দেশে হরতাল কিংবা রাজনৈতিক অস্থিরতা অথবা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারনে স্কুলে ঠিক মতো ক্লাস হোক বা না হোক, শিক্ষার্থীরা টেবিলে বসে মনোযোগ দিয়ে পড়াশুনা করুক বা না করুক —পাবলিক পরীক্ষায় তাদের ফলাফল ভাল হয়ই !
আর এত ভাল ফলাফল কিভাবে হয়, আমি তার জন্য তথ্যানুসন্ধান করি ও কিছু কারন আবিষ্কার করি ।কারন সমূহ নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১) অবজেক্টিভ পরীক্ষা :
এ পদ্ধতিতে সহজেই পরীক্ষার খাতায় বেশী নম্বর পাওয়া যায় । পরীক্ষার হলে কয়েকজনের উত্তর সঠিক হলে অন্যরাও মিলে-মিশে সঠিক উত্তর দিতে পারে ! কারন উত্তর পত্রে বরাট বা টিক চিহ্ন দিলেই হলো, কারো ধরার উপায় নেই ! ফলে সকলের পরীক্ষা ভাল হয় । তবে এরকম ঘটনা দেশের সকল পরীক্ষা কেন্দ্রে ঘটে না ।
২) কম্যুনিকেটিভ ইংলিশ :
এ পদ্ধতিতে পরীক্ষার প্রশ্নেই উত্তর লেখার ব্যবস্থা আছে ।প্রিপজিশান, আর্টিকেল, ভোকাব্যুলারী, রি-এরেন্জ ইত্যাদি অল্প সময়েই উত্তর করে বিস্ময়করভাবে বেশী নম্বর পাওয়া সম্ভব ।আর প্রশ্ন কঠিন হলে দক্ষ ইংরেজি শিক্ষকরা বিভিন্ন কৌশলে পরীক্ষা হলে সঠিক উত্তর পাঠানোর ব্যবস্থা করেন । জনৈক এক ইংরেজি শিক্ষক বলেন, আমার এক স্টুডেন্ট ইংরেজিতে এ+ পেয়েছে অথচ নাম শুনে প্রথমে আমি তাকে চিনতে পারিনি, পরে অবশ্য চিনতে পেরেছি ।
৩) সৃজনশীল পদ্ধতি :
সৃজনশীল পদ্ধতির কারনে মেধাবীদের তুলনায় সাধারন ও দুর্বল শিক্ষার্থীরা বেশী উপকৃত হয়েছে ।এ পদ্ধতির পরীক্ষার প্রশ্ন সাধারনত: কম-বেশী ৫/৬/৭ লাইনের হয় ।ফলে দুর্বল মেধার পরীক্ষার্থীরা প্রশ্ন কমন না পড়লে কিংবা উত্তর করতে না পারলে প্রশ্ন এবং মনে যা আসে তা-ই উত্তরপত্রে লিখে দেয় এবং নম্বরও পায় ।জনৈক এক স্কুল শিক্ষক বলেন, আসলে সৃজনশীল পদ্ধতি হলো – শিক্ষার হার বাড়ানোর অভিনব কৌশল ’।
৪) পরীক্ষকদের ভাল নম্বর প্রদানের নির্দেশ :
শিক্ষাবোর্ড থেকে বিষয়ভিত্তিক এনলিস্টেড পরীক্ষকদেরকে উত্তরপত্র গ্রহন করার বোর্ড মিলনায়তনে ডাকা হয় । তখন উত্তর পত্র মূল্যায়ন করার নিয়ম-কানুন সম্পর্কে ব্রিফিং দেওয়া হয় । সে সময় পরীক্ষকদেরকে উদারভাবে নম্বর প্রদানের জন্য অলিখিত নির্দেশ দেওয়া হয় বলে অসমর্থিত সূত্রে জানা যায় ।
৫) কতিপয় পরীক্ষক অন্যকে দিয়ে খাতা দেখায় :
নাম না প্রকাশ করার শর্তে কতিপয় ছাত্র/ছাত্রীদের তরফ থেকে জানা যায় , অনেক পরীক্ষক তার কাছে প্রাইভেট পড়তে আসা বিশ্বস্ত কিছু ছাত্র/ছাত্রীদের দিয়ে পরীক্ষার উত্তর পত্র মূল্যায়ন করান এবং পরিক্ষার্থীরা ভাল নম্বর পায়!
