পে-স্কেলে বৈষম্যের প্রতিবাদসহ বিভিন্ন দাবিতে শিক্ষকরা অনির্দিষ্টকালের সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরু করবেন। আগামীকাল সোমবার থেকে অচল হয়ে পড়ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
বন্ধ থাকবেসব ক্লাস-পরীক্ষা । দেশে ৩৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক প্রায় ১৪ হাজার। তাদের আন্দোলনে বছরের শুরুতেই লন্ডভন্ড দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গন। আন্দোলনে আছেন সরকারি কলেজ শিক্ষকরা। তারা অবশ্য ‘প্রকৃচি’র মাধ্যমে আন্দোলন করছেন।
শিক্ষক আন্দোলনের খেসারত দেবেন সরকারি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৫৬ লাখ শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে শঙ্কা সেশনজটের । কলেজ শিক্ষকরা আন্দোলনের কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সরকারি কলেজগুলোতে অন্তত ২৬টি পরীক্ষা পিছিয়ে যেতে পারে।
এছাড়াও প্রকৃচি (প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, চিকিৎসক) ও বিসিএস সমন্বয় কমিটির ডাকে আগামীকাল থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রতিদিন দুপুর ১২টা থেকে ২টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালিত হবে। সরকারি কলেজ শিক্ষকরা বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে এ কর্মসূচি পালন করবেন। ফলে ৩০৫টি সরকারি কলেজেও দেখা দেবে দুই ঘণ্টার জন্য অচলাবস্থা।
সম্মিলিত সরকারি কর্মকর্তা পরিষদের (বাসসকপ) ডাকে নন-ক্যাডার কর্মকর্তারাও আগামীকাল থেকে ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দুই ঘণ্টার কর্মবিরতি পালন করবেন। এর সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা থাকায় সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোতেও এ কর্মসূচির ঢেউ লাগবে।
এদিকে প্রথমবারের মতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাও পে-স্কেলের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। শর্তহীনভাবে এমপিওর দাবিতে তারাও ১২ জানুয়ারি থেকে আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন। এছাড়া ১৫ জানুয়ারি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা গণছুটি কর্মসূচি শুরু করবেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব কর্মসূচির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন হাসপাতাল, সরকারি দফতর কর্মবিরতির মুখে পড়বে। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও প্রাথমিকের লাখ লাখ শিক্ষার্থীর পড়ালেখা ক্ষতির মুখে পড়বে। ক্যাডার ও নন-ক্যাডার কর্মকর্তাদের কর্মবিরতির কারণে সরকারি বিভিন্ন দফতর কয়েক ঘণ্টার জন্য স্থবির হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। সমস্যা চিহ্নিত করতে তিনি সিনিয়র সচিবদের দায়িত্ব দিয়েছেন। সে অনুযায়ী একটি ফলপ্রসূ বৈঠক হয়েছে। আলোচনার ফলাফলও ইতিবাচক। সমস্যা অনেকটাই সমাধান হয়ে গেছে। আসলে আলোচনার মাধ্যমেই যে সমস্যার সমাধান সম্ভব তা প্রমাণিত হয়েছে।’
আজ সোমবার থেকে শুরু হওয়া কর্মবিরতির কর্মসূচির নেতৃত্বে মূলত তিনটি মোর্চা। অধ্যাপকদের একটি অংশকে সিনিয়র সচিবের গ্রেডে বেতনভাতাসহ ৫ দফা দাবি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের। তাদের পক্ষে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন।
সংগঠনটির মহাসচিব অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল শনিবার বলেন, ‘আমরা দাবি আদায়ের জন্য ৮ মাস ধরে আন্দোলন করছি। এতদিন অবস্থান, সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলনের মতো নরম কর্মসূচি দিয়েছি। সিনিয়র মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শিক্ষকের কষ্টের কথা জানিয়েছি। কিন্তু দাবি পূরণ হয়নি। অর্থমন্ত্রী অঙ্গীকার করেও তা রক্ষা করেননি।
এ অবস্থায় শিক্ষকরা চরম ক্ষুব্ধ। তাই দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কাল থেকে সর্বাত্মক কর্মবিরতি চলবে।’ অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সমস্যা চিহ্নিত করতে প্রধানমন্ত্রী যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন তাদের পক্ষ থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো আহ্বান পাইনি। ডাক পেলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করব।’
আরেক প্রভাবশালী মোর্চা প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটি। এতে প্রশাসন ক্যাডার ছাড়াও ২৬ ক্যাডার অন্তর্ভুক্ত আছে। কমিটির কেন্দ্রীয় স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের মহাসচিব আইকে সেলিমউল্লাহ খোন্দকার জানান, ১১ জানুয়ারি থেকে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বহাল আছে। সাধারণ সদস্যরা আলোচনা ও আন্দোলন পাশাপাশি চালাতে বলেছেন। তাদের পরামর্শ হচ্ছে, প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় কর্মসূচি শিক্ষা ক্যাডারও পালন করবে। এভাবে দাবি আদায় না হলে ২২ জানুয়ারি বিসিএস শিক্ষা সমিতির সাধারণ সভা থেকে নতুন কর্মসূচি আসবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের লক্ষ্য দাবি আদায়, জনগণকে কষ্ট দেয়া নয়। কেননা, ডাক্তাররা যদি সাধারণ সময়ে কর্মবিরতি দেন, তাহলে জনগণের ক্ষতি অনেক মারাত্মক হবে। এ কারণে আমরা মধ্যাহ্নভোজের সময় কর্মবিরতি দিয়েছি। আমরা চাই সরকার এখান থেকে বার্তা নেবে। যদি না নেয়, সেক্ষেত্রে আরও কঠোর কর্মসূচিও আসতে পারে।
