকশা-ফ্যাকাল্টি’ অর্থাৎ রিকশা-চেপে এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটতে থাকা শিক্ষকদের মাধ্যমে ‘জম্বি’ শিক্ষার্থী তৈরি করছে। ম্যাট হুসেনের পরিভাষায় জম্বি শিক্ষার্থী মানে যেসব শিক্ষার্থীর ‘বিশ্লেষণী ক্ষমতা’ নেই এবং ‘দর্শনের বা দার্শনিকতার দৈন্য’ রয়েছে।
এমন একটি বাস্তবতায় বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য সচেষ্ট হয়েছেন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্যরা। তারা এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সহযোগিতা চাইলেন। বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় উপাচার্যরা সহযোগিতা কামনা করে বলেছেন, শিক্ষকদের বিশেষ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হবেন। এতে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধি এবং উৎকর্ষ সাধিত হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান করছেন তারা কতটা মান বজায় রাখতে সমর্থ হচ্ছেন? তারা কি প্রত্যাশা অনুযায়ী তাদের দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট রয়েছেন? দেশ ও জাতির কল্যাণে নতুন জ্ঞান সৃজন ও তা বিতরণের জন্য বিশ^বিদ্যালয় শিক্ষকদের আরও বেশি গবেষণায় মনোনিবেশ করার আহ্বান জানিয়েছেন ইউজিসি চেয়ারম্যান। আমরা মনে করি, এই আহ্বান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। শ্রদ্ধেয় শিক্ষকসমাজ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করলে উচ্চশিক্ষার উৎকর্ষ সাধন হবেÑ এমনটি নিশ্চয়ই আমরা আশা করতে পারি।
সৌজন্যে: জনকণ্ঠ