২০০৮ খিস্টাব্দে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির পরাজয়ের পর দলটির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে একরকম বিতাড়িত হয়। সেই কারণে প্রায় তিন দশক পর হতে চলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচনের আগে সংগঠনটি ক্যাম্পাসে সহাবস্থানকে বড় করে দেখছে। এ ইস্যুতে নির্বাচন পেছানোরও দাবি জানিয়েছে তারা। রোববার (১০ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক কালের কণ্ঠে প্রকাশিত খবরে এসব তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন রফিকুল ইসলাম।
সহাবস্থানের দাবির পাশাপাশি নির্বাচনে হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপন না করার দাবিও তুলেছে ছাত্রদল।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ ছাড়া ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল অন্য সংগঠনগুলোও এ দুটি দাবি জানিয়ে আসছে। মূলত এ দুটি ইস্যু নিয়ে সংগঠনগুলো এখন আন্দোলন করছে।
দাবির পক্ষে সংগঠনগুলোর যুক্তি হলো আবাসিক হলগুলোতে ছাত্রলীগ একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে আছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্বিঘ্নে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে এটা বড় অন্তরায়। সেই কারণে হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের দাবি করছে তারা। এ নিয়ে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোর মোর্চা প্রগতিশীল ছাত্রজোট কর্মসূচিও পালন করছে।
গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন তিন মাস পেছানোসহ সাত দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে স্মারকলিপি দিয়েছে। কর্মসূচি শেষে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আকরামুল হাসান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘ডাকসু নির্বাচন কেন্দ্র করে সহাবস্থান নয়, আমরা চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর একটি স্থায়ী সহাবস্থান থাকুক।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদ ও হল সংসদের গঠনতন্ত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি আবাসিক হলে ভোটকেন্দ্র স্থাপনের বিষয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে। কিন্তু গঠনতন্ত্রে ছাত্রসংগঠনের সহাবস্থানের বিষয়ে নির্দিষ্ট কিছু বলা নেই। তবে নির্বাচন আয়োজনকে ঘিরে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালায় প্রচার-প্রচারণায় সব প্রার্থীর সমান অধিকারের বিষয়ে স্পষ্ট বলা হয়েছে।
ডাকসু ও হল সংসদের গঠনতন্ত্রের ৮(ই) ধারায় বলা হয়েছে, প্রতিটি আবাসিক হলে একটি করে ভোটকেন্দ্র থাকবে এবং সংশ্লিষ্ট হলের সদস্যরা শুধু সেই ভোটকেন্দ্রে ভোট দিতে পারবেন।
বাম ছাত্রসংগঠনগুলো বলছে, ভোটারের কাছে প্রার্থীদের পৌঁছানোর সমান সুযোগের পরিবেশ সৃষ্টি হয়নি। প্রতিটি হলেই ছাত্রলীগের একচেটিয়া আধিপত্য রয়েছে। অন্য কোনো সংগঠন তেমন কোনো কার্যক্রম চালাতে পারছে না।
নির্বাচন আয়োজনকে ঘিরে ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা সক্রিয় হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে চা-চক্র বা আড্ডাও বসছে। অর্থাৎ নিয়মিত শিক্ষার্থী বা যারা ভোটার হবে, তাদের গুরুত্ব বেড়েছে। অনেকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ হয়ে আবাসন সংকট, ক্যান্টিনের খাবারের মান ও পরিবহন বা যাতায়াত সমস্যা নিয়েও কথা বলছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছে টানতে নানা দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা কিংবা সমস্যা নিয়ে কথা বলায় এগিয়ে রয়েছে বাম ছাত্রসংগঠনগুলোই।
ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগ সেভাবে ভোটারদের কাছে এখনো যায়নি। হলগুলোতে অবস্থানরত শিক্ষার্থীদেরই বেশি ভরসা করছে তারা। তবে ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেছে। এ সংগঠনগুলো তাদের সঙ্গে থাকবে বলে একমত হয়েছে বলে জানা গেছে। তফসিল ঘোষণা হলেই হলের বাইরের অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের পক্ষে টানতে কর্মসূচি শুরু করবে বলে জানায় তারা।
আগামী ১১ মার্চ ডাকুস নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এখন পর্যন্ত এ তারিখ বিবেচনায় রেখেই ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধন ও আচরণবিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। শিগগিরই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হতে পারে।
দীর্ঘদিন ক্যাম্পাসে সক্রিয় না থাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীদের থেকে অনেকটা দূরেই রয়েছে ছাত্রদল। বিশেষ করে নতুন ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে তারা বলতে গেলে এখন অপরিচিতই। নির্বাচন আয়োজনের আগে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান ও প্রচারের সমান সুযোগ চায় তারা। এ ক্ষেত্রে তিন মাস সময় চেয়ে নির্বাচন পেছানোর দাবি জানিয়ে উপাচার্যকে স্মারকলিপি দিয়েছে ছাত্রদল।
হলে ভোটকেন্দ্র রাখার বিষয়ে ছাত্রলীগ ব্যতীত অন্য সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল ছাত্রলীগের দখলে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা কতটা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে—এখন সেটা একটা বড় প্রশ্ন। নিরাপদ পরিস্থিতি সৃষ্টি না হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যারা হলে ও হলের বাইরে থাকে তারা ভোট দেওয়ার আগ্রহ হারাবে।
তাঁরা আরো বলছেন, গঠনতন্ত্রে প্রতিটি হলেই ভোটকেন্দ্র রাখার বিষয়ে বলা হয়েছে এটা ঠিক; কিন্তু পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর প্রত্যেক শিক্ষার্থীর যেখানে সমান সুযোগ থাকার কথা, সেখানে পরিস্থিতি ঠিক তার উল্টো। সমান অধিকার, সমান সুযোগ পেতেই সংগ্রাম করতে হয়। পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে হলেও অন্তত হলের বাইরেই ভোটকেন্দ্র রাখতে হবে।
ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী বলেন, ‘হলেই ভোটকেন্দ্র হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে হলগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থক ছাত্রসংগঠনের দুর্গে পরিণত করা হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলে ভোট দিতে যেতে নিরাপদ মনে করছে না। তারা মনে করছে হলে ভোট দিতে গেলে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারবে না। সেই জন্য হলের বাইরে একাডেমিক ভবনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে।’ নির্বাচন তিন মাস পেছানোর ছাত্রদলের দাবির সঙ্গে তিনি একমত নন। ঘোষিত দিন কিংবা ৩১ মার্চের মধ্যে নির্বাচন চান তাঁরা।
ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এখন নির্বাচনী উৎসবের মধ্যে রয়েছে। কিন্তু ছাত্রদল সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে নির্বাচন পেছানো দাবি জানিয়েছে। এটা অযৌক্তিক। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র কোথায় হবে, সেই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৬ হাজার শিক্ষার্থী একমত রয়েছে। এটা নিয়ে কোনো দ্বিধা নেই। নিয়ম অনুযায়ী ভোট যেখানে হওয়ার কথা, সেখানেই হবে।’
প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ছাত্রসংগঠনগুলো যেসব দাবি জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় আলোচনা করে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ হলের বাইরে ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও সহাবস্থানের বিষয়ে কয়েকটি ছাত্রসংগঠনের দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, এ বিষয়ে বলার এখতিয়ার তাঁর নেই।
উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘ছাত্রসংসদের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন হবে।’ তিনি বলেন, পরিবেশ পরিষদের বৈঠকে সহাবস্থানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। হল প্রাধ্যক্ষদেরও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে।