হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়। পৌনে একশ বছর ধরে চায়ের দেশ মৌলভীবাজারের নারীদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়ানো এ প্রতিষ্ঠানে সহস্রাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। জেলাশহরে ভালোই নামডাক আছে এ বিদ্যাপীঠের। তবে আড়ালে দুর্নীতি আর গোঁজামিলের গল্পও আছে। বিদ্যালয়ের তহবিলে আয়-ব্যয়ের হিসাব শেষে ষাট লাখেরও বেশি টাকারই হিসাব মিলছে না। হিসেবের এ গড়মিল ধরা পড়েছে অডিট পরবর্তী তদন্তেও।
২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বিভিন্ন খাত থেকে তহবিলে জমা হওয়ার কথা ছিলো ১ কোটি ১৯ লাখ ৫১ হাজার ১৫০ টাকা। কিন্তু আদায় দেখানো হয়েছে ১ কোটি ১ লাখ ৩৩ হাজার ৮৩৭ টাকা। এর বিপরীতে ব্যয় দেখানো হয় ৯৫ লাখ ৩১ হাজার ৪৪ টাকা। খরচের পর ৬ লাখ ২ হাজার ৪২৩ টাকা জমা থাকার কথা থাকলেও তহবিলে এর সন্ধান পাওয়া যায়নি। অপরদিকে ১৮ লাখ ১৭ হাজার ২৮৩ টাকা অনাদায়ী দেখানো হলেও তদন্তে প্রমাণ মিলেছে এ টাকাও অনাদায়ী থাকেনি। ঠিকই আদায় হয়েছে। তবে জমা হয়নি তহবিলে।
অপরদিকে আগত তহবিল হিসেবে ব্যাংকে ২৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৪ টাকা জমার হিসাব থাকলেও জমা আছে ১৪ লাখ ৫১ হাজার ২৭৬ টাকা। অর্থাৎ ব্যাংক খাতে জমার ১০ লাখ ৬১ হাজার ২৭৬ টাকারই হিসেব নেই। এ হিসেবে গড়মিল আছে আরো। ক্যাশবুকে ২৫ লাখ ১২ হাজার ৮৬৪ টাকার কথা উল্লেখ থাকলেও রেজিউলেশন বলছে এ টাকার পরিমাণ ৩০ লাখ ৫৭ হাজার ৬৫০। অর্থাৎ এখানে হিসেব মেলেনি আরও ৫ লাখ ৪৪ হাজার ৭৮৬ টাকার।
২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বার্ষিক অডিট সম্পন্ন হয়। ৫ সদস্যের ওই কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান। কমিটি অডিট শেষে আয় ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১৬টি আপত্তি উত্থাপন করে। এ সকল আপত্তির প্রেক্ষিতে বিদ্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা বেগমের জবাব সন্তুষ্ট করতে পারেনি ম্যানেজিং কমিটিকে। পরে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার নির্দেশনায় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেলওয়ার হোসেন বাচ্চুকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পক্ষে জেলা শিক্ষা অফিসের সহকারী পরিদর্শক মো. মুহিবুল হাসানও ছিলেন ওই কমিটিতে। ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ নভেম্বর সম্পন্ন সে তদন্তেই উঠে আসে হিসেবের গড়মিলের চিত্র।
হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়ের মূল খাত হচ্ছে ছাত্রীদের বেতন, ভর্তি ফি, পরীক্ষা ফি। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে এ খাতে আয় ধরা হয়েছিলো ৭৪ লাখ ৯২ হাজার ৩২০ টাকা। আদায় দেখানো হয় ৫৬ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ১৮ লাখ ১৮ লাখ ১৭ হাজার ২৮৩ টাকা অনাদায়ী দেখানো হয়। তবে তদন্ত কমিটি অনাদায়ী এ টাকা আদায়ের প্রমাণ খুঁজে পায়। তদন্তে ছাত্রীদের নিকট বেতন, ভর্তি ফি, পরীক্ষা ফি পরিশোধের কিছু রশিদের সন্ধান মেলে কিন্তু ও রশিদের বিপরীতে কোনো তথ্য বিদ্যালয়ের কোনো হিসাবে সন্ধান মেলেনি।
২০১৬-১৭ অর্থ বছরে হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ১ হাজার ১১৩ জন। এর বিপরীতে শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা সব মিলিয়ে ৩০ জন। ১১শ’রও বেশি শিক্ষার্থীর জন্য টিফিন বাবদ যেখানে সারা বছরে ৪ লাখ ৭ হাজার ৪১৮ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে, সেখানে অন্যদের খাবার বাবদ ভাত-মাছ, বিরিয়ানি-নাস্তা মিলিয়ে বিল ধরা হয়েছে ৫ লাখ ২৩ হাজার ৪৭৭ টাকা। ওই সময়ের মধ্যে বিদ্যালয়টি সাপ্তাহিক ও সব ধরনের ছুটি মিলিয়ে ১২৫ দিনের মতোই বন্ধ ছিলো। এছাড়া বৃহস্পতিবার অর্ধদিবস পাঠদান থাকায় আরো প্রায় ৪০ দিন টিফিন-খাবারের প্রয়োজন পড়েনি। অর্থাৎ বছরের বাকি ২০০ দিনেই সোয়া ৫ লাখ ২৩ হাজার ৪৭৭ টাকার ভাত-বিরিয়ানি খাওয়া হয়েছে। শুক্রবার ও বৃহস্পতিবারের খাবারের প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও এ দিনগুলোতে খাবারের বিল-ভাউচার দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৬৬ হাজার ৭৫৮ টাকা। এছাড়া তথ্যবিহীন সাদা কাগজে আরো ৮ লাখ ৩২ হাজার ৭শ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে।
