রাণীনগর উপজেলার ভান্ডার গ্রামে ঐতিহ্যবাহী কামতা এসএন (সত্যেন্দ্রনাথ) উচ্চ বিদ্যালয়টি ১০৩ বছর ধরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছে। বিদ্যালয়টি রবীন্দ্র নিদর্শন এবং সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় তত্কালীন সময়ে দ্বিতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বিদ্যালয়টিতে ষষ্ঠ থেকে ১০ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা দেওয়া হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯১৩ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়।
বিদ্যালয়টিতে বর্তমানে ৫’শ ৩০ জন শিক্ষার্থী পাঠ গ্রহণ করে। বিদ্যালয়ে মোট ১৪ জন শিক্ষক ও ছয়জন কর্মচারী কর্মরত আছেন। বিদ্যালয়ে নতুন ও পুরাতন মিলে মোট ১৮টি কক্ষের মধ্যে পাঠদান চলে ১০টিতে। বিদ্যালয়ে মেয়েদের জন্য পুরাতন জরাজীর্ণ মাটির কক্ষ কমনরুম হিসাবে ব্যবহার করছে ঝুঁকি নিয়ে। বিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে এই জরাজীর্ণ কমনরুম বার বার রং ও জোরাতালি দিয়ে সংস্কার করে ব্যবহার করা হচ্ছে। কখন যে শিক্ষার্থীদের উপর ভেঙে পড়ে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৮৮৫ সালের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পৈতৃক সূত্রে পাওয়া কালীগ্রাম পরগনার জমিদারি দেখাশুনার জন্য ভান্ডার গ্রামে স্থাপন করেন দ্বিতীয় কাছারি বাড়ি। এই কাছারি বাড়ি এলাকার জমিদারীর ম্যানেজার ছিলেন শিক্ষানুরাগী বাবু প্যারী মোহন রায়। তারই সার্বিক প্রচেষ্টার ফলে এই বিদ্যালয়টি এলাকার মানুষের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিশ্বাস করতেন প্রজাদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষার আলো ছাড়া প্রজাদের সার্বিক উন্নয়ন একেবারেই সম্ভব নয়। ওই উপলব্ধি থেকেই স্থানীয় কিছু শিক্ষানুরাগী তত্কালীন সমাজ সেবক ও পঞ্চপ্রধান মৌলভী মো. ইকিমুল্লাহ ও স্থানীয় পন্ডিতদের সহায়তায় প্রত্যন্ত ভান্ডার গ্রামে বিশ্বকবির ভাই সত্যেন্দ্রনাথের (এসএন) নামে আদর্শ এ বিদ্যাপিঠ প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠার সময় রবি ঠাকুরের ভাই বিদ্যালয়ের নামে এক একর ৯৪ শতক জমি দান করেন। তাই তার নাম অনুসারে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় কামতা সত্যেন্দ্রনাথ (এসএন) উচ্চ বিদ্যালয়।
আদর্শ এ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা নিয়ে এলাকার অনেকেই আজ দেশ-বিদেশসহ নিজ দেশের বিভিন্ন বিভাগে ঊর্ধ্বতন পদে কর্মরত থেকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে জ্বলছেন আর বিশ্বের মাঝে আলোকিত করেছেন অজপাড়া গ্রামের এই আদর্শ বিদ্যালয়টির নাম। এই আদর্শ বিদ্যাপীঠ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন বর্তমানে রংপুরের মহিলা এমপি ডালিয়া, ডাক্তার ইফাত নাইনি ফারাহ, বাংলা ভিশন টেলিভিশন ও মানবকণ্ঠ পত্রিকার নওগাঁ জেলা প্রতিনিধি মো. বেলায়েত হোসেনসহ আরোও অনেকেই। কিন্তু শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে গৌরবোজ্জ্বল মুকুট মাথায় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে যে বিদ্যাপীঠ সেই ঐতিহাসিক বিদ্যালয়টিতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানোর কোনো পদক্ষেপ আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি।
শিক্ষার্থীদের সংখ্যায় বিদ্যালয়টিতে আধুনিক মানসম্মত পাঠদান কক্ষের ব্যাপক সংকট। ২০০৩ সালের পর থেকে বিদ্যালয়ে আর কোনো নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়নি। যার কারণে পুরাতন কক্ষেই শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
২০০৪ সালে এখানে খোলা হয়েছে ভোকেশনাল (কারিগরি) শাখা। প্রত্যন্ত এলাকার শত শত শিক্ষার্থী এ বিদ্যাপীঠ থেকে কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই কারিগরি শাখাটি এমপিওভুক্ত না হওয়ায় এ বিভাগের শিক্ষক ও কর্মচারীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন।
কারিগরি শাখার শিক্ষক মো. ওয়াদুদ হোসেন জানান, এ শাখাটি এক দশকেও এমপিওভুক্ত না হওয়ায় আমরা চারজন শিক্ষক ও দু’জন কর্মচারী পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। এত প্রতিকূলতার পরও প্রতিবছর আমাদের এ শাখায় শতভাগ পাসের হার অব্যাহত আছে।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মো. সামছুর রহমান বলেন, আমি এ আদর্শ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম বলে গর্বিত। আমি বর্তমানে এই বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হয়ে চেষ্টা করে যাবো এই ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপীঠের সার্বিক উন্নয়নের জন্য।
বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমান প্রধান শিক্ষক সরদার মো. আব্দুল হামিদ জানান, আমি কখনো ভাবতে পারিনি যে আমি এই ঐতিহ্যবাহী আদর্শ বিদ্যাপীঠের ছাত্র থেকে শিক্ষক হবো। এটা জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সবসময় চেষ্টা করি এ বিদ্যাপীঠ থেকে প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত করে শিক্ষার্থীদের আগামীর জন্য তৈরি করতে।