প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীই বিনা মূল্যে বই পায়। এ তিন ধাপে শিক্ষার্থীর সংখ্যা চার কোটির ওপরে। বছরের প্রথম দিনেই তাদের হাতে তুলে দেওয়া হয় প্রায় ৩৩ কোটি পাঠ্য বই। সাত বছর ধরে কাজটি করছে সরকার। শুধু বই সরবরাহ নয়, সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এমডিজি) শিক্ষা-সংক্রান্ত সব লক্ষ্যই অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এমডিজি অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষায় ছেলে-মেয়ে সমতা অর্জনের কথা ছিল। সেই লক্ষ্য ২০১২ সালেই অর্জিত হয়েছে।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিনা মূল্যের বই, উপবৃত্তি, স্কুল ফিডিং প্রভৃতির সুফল পাওয়া যাচ্ছে এখন। বছরের প্রথম দিনেই শিক্ষার্থীরা হাতে বই পাওয়ায় শিক্ষার প্রতি তাদের আগ্রহ বেড়েছে। স্বাভাবিকভাবে মেয়েদের আগ্রহও বেড়েছে। এতে বাল্যবিবাহ কমেছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ‘শতভাগ শিশুকে স্কুলে নিয়ে আসা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সফল হয়েছি। আমরা প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ছেলে-মেয়ের সমতাও অর্জন করেছি। এসব ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছে বিনা মূল্যে বই বিতরণ কর্মসূচি। কারিগরি শিক্ষায়ও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। বলতে পারি, শিক্ষায় গত কয়েক বছরে যুগান্তকারী পরিবর্তন হয়েছে। এখন দরকার শিক্ষার মানের উন্নয়ন। মান বেড়েছে, তবে এখনো আন্তর্জাতিক মানের নয়। আমাদের দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে।’
সেনেগালের রাজধানী ডাকারে ২০০০ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্ব শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত ‘ডাকার ঘোষণায় স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয় আয়ের কমপক্ষে ৬ শতাংশ বা জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশও প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারেনি, তবে তারা আমাদের চেয়ে এগিয়ে আছে। এর পরও এমডিজির বেশ কিছু লক্ষ্য অর্জনে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে। শিক্ষাবিদরা বলছেন, সরকার যদি ‘ডাকার প্রতিশ্রুতি’ রক্ষা করতে পারত, তাহলে ২০২১ সালের আগেই বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হতে পারত।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের অংশগ্রহণের হার ৫১ শতাংশ ও ছেলেদের ৪৯ শতাংশ। মাধ্যমিকে মেয়ে ৫৩ শতাংশ ও ছেলে ৪৭ শতাংশ। আগামী ছয়-সাত বছরের মধ্যে উচ্চশিক্ষায়ও ছেলে-মেয়ে সমতা অর্জিত হবে। শিক্ষা খাতের বিপ্লবের কারণেই এমডিজির লক্ষ্য পূরণে সরকারকে বেগ পেতে হয়নি। ২০০৯ সালে ৯ শতাংশ শিশু বিদ্যালয়ে যেত না। যারা যেত তাদের ৪৮ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে যেত। এখন প্রায় শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার ৪৮ শতাংশ থেকে ২১ শতাংশে নেমেছে।
গত সাত বছরে প্রায় ২৬ কোটি শিক্ষার্থীর মাঝে ১৯০ কোটি বই বিনা মূল্যে বিতরণ করা হয়েছে। ২০১৬ শিক্ষাবর্ষে প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, এবতেদায়ি, মাধ্যমিক, দাখিল ও কারিগরি বিদ্যালয়ের চার কোটি ৪৪ লাখ ১৬ হাজার ৭২৮ শিক্ষার্থীকে মোট ৩৩ কোটি ৩৭ লাখ ৬২ হাজার ৭৭২টি বই দেওয়া হবে।
আগামীর চ্যালেঞ্জ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন। এ জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সব শিশুর জন্য প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে; বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত সম্প্রসারণ করতে হবে; অধিকতর শিক্ষার জন্য শিক্ষার্থীদের দক্ষতা ও যোগ্যতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষায় ঝরে পড়ার হার শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে।