তদন্ত কমিটি অনুসন্ধানে বাজেটে বাস্তবায়িত ব্যয়ের সাথে প্রকৃত ব্যয়ের গড়মিলও খুঁজে পায়। টিফিন খাতে বাজেটে ৯ লাখ ৮১ হাজ্রা ৮ ৪৭ টাকা ব্যায় দেখানো হলেও ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ৭ হাজার ৪১৮ টাকা,অর্থাৎ এ খাতে গড়মিল ৫ লাখ ৭৪ হাজার ৪২৯ টাকা। এমপিওভূক্ত শিক্ষকের বেতন বোনাস বাবদ বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে বাজেটে ব্যয় দেখানো হয় ২০ লাখ ৮ হাজার ৭৮৭ টাকা অথচ ব্যয় হয় ১৫ লাখ ৪৯ হাজার ৩৮৩ টাকা। এ খাতে গড়মিল দেখা যায় ৪ লাখ ৫৯ হাজার ৪০৪ টাকা। খ-কালীন শিক্ষকের বেতন বোনাস বাবদ বিদ্যালয়ের তহবিল থেকে বাজেটে ব্যয় দেখানো হয় ৬ লাখ ৭৯ হাজার ৮১০ টাকা বিপরীতে ব্যয় হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ২২৮ টাকা। এ খাতে গড়মিল দেখা যায় ২ লাখ ১৬ হাজার ৫৮২ টাকা। তদন্ত কমিটি এ তিন খাতে গড়মিল হওয়া ১২ লাখ ৫০ হাজার ৪১৫ টাকার পুরোটাকেই তছরুপ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
টাকার হিসেবে অনিয়ম ও গড়মিল মিলিয়ে ৬৩ লাখ ৭৫ হাজার ৬৪১ টাকারই হিসেব পায়নি তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটি বিদ্যালয়ের টাকার এ বিশাল ঘাপলার দায় প্রতিষ্ঠানের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা বেগমেরই বলে মনে করে। প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনে তার অবহেলা ও অনভিজ্ঞতাকে দায়ী করা হয় তদন্ত প্রতিবেদনে।
এ সকল অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্তের এক মাস পর ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০ ডিসেম্বর লিখিত জবাবে প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা বেগম বলেন, আমার প্রদর্শিত উল্লেখিত আয় ব্যয় যাচাই করলে দেখা যাবে একটি টাকা এমনকি একটি পয়সাও তছরুপ করা হয়নি। তিনি বলেন, অডিট কমিটি আমার প্রদর্শিত আয় ও ব্যয় থেকে তারা আয় ও ব্যয় কম দেখিয়েছেন। এতে প্রমাণিত হয় উল্লেখিত অডিট কমিটি সম্পূর্ণভাবে বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয় সম্পর্কে অনভিজ্ঞ। রাশেদা বেগম দাবি করেন, হিসাব সম্পর্কে অনভিজ্ঞ থাকায় তারা সঠিক আয় ও ব্যয় নিরুপণ করতে পারেননি। তারা নিজেদের ইচ্ছেমতো অসত্য তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন প্রদান করে গোঁজামিল দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। প্রধান শিক্ষিকা রাশেদা বেগম বলেন, তার বিরুদ্ধে তদন্ত কমিটির আনা অভিযোগের যে জবাব তিনি দিয়েছেন সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুস সামাদ মিয়া দৈনিক শিক্ষাকে বলেন, আভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারনে একটি মনগড়া কমিটি দিয়ে অডিট করা হয়েছে। যারা অডিট করেছে তারা কিছুই জানেন না। ব্যাংক স্টেটমেন্টসহ কাগজপত্র পরীক্ষা করে দেখা গেছে কোনো দুর্নীতি হয়নি। অডিট কমিটিতে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিনিধিত্ব থাকার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিলে আবদুস সামাদ মিয়া বলেন শিক্ষা কর্মকর্তার প্রতিনিধিও কিছু জানেন না। শিক্ষা দপ্তরের সুনাম নষ্ট হওয়ায় তাকে জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ভৎসনা করেছেন।
২০১৬-১৭ অর্থ বছরে হাফিজা খাতুন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের আয়-ব্যয়ে গড়মিল প্রথম ধরা পড়ে অডিট কমিটির চোখে। পরে এরই প্রেক্ষিতে গঠন হয় তদন্ত কমিটি। তাদের প্রতিবেদনেও স্পষ্ট হয় আয়-ব্যয়ে অনিয়মের বিষয়টি। অনিয়ম-গড়মিলের সন্ধান ও অনুসন্ধানের কারণে দুই কমিটির প্রধানকেই পরে ভোগান্তির শিকার হতে হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। অডিটে আয়-ব্যয় নিয়ে আপত্তি তোলার পর প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েন কমিটির আহ্বায়ক ও বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান। বিভিন্ন অভিযোগ এনে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর তাকে বহিষ্কারের দাবিতে ছাত্রীদের রাস্তায়ও নামানো হয়। অপরদিকে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক দেলওয়ার হোসেন বাচ্চুকেও ভোগান্তিতে ফেলা হয় অন্য কৌশলে। বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে দেলওয়ার হোসেন বাচ্চু ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দ থেকে বিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত রয়েছেন।
২০০৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে একনাগাড়ে ২০১৮ পর্যন্ত তিনি ম্যানেজিং কমিটিতেও ছিলেন। তবে দাতা নয় এমন অভিযোগে চলতি বছর ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনের আগে আগে ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় দেলওয়ার হোসেন বাচ্চুকে। অভিযোগ রয়েছে যাতে বিদ্যালয়ের সাথে দেলওয়ার হোসেন বাচ্চুর কোনো সম্পৃক্ততা না থাকে সেটা নিশ্চিত করতেই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে দাতা ভোটারের তালিকা থেকে।