৬) বেশী নম্বর দিলে প্রতিবছর খাতা পাওয়া যায় :
বিভিন্ন শিক্ষকদের সাথে মতবিনিময়ের প্রেক্ষাপটে এমন কথা শোনা যায় যে, কোন পরীক্ষক উত্তরপত্রে ভুল ধরে নম্বর কম দিলে প্রধান পরীক্ষক তাকে আবার নম্বর বাড়িয়ে দিতে বলেন ।যদি তিনি নির্দেশ পালনে অপারগ হন, তবে তাকে পরের বছর উত্তর পত্র মূল্যায়ন করার জন্য তার কাছে আর কল আপ লেটার পাঠানো হয় না ।পক্ষান্তরে উত্তরপত্রে বেশী নম্বর দিলে প্রতি বছর খাতা পাওয়া যায় ।
৭) উত্তরপত্র মূল্যায়নের সময় ২ টি কলম রাখতে বলা হয় :
পূর্বে পরীক্ষকের দায়িত্ব পালন করেছেন এমন কয়েকজন শিক্ষকের বরাতে জানা যায় , পরীক্ষকদেরকে আনঅফিসিয়ালী কিছু বুদ্ধি, কৌশল ও পরামর্শ দেওয়া হয় যে তারা যেন খাতা দেখার সময় সামনে ১ টি লাল ও ১ টি কাল কলম সামনে রাখেন ।পরীক্ষার্থীর উত্তরপত্রে যদি ছোট- খাট ভুল, চিহ্ন, ইত্যাদি থাকে, তাহলে সম্ভব হলে কাল কলমের কালি দিয়ে ঠিক করে যেন লাল কলমের কালি দিয়ে নম্বর দেওয়া হয় ।
৮) শিক্ষকদের এমপিও বন্ধের হুমকি :
অনেক সময় পরীক্ষকরা উত্তরপত্রে ভাল নম্বর দিয়ে থাকেন তাদের চাকুরী বাঁচানোর স্বার্থেই ।কারন সরকার কর্তৃক ঘোষনা দেওয়া আছে স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাশের হার অসন্তোষজনক হলে শিক্ষকদের এম.পি.ও. বন্ধ করে দেওয়া হবে ।সুতরাং স্পষ্টত:ই বুঝা যাচ্ছে সরকারের এ ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকির কারনেও পাবলিক পরীক্ষায় মেধাবী, সাধারন, মনোযোগী, অমনোযোগী শিক্ষার্থী সকলের ফলাফলই প্রতিবছর ভাল হয় ।
৯) এলাকার স্কুল শিক্ষকদের মধ্যে সমঝোতা :
যেহেতু সকল শিক্ষকই জানেন যে বিদ্যালয়ের ফলাফল খারাপ হলে তাদের সরকারী বেতন বন্ধ হয়ে যেতে পারে । তাই পরীক্ষার হলে বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষকদের মধ্যে একটা সমাঝোতা থাকে যাতে সবাই ভাল ফলাফল অর্জন করে ।আর এতে শিক্ষকদের চাকরীর সুনামও অক্ষুন্ন থাকে ।
১০) শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষের শ্রেষ্ঠ হবার প্রতিযোগিতা :
দেশের প্রতিটি শিক্ষাবোর্ড কর্তৃপক্ষ চান তাদের পাশের হার যেন দেশের অন্য সকল বোর্ডের চেয়ে ভাল হয় ।তাই উত্তরপত্রে নম্বর প্রদানের ক্ষেত্রে উদারনীতির চর্চ্চা করার অলিখিত নির্দেশ দেওয়া হয় পরীক্ষকদেরকে । কর্তৃপক্ষের চান যে করেই হোক বোর্ডের ফলাফল দেশের অন্য বোর্ডগুলোর চেয়ে ভাল হতেই হবে !