কারিগরি শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি : সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার উন্নয়নের বড় কারণ কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন। সিঙ্গাপুরে এ শিক্ষার হার ৬৫ শতাংশ ও মালয়েশিয়ায় ৪০ শতাংশ। যুক্তরাজ্য, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও ইন্দোনেশিয়ায় কারিগরি শিক্ষার হার ১৭ থেকে ৫৮ শতাংশ। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার ছিল ১ শতাংশেরও কম। গত ছয় বছরে এ খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে—হার ১০ শতাংশে পৌঁছেছে। ২০২০ সালের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার হার ২০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছে সরকার।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল, পলিটেকনিক ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ সাত হাজারের বেশি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান চলছে। মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে ২০ শতাংশ কোটা চালু করা হয়েছে। মেয়েদের জন্য সাতটি বিভাগে সাতটি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটও করা হয়েছে। কারখানার সঙ্গে সংগতি রেখে পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। ফলে চাকরির চাহিদা অনুযায়ী পাঠ নেওয়া যাবে।
শিক্ষায় শৃঙ্খলা : দীর্ঘদিন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা, কলেজে ভর্তি ও ক্লাস শুরুর নির্ধারিত সময় ছিল না। পরীক্ষার ফল বের হতে তিন-চার মাস সময় লাগত। এভাবে মাস ছয়েক সময় নষ্ট হয়ে যেত। এখন সব কিছুতেই শৃঙ্খলা এসেছে। কয়েক বছর ধরে সময়মতো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি এসএসসি ও ১ এপ্রিল এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়। ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ করা হয়। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ক্লাস শুরু হয় ১ জানুয়ারি; উচ্চ মাধ্যমিকে শুরু হয় ১ জুলাই।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম : কয়েক বছর আগেও গ্রামের শিক্ষার্থীরা ল্যাপটপ বা কম্পিউটার সম্পর্কে জানত না। এখন প্রায় প্রতিটি স্কুলে রয়েছে এ যন্ত্র। মাধ্যমিক শিক্ষার ২৩ হাজার ৩৩১টি প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। ডিজিটাল কনটেন্ট, ভিডিও, ইন্টারনেটের মাধ্যমে পুরো বিশ্ব এখন শিক্ষার্থীদের হাতের কাছে। ইতিমধ্যে সাড়ে ছয় হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডিজিটাল ক্লাসরুম স্থাপন করা হয়েছে।
ডিজিটাল বই : এত দিন ডিজিটাল বই বলতে পিডিএফ ফরম্যাটকেই বোঝাত। বেশ কয়েক বছর আগে এটা চালু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। কিন্তু এটা আসলে ডিজিটাল বই নয়। ছাপা বইয়ের সঙ্গে এর তেমন পার্থক্য নেই। চলতি বছর আক্ষরিক অর্থেই ডিজিটাল বই পাবে শিক্ষার্থীরা। পাঠ্যসূচিতে যেসব বিষয় থাকবে এর সবই কম্পিউটারের পর্দায় দেখতে পাবে শিক্ষার্থীরা। আগামী মার্চের মধ্যে প্রথম থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল বই হাতে পাবে। প্রাথমিকের প্রথম শ্রেণির বাংলা, ইংরেজি, গণিত; দ্বিতীয় শ্রেণির ইংরেজি ও গণিত; তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান, বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়—মোট ১৭ বিষয়ের ডিজিটাল বই তৈরি করা হবে। ষষ্ঠ শ্রেণির সব বিষয়ের ডিজিটাল বই তৈরি করা হবে। ভবিষ্যতে অন্যান্য শ্রেণির বইও ডিজিটাল করা হবে।
উচ্চশিক্ষার বিস্তার : বর্তমানে প্রায় ৩১ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। ৩৭টি সরকারি ও ৮৩টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। মোট শিক্ষার্থীর ৬৩ শতাংশ পড়ছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণার সুযোগও বাড়ছে। একসময় বছরে প্রায় ৪০ হাজার শিক্ষার্থী ভারতে উচ্চশিক্ষা নিতে যেত, এখন যায় না বললেই চলে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক হাজার ৬৩০ জন বিদেশি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।
দরকার মানের উন্নয়ন : গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসিতে জিপিএ ৫ পাওয়া ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীই ফেল করে। ইংরেজি বিভাগে প্রথমবার পাস করেছিল মাত্র দুজন শিক্ষার্থী। তখন প্রশ্ন উঠেছিল শিক্ষার মান নিয়ে। শিক্ষাবিদরা বলেন, শিক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের সংখ্যা বাড়লেও মান বাড়ছে না।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যক্ষ কাজী ফারুক বলেন, ‘বেশি বেশি পাস করা আর জিপিএ ৫ পাওয়া মানে শিক্ষার মান বেড়ে যাওয়া নয়। এটা আলাদা ব্যাপার। তবে বাংলাদেশের শিক্ষা খাতের অগ্রগতিকে অস্বীকার করা যাবে না। শিক্ষার মান বাড়াতে সরকারকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। শিক্ষা পদ্ধতিকেই সংস্কার করতে হবে।’
(খবর: দৈনিক কালের কন্ঠ, ০৯ জানুয়ারি ২০১৬)