উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অনিয়ম চলছে উন্মুক্তভাবেই। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৌশল শাখার নিম্নমানের কাজ। পুরো প্রশাসনে জামায়াত-শিবির কর্মীদের আধিপত্য। পছন্দের লোক ছাড়া অন্যদের কাজের বিল কাটা। জামায়াত-বিএনপির লোকদের বিশেষ সুবিধাজনক স্থানে রাখা। বিভিন্ন কর্মকর্তার বাসায় সরকার বিরোধী গোপণ বৈঠক করাসহ নানা অভিযোগ আছে।
এসব কিছু জানার পরও বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য ড. এম এ মান্নানের রহস্যজনক আচরণে ক্ষুব্ধ সাধারণ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন একটি কাঠামোর ছাদ ধসে পরার ঘটনার ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করে এখন প্রশাসনের তোপের মুখে আছেন একজন কর্মকর্তা। নির্মাণাধীন কাঠামোর ছাদ ধসে পরার দুটি ভিডিওচিত্র দৈনিক শিক্ষার হাতে রয়েছে।
গাজীপুরের বোর্ড বাজার এলাকায় ৩৫ একর জমির ওপর অবস্থিত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ক্যাম্পাস। এছাড়াও সারাদেশে এর ১২টি আঞ্চলিক কেন্দ্র ও ৮০টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র, ১ হাজার ৪৭৮টি স্ট্যাডি সেন্টার আছে। যার অধিকাংশেরই শীর্ষ পদে আছেন জামায়াত বিএনপিপন্থী কর্মকর্তারা। ফলে সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ড এখানে অনেকটাই ওপেন সিক্রেট।
এক বছর আগে মাহফুজুর রহমান নামের অর্থনীতির এক শিক্ষকের বাসায় জঙ্গী তৎপরতার গোপণ বৈঠকে হানা দিয়েছিলো র্যাব। রাত তিনটায় ওই বাসা থেকেই আটক করা হয় কয়েকজন বহিরাগত জামায়াত-বিএনপিপন্থী লোককে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিষয়টি ধামাচাপা দেয়। উপাচার্য বলছেন, শুনেছেন আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর লোক ধরে নিয়ে গেছে। কিন্ত কেউ কোনো অভিযোগ না করায় তিনি কোন ব্যবস্থা নিতে পারেননি। একই বছর ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি নেতা রিজভী আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন শিক্ষক অধ্যাপক আবু তালেব, অফিসার শরীফ শাহবুদ্দিন, সোহেল আহম্মেদ, খালিদসহ আরও কয়েকজন।
গাজীপুর ও সাভার এলাকার বিএনপি-জামায়াতের নানা অপকর্মের একাধিক গোপন বৈঠক উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কর্মকর্তার বাসা ও অফিস কক্ষে অনুষ্ঠিত হয় বলেও অভিযোগ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রেজারের উত্তরার বাসায়ও বিভিন্ন সময় গোপণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে অভিযোগ আছে। গত বছরের শুরুর দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ড. আবু তালেবের ব্যক্তিগত একটি ব্যাংক হিসেবে মোটা অংকের টাকার লেনদেন নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
তবে ট্রেজারার বলছেন তার কিছু বিদেশী বৃত্তির টাকায় ওই হিসেব খোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ কনভোকেশনের সময় স্যুভেনিয়রের জন্য ঠিকাদার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে টাকা আদায় করার অভিযোগের বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি জানান, রেজিস্টার একটি হিসেবে খুলেছিলেন। তিনি যতদুর জানেন নিজস্ব অর্থায়নে স্যুভেনির করা হয়েছে। তাহলে কেন একটি পৃষ্ঠায় প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠানের কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা হয়তো সামান্য কিছু সহযোগিতা করেছিলো। তবে এখন বিষয়টি সঠিক ভাবে মনে নেই তার।
এদিকে কনভোকেশনের মালামাল সরবরাহকারী ঠিকাদার সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন একটি সংঘবদ্ধ চক্র উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে লুটপাটের রাজ্য কায়েম করেছে সেটা কাজ করতে গিয়েই টের পেয়েছেন তিনি। কনভোকেশনের সময় তার মালামাল বুঝে রেখে পরে তা অস্বীকার করে চক্রটি। অনুষ্ঠানের দিন সুন্দর হয়েছে বলে ভিসিসহ সবাই প্রসংশা করলেও বিল আনার ক্ষেত্রেই পাল্টে যায় চিত্র। বিভিন্ন শাখায় উৎকোচ না দেওয়া নানা অজুহাত দিয়ে তাকে ক্রয় মূল্যের চেয়ে কম বিল পরিশোধ করা হয়। উপাচার্যকে বিষয়টি জানানে তিনি কোনো তদন্ত না করেই সাফাই গাইতে থাকেন দুষ্ট চক্রের পক্ষে। মালামাল নিম্নমানের হলে কেন গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে উপাচার্য বলেন, কনভোকেশন সামনে তাই যা দিয়েছে তা দিয়েই কাজ চালানো হয়েছে। এছাড়া কিছুই করার ছিলো না।
এদিকে একাধিক সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকৌশল শাখা নিম্নমানের কাজ ও অতিরিক্ত বরাদ্দের বিষয়ে বেশ দক্ষ। চলতি মাসের শুরুর দিকে এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশনা, মুদ্রণ ও বিতরণ বিভাগের নির্মাণাধীন সম্প্রসারিত ভবনের ছাদ ধসে পরে। বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে উপাচার্যসহ পুরো প্রশাসন। একজন কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিষয়টি প্রকাশ করায় এখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি। নির্মাণাধীন ছাদ ধসে পরার চিত্র ও ভিডিও চিত্র থাকার পরও সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে ফেইসবুকে পোস্ট দেওয়া কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটি গঠন করায় বিষ্মিত সাধারণ কর্মকর্তা কর্মচারীরা।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. এম এ মান্নানের কাছে ছাদ ধসের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তেমন কিছুই না। কোনো ছাদ ধসে পরেনি। সাটারিংয়ের একটি বাঁশ খসে সরে গিয়েছিলো। তবে তিনি প্রথমে বিষয়টিকে কিছুই না বললেও দৈনিক শিক্ষার হাতে স্থির চিত্র ও ভিডিও থাকার কথা জানালে বলেন, প্রো-ভিসি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন। তিনি পুরো বিষয়টি বলতে পারবেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল শাখার নির্বাহী প্রকৌশলী এস এম রেজাউল ইসলাম বলেন, একটি করিডোরের ছাদের ঢালাইয়ের সময় কিছু কংক্রিট পরে গেছে। যা ঘটেছে তা তেমন বড় কিছুই না। বিভিন্ন আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র নির্মাণে অনিয়ম ও অতিরিক্ত বরাদ্দের অভিযোগের বিষয়ে জানাতে চাইলে তিনি বলেন, তার আমলে কোনো অনিয়ম হয়নি। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে হলে সেই বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না।
রেজাউল জানান, ছাদে ধসে পরা ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপচার্যকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি সাত দিনের মধ্যে নির্মাণাধীন কাঠামোর ছাদ ধসে পরার বিষয়ে প্রতিবেদন দিবেন। এর আগে তিনি আর কোনো কথা বলবেন না।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্মাণাধীন কাঠামোর ছাদ ধসে পরার বিষয়ে পোস্ট ও ছবি দেওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারারকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটি দেওয়ান নূর ইয়ার চৌধুরী নামের ফেসবুক আইডিতে দেওয়া পোস্ট এর বিষয়ে তদন্ত করবে। ফেসবুক আইডিধারীর কাছ থেকে প্রমাণ সংগ্রহ পূর্বক কমিটিকে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নিয়োগ দেওয়া ভিসি আসার পর তারা আশা করেছিলেন অবস্থার পরিবর্তন হবে। কিন্তু কিছুই হলো না। ভিসি জামায়াত-বিএনপির লোকদের বেশী সুবিধা দিয়ে ভালো ভালো অবস্থানে রাখছেন। এমন অভিযোগের বিষয়ে উপাচার্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, এখনো উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮০ ভাগ লোক জামায়াত বিএনপির। এদের কন্ট্রোলের মধ্যে রেখেই তাকে কাজ চালিয়ে নিতে হচ্ছে।
পরবর্তী কিস্তি : ‘কোটি টাকার টাইলস’