দাও ফিরে সে অরণ্য - দৈনিকশিক্ষা

দাও ফিরে সে অরণ্য

গোলাম কবির |

শিক্ষা শব্দটির ব্যাপক বিস্তৃত ব্যবহার আছে। নানা অনুষঙ্গে শব্দটি কাজে লাগানো হয়। সারা বিশ্বে শিক্ষা নিয়ে আলোচনা-বিতর্কের পরিমাণ নির্ণয় করা কঠিন। ইউরোপে সে বিতর্কের ইতিহাস লিপিবদ্ধ আছে। আমাদের তেমন নেই। যা আছে তা পূর্ণাঙ্গ নয়। ফলে শিক্ষা বিষয়ে যাঁরা পথনির্দেশনা দেন তাঁদের কাছে ঐতিহ্য অজ্ঞাত রয়ে যায়।

আমাদের দেশে শিক্ষা সম্পর্কিত ইতিহাস রচিত হয়েছে, সে ইতিহাস মূলত শিক্ষা কমিশনের। শিক্ষার অন্তর্নিহিত শক্তি ও তাত্পর্য সম্পর্কে সেখানে আলোকপাত নেই বললেই চলে। আমরা শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিদেশনির্ভর পরিবর্তন করে চলেছি। ভেবে দেখছি না, এ ব্যবস্থা আমাদের জন্য কতটা উপযোগী।

এ যেন অন্ধকারে ঢিল ছোড়ার মতো, লাগলেও লেগে যেতে পারে।

শিক্ষাকে জাতির মেরুদণ্ড বলা হয়ে থাকে। এই মেরুদণ্ডকে সুদৃঢ়ভাবে দাঁড় করিয়ে রাখেন যথাযথ শিক্ষক। শিক্ষক যদি নিজেই মেরুদণ্ডহীন হন, ক্ষমতা ও মতবাদের কাছে মাথানত করেন; সর্বোপরি বিত্তবৈভবের জন্য আমিত্ব বিসর্জন দেন, তবে তাঁর দেওয়া শিক্ষায় শিক্ষার্থী প্রাণে বাঁচবে অমেরুদণ্ডীরূপে। আমরা পদ-পদবির লোভে বিশ্বস্ত প্রভুভক্তের মতো আচরণ করি। এ আচরণ শিক্ষকের পরিচায়ক নয়। শিক্ষকসত্তার জন্য অবমাননা।

ইতিহাসের পাতায় যেসব শিক্ষকের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে, তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। তবুও তাঁরা ধ্রুবতারার মতো উজ্জ্বল। আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাস অর্বাচীন নয়। তবুও দৃষ্টান্ত তুলে আনতে হয় পরদেশ থেকে। শিক্ষকের অগ্নিমন্ত্র দৃষ্টান্ত সক্রেটিস। ক্ষমতাধরদের সব কুহকের বন্ধন ছিন্ন করে আত্মাহুতি দিয়েছিলেন, তবুও মাথা নোয়াননি। নিকট ইতিহাসে দেখব, ইতিহাসবিদ ইবনে খালদুন ক্ষমতার ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে তাঁর তত্ত্বের বিজয় রথ চালিয়ে গেছেন। নিকট অতীতের বিদ্যাসাগরের কথাই ধরি না কেন! দরিদ্র বামনের ছেলে, তখনকার দিনের দুষ্প্রাপ্য অথচ লোভনীয় অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন তিনি। অন্যায়ের কাছে মাথানত করেননি। শেষ অবধি তিনি আত্মমর্যাদা রক্ষা করে গেছেন। গত শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত আমাদের দেশেও অনেক অনমনীয় শ্রদ্ধাবান প্রকৃত শিক্ষক বর্তমান ছিলেন। তাঁরা কোথায় হারিয়ে গেলেন। দানব সভ্যতা কি তাঁদের অপসৃত করল?

সনদ সংগ্রহ করা আর শিক্ষিত হওয়া যে এক বিষয় নয়, আমরা তা খতিয়ে দেখি না। ফলে আমাদের দেশে সনদধারীর সংখ্যা বাড়ছে। তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যথার্থ শিক্ষিতের সংখ্যা কমছে। এর পেছনে অনাবশ্যক বিদেশনির্ভর শেখানো বুলি আমাদের অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। উপরন্তু অর্থবিত্তের প্রতি প্রবল আকর্ষণ মৌলিক শিক্ষা থেকে আমাদের ক্রমেই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আইয়ুব শাহি যুগে, সমন্বিত শিক্ষার পরিবর্তে সেই যে নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষাকে বহুমুখী করা হলো, তখন থেকে নগদ প্রাপ্তির আশায় মেধাবীরা বিজ্ঞানের প্রতি ঝুঁকে পড়ল। তবে মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ে নয়, প্রকৌশল-চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদিতে। কারণ গত শতকের শেষ অবধি সেখান থেকে পাস করেই পয়সার মুখ দেখা যেত। মানববিদ্যা, সমাজবিজ্ঞান এমনকি মৌলিক বিজ্ঞান বিষয়ে মেধাবীরা আর আকর্ষণ অনুভব করল না। ফলে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ধীরে ধীরে মেধাশূন্যতার দিকে এগিয়ে গেল। যার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় মেধাবী শিক্ষকের স্বল্পতা দৃশ্যমান।

