ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি গবেষণার ৯৮ শতাংশ নকল - দৈনিকশিক্ষা

ঢাবি শিক্ষকের পিএইচডি গবেষণার ৯৮ শতাংশ নকল

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

৯৮ শতাংশ হুবহু নকল পিএইচডি গবেষণা অভিসন্দর্ভের (থিসিস) মাধ্যমে ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি নিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কালাম লুৎফুল কবীর। এই গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অভিযোগ করেছেন, একাধিকবার অনুরোধ করলেও লুৎফুল কবীর তাঁকে থিসিসের কোনো কপি দেননি। মঙ্গলবার (২১ জানুয়ারি) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন আসিফ হাওলাদার। 

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, আবুল কালাম লুৎফুল কবীর বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টরের দায়িত্বে আছেন।

২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের দিকে ‘টিউবারকিউলোসিস অ্যান্ড এইচআইভি কো-রিলেশন অ্যান্ড কো-ইনফেকশন ইন বাংলাদেশ: অ্যান এক্সপ্লোরেশন অব দেয়ার ইমপ্যাক্টস অন পাবলিক হেলথ’ শীর্ষক ওই নিবন্ধের কাজ শুরু করেন আবুল কালাম লুৎফুল কবীর। তাঁর এই গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফ আর সহতত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিভাগের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাজ শুরু করার এক থেকে দেড় বছরের মাথায় ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে অভিসন্দর্ভের কাজ শেষ করে ফেলেন লুৎফুল কবীর। একটি পিএইচডি অভিসন্দর্ভের কাজ শেষ করার জন্য সাধারণত তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লাগে। কিন্তু দ্রুত কাজ শেষ করে প্রথমে সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর ছাড়াই ডিগ্রির জন্য অভিসন্দর্ভটি জমা দেন লুৎফুল কবীর। সহতত্ত্বাবধায়কের স্বাক্ষর না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন থেকে তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়। পরে লুৎফুল কবীর গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক ফারুককে ‘অনেক অনুনয়-বিনয়’ করে তাঁর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিয়ে এলে ২০১৫ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটে তা অনুমোদিত হয়।

গবেষণায় ৯৮ শতাংশ হুবহু নকলের বিষয়টি নজরে আসার পর গত বছরের সেপ্টেম্বরে একজন গবেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানের কাছে বিষয়টি নিয়ে লিখিত অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া লুৎফুল কবীরের অভিসন্দর্ভে নিজের একটি গবেষণা থেকে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ও তাঁর বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে একটি চিঠি দিয়েছেন সুইডেনের গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জোনাস নিলসন।

এই দুটি চিঠির বিষয়ে নিশ্চিত করে উপাচার্য কার্যালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, ফার্মেসি অনুষদের ডিনকে অভিযোগটি খতিয়ে দেখতে বলা হয়েছে। অনুষদটির ডিন এস এম আবদুর রহমান জানান, যাচাইয়ের পর তিনি অভিযোগটির বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে পারবেন।

আবুল কালাম লুৎফুল কবীরের পিএইচডি অভিসন্দর্ভে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠার পর তা জোগাড় করে যাচাই করেছে । গবেষণার চৌর্যবৃত্তি শনাক্ত করার বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সফটওয়্যার টার্নইটইনের মাধ্যমে অভিসন্দর্ভটি যাচাই করে দেখা গেছে, ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে রাজধানীর ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী-গবেষকের জমা দেওয়া একটি ‘স্টুডেন্ট পেপারস’-এর সঙ্গে লুৎফুল কবীরের নিবন্ধের ৯৮ শতাংশ হুবহু মিল রয়েছে। এটিসহ মোট ১৭টি জার্নাল, আর্টিকেল ও গবেষণাপত্রের সঙ্গে নিবন্ধটির বিভিন্ন অংশের উল্লেখযোগ্য মিল পাওয়া গেছে, যেগুলোর সবই লুৎফুল কবীরের অভিসন্দর্ভের আগে প্রকাশিত হয়েছে। টার্নইটইন সফটওয়্যার থেকে পাওয়া গবেষণার অরিজিনালিটি রিপোর্টসহ এ–সংক্রান্ত সব তথ্য ও নথিপত্র প্রথম আলোর কাছে রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষক আবুল কালাম লুৎফুল কবীর সরাসরি কোনো উত্তর দেননি। তিনি  বলেন, ‘২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমার গবেষণাটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে। যুক্তরাজ্যের নামকরা একটি জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছিল। এত বছর পরে কেন এই অভিযোগ তোলা হচ্ছে, জানি না। এখানে কোনো অপরাধ হয়ে থাকলে তা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও যাঁরা গবেষণার তত্ত্ববধায়কের দায়িত্বে ছিলেন, অপরাধটা তাঁদের। এ বিষয়ে আমার কোনো বক্তব্য নেই।’

