এবার এসএসসির ফলে গণিত ও ইংরেজিতে বিপরীতমুখী অবস্থান - দৈনিকশিক্ষা

এবার এসএসসির ফলে গণিত ও ইংরেজিতে বিপরীতমুখী অবস্থান

মাছুম বিল্লাহ |

আনন্দের মধ্যে দিয়ে ঘোষিত হলো ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের এসএসসি পরীক্ষার ফল। শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে যারা কাক্সিক্ষত ফল লাভ করেছে তারা নেচে গেয়ে তাদের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছে। এবার পাসের হার বেড়েছে, তবে গত ছয় বছরের মধ্যে এবারই প্রথম আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডে জিপিএ-৫ প্রাপ্তি লাখের নিচে নেমে গেছে। চতুর্থ বিষয়ের নম্বর এবার যোগ না হওয়ায় অনেকেই কাক্সিক্ষত ফল পায়নি। গতবারের চেয়ে পাসের হার বেড়েছে সাড়ে চার শতাংশ, তবে জিপিএ-৫ প্রাপ্তিতে ধস নেমেছে। সারাদেশে জিপিএ-৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী কমেছে পাঁচ হাজার ৩৫ জন।
 
প্রতিবছরই এসএসসির মতো পাবলিক পরীক্ষা অনন্য কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নেই। যেমন এ বছর প্রকাশিত ফলে দেখা যায় অংশগ্রহণ ও পাসের হারে মেয়েরা এগিয়ে আছে। ছাত্রের তুলনায় ১ দশমিক ৫৩ শতাংশ ছাত্রী বেশি পাস করেছে। ছাত্রের তুলনায় ৫২ হাজার ৬৯২ জন বেশি ছাত্রী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এবং ৫৬ হাজার ৬৩৩ জন ছাত্রী বেশি পাস করেছে। 

এ বছর আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে মাধ্যমিকের টেস্ট পরীক্ষায় যারা অকৃতকার্য হয়েছিল তারা  কড়াকড়ির কারণে বোর্ড পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি। দেশের খ্যাতনামা কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যারা টেস্ট পরীক্ষাগুলো অত্যন্ত কঠিন ও কড়াকড়ির মধ্যে নিয়ে থাকে। সেখানে যারা ফেল করে তাদেরকে প্রতিষ্ঠানের সুনাম রক্ষার্থে বোর্ড পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে দেয়া হয় না। এভাবে স্কুলগুলো সুনাম অর্জন করার চেষ্টা করে। বিষয়টি এবার জাতীয় ক্ষেত্রেও ঘটেছে। অর্থাৎ বিদ্যালয়ে টেস্ট পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীদের পাবলিক পরীক্ষায় অংশ নিতে দেয়া হয়নি। ফলে, অকৃতকার্য শিক্ষার্থীর সংখ্যা আরও কমেছে। এ রকম ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল সাড়ে পাঁচ লাখ। এটি কতটা আনন্দের আর কতটা যুক্তির কথা সেটি অবশ্য ভেবে দেখার সময় হয়েছে। কারণ কিছু বিষয়ের শিক্ষক ও বিদ্যালয় প্রশাসন চতুর ও দুরন্ত শিক্ষার্থীদের কায়দা করে টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়ে পরীক্ষা দিতে দেয় না। এ রকম ঘটনা কোথাও ঘটেছে কিনা তা খুঁজে দেখা প্রয়োজন। 

মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্রছাত্রীরা গণিতের কঠিন প্রশ্নে এবার ধরাশায়ী হয়েছে। সিলেট বোর্ডের প্রায় ২৫ শতাংশ পরীক্ষার্থী অকৃতকার্য হয়েছে গণিতে। বরিশাল বোর্ডের ১৯ শতাংশ, ঢাকা বোর্ডের ১৫ শতাংশ শিক্ষার্থী গণিতে ফেল করেছে। গণিতের প্রশ্ন পদ্ধতি সৃজনশীল হওয়ায় সারাদেশে গণিত সেভাবে পড়ানোর মতো উপযুক্ত শিক্ষকের অভাব পরিলক্ষিত হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে পরীক্ষার ফলে। এ ধরনের মন্তব্য করেছেন কিছু শিক্ষক এবং শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ। 