অর্ধশত বছর আগে এই বাংলায় যে কয়টি মানসম্পন্ন কলেজ ছিল, সেগুলোয় তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য শিক্ষকদের এখন জায়গা হচ্ছে না। যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা কলেজ সরকারীকরণের ফলে অনুকম্পায় সরকারি হওয়া শিক্ষকরা টাকা দিয়ে অথবা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে প্রথম শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিকড় গাড়ছেন এমনকি তাঁরা শিক্ষা প্রশাসনেও প্রাধান্য পাচ্ছেন। মেধাবীরা শিক্ষা ক্যাডারে আসতে উৎসাহী নন, যাঁরা বাধ্য হয়ে আসছেন, তাঁরা সাবেকদের কর্মকাণ্ড দেখে হতোদ্যম। এ অবস্থায় সত্যিকারের শিক্ষকের অভাব পূরণ হবে কিভাবে?

শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম একবার বলেছিলেন, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেসব শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই স্কুল শিক্ষক হওয়ার যোগ্য ছিলেন কি না সে ব্যাপারে তিনি সন্দিহান ছিলেন। আমরা মনে করি, স্বাধীনতা-উত্তর জাতীয় ট্র্যাজেডির পর শিক্ষায় যে নৈরাজ্য নেমে এলো, তাতে অনেক কলেজ শিক্ষক সরকারি অফিসার হয়ে গেলেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই আজকের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিলে কোথায় জায়গা হতো তা বলা কঠিন।

একসময় বলা হতো, শিক্ষকরা উপযুক্ত বেতনাদি পান না। এখন সেটি অপ্রাসঙ্গিক। এখনকার বেশির ভাগ শিক্ষক চাকরি করেন। তাঁদের বোঝানো কঠিন শিক্ষকতা চাকরি নয়, ব্রত। এই ব্রত পেছনে ফেলে লাল-নীল-সাদা নিয়ে রাজনীতি করেন এবং ক্ষমতার রজ্জু ধরে ওপরে ওঠার কসরত করেন। এঁরা শিক্ষক পদবাচ্য কি না সে প্রশ্ন বোধকরি অবান্তর নয়।

আমাদের প্রাতঃস্মরণীয় শিক্ষাগুরুকুল হারিয়ে গেলেন। এর জন্য কী মানবসভ্যতার নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী বাইরের রূপ দায়ী? যা প্রত্যক্ষ করে ক্ষোভে-দুঃখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন : ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’। সভ্যতার নামে আমরা যা আমদানি করছি, তা আমাদের অনিবার্য ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের শিক্ষাবিশারদরা সৃজনশীল পদ্ধতি আমদানি করলেন। তাঁরা হয়তো ভেবে দেখেননি লেখাপড়ার মৌলিক বিষয়ে প্রবেশের সক্ষমতাই সৃজনশীলতা। মূল বিষয় আত্মস্থ করে তাকে অধিকাংশের বোধগম্য হিসেবে নিজের মতো করে পর্যবেক্ষণের কৃতিত্বই সৃজনশীলতা। বিষয়টি নতুন নয়। প্রকাশ ক্ষমতার চমৎকারিত্বই নতুনরূপে প্রতিভাত হয়। কতগুলো সূত্র শিখিয়ে সৃজনশীল করা যায় না। এই সূত্রের পেছনে ছোটাছুটি করে আমরা বেশির ভাগই তা আয়ত্তে আনতে পারলাম না। পক্ষান্তরে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত দেশের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গাইডনির্ভর হয়ে পড়ল। ছাত্র-শিক্ষক কেউ আর মূল বইয়ের ধারেকাছে নেই। এ জন্য সভ্যতা নয়, সভ্যতার উচ্ছিষ্টভোগীরা গোটা জাতিকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে বাধ্য করেছে। এই নিষ্ঠুর সভ্যতার যশঃকামীদের উদ্দেশে বলতে চাই, আমাদের অরণ্যই অর্থাৎ সাবেকি শিক্ষাই ভালো ছিল, মানুষ বইবিমুখ হয়নি। তাই রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরা আবারও বলি : ‘দাও ফিরে সে অরণ্য লও এ নগর’।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0089111328125