প্রকৃচি ও ২৬ ক্যাডারে প্রায় এক লাখ চাকরিজীবী আছেন। ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা নিয়মিত পদোন্নতি পান না। পদোন্নতির মাধ্যমে তারা যে লাভবান হতেন, সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেলের মাধ্যমে তাদের সেই আর্থিক সুবিধা পূরণ হতো। তাই সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিল করায় ২৬ ক্যাডারের কর্মকর্তারা আন্দোলনে নেমেছেন।
তবে ৭ জানুয়ারি প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় কমিটির সঙ্গে মুখ্য সচিবের নেতৃত্বাধীন সচিব কমিটির বৈঠকে সিলেকশন গ্রেড ও টাইম স্কেল বাতিলের ক্ষতি পূরণে পদোন্নতির সোপান তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে, এজন্য প্রয়োজনে পদ সৃষ্টি করা হবে। এ লক্ষ্যে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে নিজ নিজ ক্যাডার থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হবে। এসব প্রস্তাব দ্রুত অনুমোদনের ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে জনপ্রশাসন সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী বলেন, আমরা প্রস্তাব পাওয়ার পর দ্রুত তা নিষ্পত্তি করব। কাজটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় করতে গেলে দেরি হবে। এটা যাতে না হয়, সে জন্য জনপ্রশাসন, অর্থ এবং ক্যাডারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্সের মতো কাজ করবে।
প্রায় সাড়ে ৫ লাখ এমপিওভুক্ত জনবলের পক্ষে শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি এক সংবাদ সম্মেলন করে। এ সময় শিক্ষক নেতারা বলেন, অষ্টম পে-স্কেলের অধীনে এমপিও দেয়ার লক্ষ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যোগ্যতাভিত্তিক ও মূল্যায়নক্রমে অনুদান সহায়তা (এমপিও) দেয়া হবে। এতে শিক্ষক সমাজ আশাহত।
২০ ডিসেম্বরের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে শর্তহীনভাবে এমপিও দিতে হবে। দাবি আদায়ের জন্য তারা ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত লাগাতার কর্মসূচি দিয়েছেন। এর মধ্যে আছে, ১২ থেকে ১৪ জানুয়ারি শিক্ষকদের কালো ব্যাজ ধারণ। ১৬ জানুয়ারি ১ ঘণ্টার কর্মবিরতি। ১৮ জানুয়ারি বেলা ১১টা থেকে সারা দেশের উপজেলা-জেলা সদরে শিক্ষক-কর্মচারীদের মানববন্ধনসহ বিক্ষোভ-সমাবেশ। সেখান থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হবে। ওইদিন বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কেন্দ্রীয় কর্মসূচি পালিত হবে। কর্মসূচি শেষে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেয়া হবে।
তবে শিক্ষক আন্দোলন নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছেন, বিরাজমান সমস্যার সমাধান মূলত অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতে। তারা বলেন, চলতি অর্থবছরে বাজেটে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনিতেই অর্থ বরাদ্দ কম পেয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উন্নয়নমূলক সব কার্যক্রম কাটছাঁট করতে হয়েছে এবার। এর ওপর শিক্ষকদের দাবি পূরণের সামর্থ্য ও এখতিয়ার এ মন্ত্রণালয়ের হাতে নয়। সে কারণে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।
৩৭ বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মঘট ঃ
দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতি শুরু করবেন সোমবার থেকে। এমনকি এ সময়ে কোনো পরীক্ষা ও সান্ধ্যকালীন কোর্সও পরিচালনা করা হবে না। তাদের সঙ্গে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরাও দাবি জানিয়েছেন, নতুন পে-স্কেলে টাইম স্কেল ও সিলেকশন গ্রেড তুলে দেওয়ায় ৪০ হাজার শিক্ষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তারাও আন্দোলনে নামছেন।
এরআগে গত রোববার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করছেন। ক্লাসেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে জানানো হয়েছে। আজ ১১ জানুয়ারি একযোগে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতি শুরু হবে। গত বছরের মে মাসে অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো ঘোষণার পর পরই চার দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এমনকি দাবি আদায়ে কয়েক দফায় অর্ধদিবস ও পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন তারা। সর্বশেষ এখন অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হলো।
সরকারি কলেজের ১৫ হাজার শিক্ষক :
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আন্দোলনের আগেই আন্দোলনে নেমেছেন ৩০৬ সরকারি কলেজের প্রায় ১৫ হাজার শিক্ষক। সিলেকশন গ্রেড, টাইম স্কেল বাতিল করায় এবং অধ্যাপকদের বিদ্যমান বৈষম্যমূলক বেতন স্কেল আপগ্রেডেশনের দাবিতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি একাধিকবার কর্মবিরতিও পালন করেছে। কিন্তু দাবির স্বপক্ষে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা পর্যন্তই তারা সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু প্রকাশিত গেজেটে তাদের দাবির কোনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় তারাও ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত দু’ঘন্টা করে আবারও কর্মবিরতির ডাক দিয়েছেন।
তবে, শিক্ষা ক্যাডারের জুনিয়রদের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে আন্দোলনের বিষয়বস্ত নিয়ে। জুনিয়ররা মনে করছেন অধ্যাপকরা শুধু তাদের কথাই চিন্তা করছেন, জুনিয়রদের জন্য নয়।