 অনুসন্ধান শুরু করার পর লুৎফুল কবীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত নিজের অভিসন্দর্ভের কপিটি ‘অবৈধ’ প্রক্রিয়ায় নিয়ে ঘষামাজা করেছেন। এর প্রমাণ মিলেছে বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক অধ্যাপক মো. নাসিরউদ্দীন মুন্সীর বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘অতি সম্প্রতি আবুল কালাম লুৎফুল কবীরের পিএইচডি অভিসন্দর্ভে কিছু ঘষামাজা আমাদের নজরে এসেছে। চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ ওঠায় কেউ অবৈধ প্রক্রিয়ায় এই কাজটি করেছেন। ঘটনার তদন্ত প্রয়োজন।’

গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আবু সারা শামসুর রউফের সঙ্গে যোগাযোগের একাধিক চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। মুঠোফোনে অসংখ্যবার কল করা হলে তিনি তা ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। সম্প্রতি ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের একটি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার খাতা দেখতে চাওয়ায় হুমকি দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে ব্যাচটির একাডেমিক সব কার্যক্রম থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

গবেষণার সহতত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক  বলেন, ব্যস্ততা সত্ত্বেও গবেষণাটির তত্ত্বাবধায়ক অধ্যাপক রউফের অনুরোধে তিনি সহতত্ত্বাবধায়ক হয়েছিলেন। কিন্তু লুৎফুল কবীর কাজের বিষয়ে তাঁর সঙ্গে কোনো পরামর্শ করেননি, নিবন্ধের কোনো কপি তাঁকে না দেখিয়ে, তাঁর স্বাক্ষরও না নিয়ে ‘নজিরবিহীন স্বল্প সময়ে’ অভিসন্দর্ভ জমা দিয়ে দেন।

এই শিক্ষকের ভাষ্য, ‘কাজ শুরুর পর থেকে লুৎফুল কবীর আমার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেননি। বছরখানেক পরে শুনলাম, তিনি গবেষণা নিবন্ধ জমা দিয়ে দিয়েছেন। পিএইচডি গবেষণা করতে সাধারণত তিন থেকে সাড়ে তিন বছর লাগে। তিনি আমাকে কোনো কপিও দেননি, স্বাক্ষরও নেননি। আশ্চর্য হলাম। কিন্তু গবেষণাটি যখন অনুমোদনের জন্য একাডেমিক কাউন্সিলে পাঠানো হবে কিংবা সেখান থেকে ফেরত এসেছে, তখন স্বাক্ষরের জন্য লুৎফুল কবীর আমার কাছে এসে বেশ অনুনয়-বিনয় করেন। জানতে চাইলাম, এত দ্রুত তিনি কীভাবে গবেষণাটি শেষ করলেন? তিনি বললেন, কঠোর পরিশ্রম করে তিনি দ্রুত কাজ শেষ করেছেন। কনিষ্ঠ সহকর্মী হওয়ায় মানবিক বিবেচনা বা সহানুভূতির জায়গা থেকে আমি তাতে স্বাক্ষর করি। কিন্তু আমি ভাবতেও পারিনি, অভিসন্দর্ভে চৌর্যবৃত্তি করা হয়েছে। তখন কোনো অভিযোগও ওঠেনি আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চৌর্যবৃত্তি শনাক্ত করার সফটওয়্যারও তখন ছিল না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ওই সফটওয়্যার ব্যবহার শুরু হয়েছে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে । চৌর্যবৃত্তি করা হয়েছে জানলে আমি কখনোই স্বাক্ষর করতাম না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য (শিক্ষা) নাসরীন আহমাদ বলেন, ‘পিএইচডি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগটি সত্য হয়ে থাকলে বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক।’ এত বছর পরে কেন অভিযোগ তোলা হচ্ছে—লুৎফুল কবীরের এমন প্রশ্নের বিষয়ে এই জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের মন্তব্য, ‘অভিযোগ যেকোনো সময় উঠতে পারে। চৌর্যবৃত্তির দায় প্রথমত যিনি গবেষণা করছেন তাঁরই।

মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি - dainik shiksha মাধবীলতা নয়, স্কুলের নাম কচুগাড়ি পুনর্বহালের দাবি খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! - dainik shiksha খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো! এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ - dainik shiksha এইচএসসির ফরম পূরণ শুরু আজ মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074141025543213