১১) শিক্ষকদের নিরাপত্তাহীনতা :
পরীক্ষার হলের বাহিরে নিরাপত্তা সমস্যার জন্য শিক্ষকরা কঠোর ভাবে পরীক্ষার্থীদেরকে গার্ড দিতে পারেন না ।কারন তাদের প্রতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি আসে যে, হলে পরীক্ষার্থীদেরকে অসদুপায় অবলম্বনে বাধা দিলে তাদের উপর হামলা হবে ।ফলে কিছু সৎ শিক্ষক চাইলেও পরীক্ষার্থীদের অসদুপায় রোধ করতে পারেন না ।আর এভাবে পরীক্ষার্থীরা ভাল পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফলাফল অর্জন করে ।
১২) এলাকার পরিচিত ম্যাজিস্ট্রেট :
উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরীক্ষাকেন্দ্রে কোন কোন অফিসারকে ম্যাজিস্ট্র্যাসী ক্ষমতা দিয়ে পাঠান পরিদর্শনের জন্য । দেখা যায় উক্ত অফিসার উপজেলার অনেকেরেই পরিচিত ।তখন তিনি নিয়ম রক্ষার পরিদর্শন করে তার দায়িত্ব সম্পন্ন করেন ।
১৩) সৎ ও সাহসী ম্যাজিস্ট্র্যাটের অনুপস্থিতি :
আজ থেকে ৮/১০ বছর আগেও পত্রিকায় খবরে জানা যেত এস.এস.সি. পরীক্ষার হলে পরীক্ষার্থীর নকল ধরায় ম্যাজিস্ট্র্যাট লাঞ্চিত কিংবা হামলা শিকার ।এর মানে কি ? তখনকার ম্যাজিস্ট্র্যাটগন সৎ,নীতিবান ও সাহসী ছিলেন ।আর এখন এ ধরনের কোন সংবাদ সচরাচর চোখে পড়ে না !
১৪) অভিভাবকদের প্রশ্নবিদ্ধ নৈতিকতাবোধ :
বর্তমানকালে বেশীরভাগ অভিভাবক তাদের সন্তানদের ভাল পড়াশুনার চেয়ে ক্লাসের রোল নম্বর, পরীক্ষায় ভাল নম্বর, জি.পি.এ. ফাইভ পাওয়ার ব্যাপারেই বেশী উদগ্রীব ।তাই তারা যে কোনভাবেই হোক ভাল ফলাফল অর্জনের জন্য টাকা খরচ করেন দু’হাতে !এতে করে শিক্ষার মানের অবনতি হচ্ছে ।
১৫) স্কুল শিক্ষকদের প্রাইভেট- কোচিং :
স্কুলের যে সকল শিক্ষক প্রাইভেট পড়ান, তারা শিক্ষার্থীদের ভাল ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য অনেক পরিশ্রম করেন ।তারা ছাত্র/ছাত্রীদের অবশ্যই কিছু পড়ান এবং শেখান ।তাছাড়া পরীক্ষার্থীদের ভাল ফলাফলের জন্য তারা পরীক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখেন, যার ফলে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা ভাল হয় ।
আসলে এভাবে পাবলিক পরীক্ষায় পাশের হার বাড়িয়ে এ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের জীবন নষ্ট করা হচ্ছে ।তাই সরকারের কাছে জনগনের দাবী, দেশের অরাজনৈতিক শিক্ষাবিদ, শহর ও গ্রামের শিক্ষক, মেধাবী শিক্ষার্থী—সকলের মতামত নিয়ে একটি মান সম্মত শিক্ষানীতি গ্রহন করা হোক এবং তা বাস্তবায়ন করা হোক । তখন আশা করা যায় পরীক্ষার ভাল ফলাফলের সাথে শিক্ষার মানেরও উন্নয়ন হবে ।
মো : মোরশেদ হায়দার, এমপিওভুক্ত শিক্ষক।