এবার গণিতের প্রশ্নে অবশ্য উদাহরণ থেকে অঙ্ক এসেছে যা অনেক শিক্ষার্থী করে না, তারা নোট ও গাইড বইয়ের অঙ্ক করে। তার অর্থ এই নয় যে, প্রশ্ন কঠিন হয়েছিল। বরং বলা যায় শিক্ষার্থীরা গণিতের মূল বিষয় বা বেসিক বিষয় শেখে না বা শেখানো হয় না বলে এই অবস্থা হয়েছে। এবার সারাদেশে ফেল করেছে তিন লাখ ৭৮ হাজার ৬৫০ জন। এর মূল কারণ গণিতের ফল খারাপ হওয়া। এদের প্রায় দুই লাখ শিক্ষার্থী মানবিক বিভাগের। বিজ্ঞান বিভাগে পাস করেছে ৯৪ দশমিক ৭২ শতাংশ শিক্ষার্থী, ব্যবসায় শিক্ষা ৮৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। কিন্তু মানবিক বিভাগে পাস করেছে মাত্র ৭৪ দশমিক ৩২ শতাংশ। ফলে মানবিক বিভাগে ফল বিপর্যয় ঘটেছে, যার ধাক্কা লেগেছে সার্বিক ফলাফলে। মানবিক বিভাগে এত বিশাল অঙ্কের শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়ার কারণও খুঁজে বের করা দরকার। 

অনেক শিক্ষক এবং বোর্ড চেয়ারম্যানরা বলেছেন যে, ইংরেজি প্রশ্ন এবার ভালো হওয়ায় সারাদেশেই এ বিষয়ের ফল ইতিবাচক হয়েছে। সব বোর্ডেই ইংরেজিতে পাসের হার ৯০ শতাংশের বেশি। পাসের হারে দেশের শীর্ষে থাকা রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৮ দশমিক ১৬ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে রাজশাহী বোর্ডের এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা প্রায় শতভাগই ইংরেজিতে দক্ষ। তারা ইংরেজি শুনে বুঝতে পারে, ইংরেজিতে সহজেই ভাব আদান-প্রদান করতে পারে, তারা ইংরেজিতে লেখা তাদের শ্রেণি অনুযায়ী যে কোনো লেখা পড়ে তার মর্মোদ্ধার করতে পারে এবং তাদের পরিচিত যে কোনো বিষয়ের ওপর শুদ্ধ ইংরেজিতে কোনো প্রবন্ধ বা রচনা লিখতে পারে। তাদের ক্ষেত্রে আসলে ঘটনা কি তাই? একইভাবে মাদরাসা শিক্ষা বোর্ডে ইংরেজিতে পাসের হার ৯৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ, আর কারিগরি শিক্ষা বোর্ডে তা ৯৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ইংরেজির এই নম্বর সিরিয়াসলি গবেষণার দাবি রাখে। আমি প্রায় প্রতিমাসেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বেড়াই, বিদ্যালয়ে যাই, শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলি। তাদের ইংরেজির যে অবস্থা তাতে বিশাল প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে যে, ইংরেজিতে তারা এত নম্বর কীভাবে পায়? দশম শ্রেণির একটি ক্লাসে একশত বা একশতের কাছাকাছি শিক্ষার্থী কেউই যখন ইংরেজিতে বলতে পারে না ‘আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি/আমরা দশম শ্রেণিতে একশত ছাত্রছাত্রী আছি/আমি প্রতিদিন স্কুলে আসি/আমি গতকাল স্কুলে আসিনি’ তাহলে আমরা তাদেরকে কীভাবে মূল্যায়ন করলাম? এসব প্রশ্ন অতি সম্প্রতি আমি শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম। কেউই উত্তর দিতে পারেনি। ইংরেজি শেখানোর যে উদ্দেশ্য, যে শিখণ ফল শিক্ষার্থীদের অর্জন করার কথা তা যখন করতে পারছে না তাহলে আমরা কিসের ওপর ভিত্তি করে এ ধরনের গ্রেডিং করছি? কেন এটি করছি?

গত দুই বছর ধরে উত্তরপত্র মূল্যায়নে পরিবর্তন এনেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। পরীক্ষকদের খাতা দেয়ার আগে প্রশিক্ষণ জোরদার করা হয়েছে। সেখানে তাদের একটি করে মডেল উত্তরপত্রও সরবরাহ করা হয় যাতে সবাই কাছাকাছি নম্বর দিতে পারেন। এগুলো নিঃন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিট বা বেডু উত্তরপত্র মূল্যায়ন যাতে সঠিকভাবে হয় সেই উদ্দেশ্যে কাজ করে যাচ্ছে। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আমাদের দেশের কত শতাংশ শিক্ষক এখনও টেস্টিং ইলিটারেসিতে ভুগছে সেটি কীভাবে দেখা হবে বা হচ্ছে। এই বিষয়টি মিনিমাইজ হবে কবে? 

