চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন ছাত্রকে জেএমবি সদস্য হিসেবে গ্রেপ্তারের পর জঙ্গি সংগ্রহ কার্যক্রম সম্পর্কে নতুন তথ্য জানা গেছে। শুধু ছাত্রদের নয়, বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদেরও জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ তথা জেএমবিতে যোগ দেওয়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কিছু ছাত্রী যোগও দিয়েছে।
চট্টগ্রামে গ্রেপ্তারকৃত তিন জঙ্গির একজন নাইম শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরে তিনি জেএমবিতে যোগ দেন। তাঁর মাধ্যমেই অন্য দুজন জেএমবিতে নাম লেখান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আরো কয়েকজন জেএমবির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে বলে জানতে পেরেছেন গোয়েন্দারা। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থীদের জেএমবিতে যোগদান আতঙ্কের বিষয়। এ কারণে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। এখনই পারিবারিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কাউন্সেলিং শুরু করতে হবে।
গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত তিন জেএমবি সদস্য সেনাবাহিনীর পোশাক পরে প্রাণঘাতী হামলার পরিকল্পনা করছিলেন। তদন্তের স্বার্থে হামলার স্থানের কথা জানাননি সংশ্লিষ্টরা। তিনজনের মধ্যে নাইম আগে শিবির করতেন। অন্য দুজন জানান, ইসলামের যোদ্ধা হিসেবে তাঁরা জীবন বিসর্জন দিতে জেএমবিতে যোগ দেন। সারা দেশে সাত-আটজন জঙ্গি নেতা জেএমবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বর্তমান আমির সোহেল মাহফুজ বিদেশ থেকে অর্থ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে জেএমবি পরিচালনা করছেন।
যেভাবে উত্থান ঘটেছে : গ্রেপ্তারকৃত জঙ্গিরা জানান, ২০০৭ সালে শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাইসহ ছয়জনের ফাঁসি হওয়ার পর জেএমবিতে ফাটল ধরে। ২০০৯ সাল থেকে তারা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা চালায়। প্রধান করা হয় মাওলানা সাইদুর রহমানকে। ২০১০ সালে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলে আবারও হোঁচট খায় জেএমবি। পরে সোহেল মাহফুজ দায়িত্ব নিয়ে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে থাকেন; নতুন সদস্য সংগ্রহ শুরু করেন।
র্যাবের গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, ‘জেএমবির অনেক সদস্য পলাতক রয়েছে। তারাই মাঝেমধ্যে নাশকতা করে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে তারা কমান্ডহীন হয়ে পড়েছে। শিগগিরই নেতৃস্থানীয়দের আমরা ধরে ফেলতে পারব বলে আশা করছি।’
র্যাব জানায়, দেশে জঙ্গিবাদের উত্থানের পর থেকে এ পর্যন্ত এক হাজার ১৬৮ জন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। শুধু এ বছর গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫৯ জনকে।
বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ : পুলিশ সূত্র জানায়, দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে জঙ্গিদের পেছনে। চট্টগ্রামে যে তিন জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁদের ব্যবহারের জন্য একটি মাইক্রোবাস ও একটি মোটরসাইকেল কিনে দেন জেএমবির নেতারা। তাঁদের সেনাবাহিনীর পোশাক এবং অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্রও সংগ্রহ করে দেওয়া হয়। সব মিলিয়ে তাঁদের পেছনে ২৫ লাখ টাকা খরচ করেছে জেএমবি। শুধু চট্টগ্রামেই নয়, সারা দেশেই জঙ্গিদের হাতে টাকা আসছে, কোটি কোটি টাকা। এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, ‘কারা এই অর্থ জোগান দিচ্ছে, তা জানার চেষ্টা চলছে। দেশ থেকে আসছে নাকি দেশের বাইরে থেকে আসছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম পুলিশের গোয়েন্দা শাখার অতিরিক্ত উপকমিশনার (উত্তর) বাবুল আক্তার বলেন, ‘অন্য কারা এর সঙ্গে জড়িত, তা জানার চেষ্টা চলছে।’
দরকার হিতোপদেশ : এর আগে জঙ্গি হিসেবে মাদ্রাসার ছাত্র, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধরা পড়েছে। এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ধরা পড়ায় বিষয়টি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্ররা ছিলেন। তাঁদের অনেকে কারাগারে আছেন। কিন্তু জেএমবিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যোগ দেওয়ার বিষয়টি নতুন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এ সমস্যার সমাধান করতে পারবে না। তরুণদের কাউন্সেলিং (হিতোপদেশ) দরকার। সেটা পরিবার থেকে শুরু করে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হতে হবে।’
মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘জঙ্গিদের অধিকাংশ নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এ সুযোগটিই কাজে লাগাচ্ছে জঙ্গি নেতারা। আর্থিক সহায়তা, ক্যারিয়ার গঠন ও আন্তর্জাতিক সুবিধা পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে তাদের দলে টানা হচ্ছে।’ তিনি আরো বলেন, ‘যারা জঙ্গি দলে যোগ দিচ্ছে, তারা মাদকাসক্তদের মতো হয়ে যাচ্ছে। যাতে ধরা না পড়ে সে জন্য তারা পরিবার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করছে, বিচ্ছিন্ন করছে সহপাঠীদের কাছ থেকেও। শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে জঙ্গিবাদ দমন করা যাবে না। পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের কাউন্সেলিং করা দরকার।’
তিনজনের পূর্বকথা : সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃত নাইমুর রহমানের বাড়ি কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার পূর্ব সাঞ্জুয়ার ভিটা গ্রামে। তিনি নাগেশ্বরী কেরামতিয়া হাই স্কুলে মাধ্যমিক ও নাগেশ্বরী ডিগ্রি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর শিবিরের রাজনীতিতে নাম লেখান। কিছুদিন পর জেএমবিতে যোগ দেন। জেএমবিতে যোগদানের পর নিজের পড়ার খরচসহ সংগঠন চালানোর টাকা পেতে থাকেন মাসে মাসে। অনেক সহপাঠীকে জেএমবিতে সংশ্লিষ্ট করার চেষ্টা করেন। তিনি নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার উত্তর মোহাম্মদপুর গ্রামের ফয়সাল মাহমুদ ও কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলার গটিডাঙ্গা গ্রামের শওকত রাসেলকে যোগদান করাতে সক্ষম হন।