“আমরা তিতুমীর হলের ১৮ ব্যাচ। হলে ওঠার পর থেকেই নিয়মিত আমাদের টর্চার করা হতো। থাপ্পড় মারা, ক্লাসমেটকে দিয়ে আরেক ক্লাসমেটকে মারানো, অসংখ্যবার কান ধরে উঠবোস করানো হতো। একবার আমিসহ কয়েকজনকে হলের ছাদে তোলা হয়। বড় ভাইদের না জানিয়ে মা-বাবা নিয়ে কমন রুমে বসা, ছাত্রলীগের মিছিলে না গিয়ে মুভি দেখতে যাওয়া, টিউশনি করতে যাওয়া এবং ডিপার্টমেন্টে বড় ভাইকে সালাম না দেওয়ার কারণে আমাদের কয়েকজনকে ছাদে নেওয়া হয়। এরপর ১৭ ব্যাচের ভাইরা মিলে আমাদের সবাইকে স্টাম্প দিয়ে মারতে থাকে। এর মধ্যে ইইই (ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং) বিভাগের একজন মার খেয়ে টলে পড়েনি বলে তাকে সবচেয়ে বেশি পেটানো হয়। ওই বন্ধুকে মারার সময় বড় ভাইরা বলছিলেন, ‘শালা ব্যায়াম করে, ব্যায়াম করা শরীরে পিটায়া শান্তি।’ দীর্ঘক্ষণ ধরে আমাদের সবাইকে প্রচণ্ড মারধর করা হয়। অনেকে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা চাইলেও মারধর থামানো হয়নি। ওই ঘটনার পর টানা সাত দিন আমরা ঠিকমতো চলতে পারিনি। অনেকেই প্রচণ্ড মার খেয়েছে, কেউ কেউ মার সহ্য করতে না পেরে হল ছেড়ে চলে গেছে।”
“যখন জুনিয়র ছিলাম তখন আহসানউল্লাহ হলে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছি শাওন সাহা (মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫ ব্যাচের শিক্ষার্থী) ভাইয়ের কাছে। রাতের পর রাত বিভিন্ন কারণে আমাকে আর আমার ফ্রেন্ডদের স্টাম্প দিয়ে পিটিয়েছেন তিনি। এখন তিনিই আবার ‘বুয়েট-ল্যান্ড অব লিভিং’ টি-শার্ট বিক্রি করেন। আহসানউল্লাহর অনেক ছেলেই এখনো চুপ করে আছে শুধু শাওন ভাইয়ের ভয়ে।”
‘আহসানউল্লাহ হলে ১৮ ব্যাচের রিয়াজকে ক্লাস শুরুর পর থেকেই হলের ছাদে তুলে মারধর করত ১৭ ব্যাচের প্লাবন চৌধুরী দীপ। প্লাবন তার ব্যাচের অন্য শিক্ষার্থীদের বলায় তারাও রিয়াজকে রুমে ডেকে নিয়ে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে রেখে মজা নিত। এই প্লাবনের বিরুদ্ধে সামান্য সালাম না দেওয়ার কারণে, হাফপ্যান্ট পরে টয়লেটে যাওয়ার কারণে থাপ্পড় মারার অভিযোগও আছে।’
‘শেরে বাংলা হলের নির্বাচনের দিন আনুমানিক রাত ১০টা-১১টার দিকে আমাদের ১৭ ব্যাচকে ডাকা হয়। ছাত্রলীগের মিটিংয়ে কে কে সম্পূর্ণ সময় ছিল না প্রশ্ন তুলে একে একে আমাদের মারধর করা হয়। ১৪ ব্যাচের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মুহতাসিম ফুয়াদ, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের মাহমুদ সেতু, ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ইফতেখার ফাহাদ মিলে খুব জোরে জোরে চড়-থাপ্পড় মারছিল। সেখানে ১৫ ব্যাচের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ইশতিয়াক মুন্নাসহ আরো অনেকে উপস্থিত ছিল। ওই দিনই রাত ২টার পর ১৬ ব্যাচের পলিটিক্যালরা আবার আমাদের ছাদে নিয়ে মারধর করে। ওই মারধরের সময় সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের (১৬ ব্যাচ) অমিত সাহার হাত ভেঙে যায়। ওই দিন সেখানে ১৬ ব্যাচের আশিকুল ইসলাম বিটু, মুজতবা রাফিদ, ফারহান জাওয়াদ চৌধুরী, আসিফুর রহমান মিনার, মুজাহিদ, শুভসহ আরো অনেকে বেল্ট খুলে ও স্টাম্প দিয়ে আমাদের মারধর করে।’
ওপরের ঘটনাগুলো কোনো পাড়া-মহল্লা কিংবা নামমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নয়। দেশের প্রথম সারির শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীদের ওপর একই প্রতিষ্ঠানের ‘বড় ভাইদের’ চালানো নির্যাতনের বর্ণনা এসব। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী নেতাকর্মীদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন দেশের নামকরা এই বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থীরা। দীর্ঘদিন ধরেই বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়ে এলেও সর্বশেষ বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর একে একে বেরিয়ে আসছে এসব নির্যাতনের অকথিত ঘটনা। নির্যাতিত শিক্ষার্থীরা অনলাইনে অভিযোগ দায়েরের পাশাপাশি বর্ণনা করছেন লোমহর্ষক সেই ঘটনাগুলোর। শিক্ষার্থীদের নির্যাতনসহ বিভিন্ন অভিযোগ জানানোর জন্য বুয়েটের ‘ইউরিপোর্টার’ নামক একটি ওয়েবসাইটে এই ঘটনাগুলো তুলে ধরছেন শিক্ষার্থীরা। চলতি বছরের মে মাস থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৬০টিরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে ওই ওয়েবসাইটে, যার মধ্যে আবরার হত্যাকাণ্ডের পর গত দুই দিনে সেখানে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে মোট ৮৩টি। গতকাল বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত মোট ৭০ জন শিক্ষার্থী বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মী দ্বারা নির্যাতনের ঘটনা উল্লেখ করেছেন। শিক্ষার্থীদের নির্যাতনে জড়িত নেতাকর্মীদের নাম উঠে আসছে সেসব অভিযোগে।
এ বিষয়ে জানতে বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক (ডিএসডাব্লিউ) অধ্যাপক মিজানুর রহমানের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।