পাসের হারের এই চিত্র প্রাথমিকভাবে আমাদের তো আনন্দিত করেই। কিন্তু এর পেছনে বা গভীরের সত্যও কি তাই? এসএসসি পরীক্ষায় এ বছর (২০১৯) আটটি সাধারণ শিক্ষা বোর্ডের পাসের হার ৮২ দশমিক ৮০ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৯৪ হাজার ৫৫৬ জন শিক্ষার্থী। আটটি সাধারণ বোর্ড, মাদরাসা এবং কারিগরি বোর্ড মিলিয়ে পাসের হার ৮২ দশমিক ২০ শতাংশ। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় ১০ শিক্ষা বোর্ডের গড় পাসের হার ছিল ৭৭ দশমিক ৭৭ শতাংশ। দশ বোর্ডে পাস করেছিল ১৫ লাখ ৭৬ হাজার ১ শত ৪ জন। গতবছরের তুলনায় এ বছর পাসের হার বেড়েছে ৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ। তবে জিপিএ-৫ কমেছে। এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার ৫৯৪ জন, যা গত বছর ছিল ১ লাখ ১০ হাজার ৬ শত ২৯ জন। মাদরাসা বোর্ডের অধীনে দাখিল পরীক্ষায় পাসের হার ৮৩ দশমিক ০৩ শতাংশ। গত বছর ছিল ৭০ দশমিক ৮৯ শতাংশ, অর্থাৎ বেড়েছে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। কারিগরিতে পাসের হার ৭২ দশমিক ২৪ শতাংশ। গত বছর ছিল ৭১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। পাসের হার বেড়েছে শূন্য দশমিক ২৮ শতাংশ। জিপিএ-৫ পেয়েছে ৪ হাজার ৭৫১ জন। 

ঢাকা বোর্ডে পাসের হার ৭৯ দশমিক ৬২ শতাংশ। রাজশাহী বোর্ডে পাসের হার ৯১ দশমিক ৬৪ শতাংশ। কুমিল্লা বোর্ডে পাসের হার ৮৭ দশমিক ১৬ শতাংশ। যশোর বোর্ডে পাসের হার ৯০ দশমিক ৮৮ শতাংশ। চট্টগ্রাম বোর্ডে পাসের হার ৭৮ দশমিক ১১ শতাংশ। বরিশাল বোর্ডে পাসের হার ৭৭ দশমিক ৪১ শতাংশ। সিলেট বোর্ডে পাসের হার ৭০ দশমিক ৮৩ শতাংশ। দিনাজপুর বোর্ডে পাসের হার ৮৪ দশমিক ৪১ শতাংশ। এ বছর মোট পরীক্ষার্থী ছিল ২১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬৪ জন। এর মধ্যে মেয়ে পরীক্ষার্থী ১০ লাখ ৬৬ হাজার ২৭৫ জন এবং ছেলে ১০ লাখ ৭৩ হাজার ২৮৯ জন। অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ২১ লাখ ২৭ হাজার ৮১৫ জন। তার মধ্যে ছাত্র ১০ লাখ ৬৮ হাজার ৫২৭ জন এবং ছাত্রী ১০ লাখ ৫৯ হাজার ২৮৮ জন। পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল ১১ হাজার ৭৪৯ জন। তার মধ্যে ছাত্র ৪ হাজার ৭৬২ এবং ছাত্রী ৬ হাজার ৯৮৭ জন। উত্তীর্ণ পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ১৬৫ জন। এর মধ্যে ছাত্র ৮ লাখ ৬৬ হাজার ৯৪১ এবং ছাত্রী ৮ লাখ ৮২ হাজার ২২৪ জন। অকৃতকার্য পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৬৫০ জন। এর মধ্যে ছাত্র ২ লাখ ১ হাজার ৫৮৬ জন এবং ছাত্রী ১লাখ ৭৭ হাজার ৬৪ জন। যশোর বোর্ডে গত বছর পাসের হার ছিল ৭৬ দশমিক ৬৪ শতাংশ, যা এবার হয়েছে ৯০.৮৮ শতাংশ। এই পাসের হার আন্তর্জাতিক পরীক্ষা পদ্ধতির সাথে কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ তা কি আমরা ভেবে দেখেছি? প্রোগ্রাম ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্স অ্যাসেসমেন্ট বা পিসার মানদ-ে আমরা কোথায় অবস্থান করছি?

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত 

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044891834259033