শিশুর বইপড়া ও জানার জগৎ - দৈনিকশিক্ষা

শিশুর বইপড়া ও জানার জগৎ

মাছুম বিল্লাহ |

‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’—কবি গোলাম মোস্তফার এই বাণীর মধ্যেই লুক্কায়িত আছে শিশুদের প্রতি আমাদের কিরূপ আচরণ করতে হবে, কী কী শিক্ষা দিতে হবে এবং কেন শিক্ষা দিতে হবে। শিশুরাই জাতির ভবিষ্যৎ, তাদের মাধ্যমেই এই বিশ্বের নিরন্তর এগিয়ে যাওয়ার নিয়ম প্রতিফলিত হয়। যেসব শিশু দিব্যি মনের আনন্দে আর স্বাভাবিক চঞ্চলতা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরই যখন পড়তে বসানো হয় তখন দেখা যায় তারা পড়া বাদ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের দুষ্টুমিতে জড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ধরনের বায়না ধরে, ঘুমের ভান করে। এই সময় বাবা কিংবা মা বিরক্ত হয়ে তাদের সঙ্গে মেজাজ দেখান, রাগারাগি করেন, এমনকি গায়ে হাত দিয়ে শাসন করেন। আসলে তাতে ফল হয় উল্টো। পড়ার বিষয়টি তার কাছে যেহেতু আনন্দদায়ক নয় এবং তার মতো করে কিছু হয়তো লেখা নেই কিংবা সেভাবে পড়ানো শুরু করা হয়নি বিধায় তারা এ ধরনের আচরণ করে। কাজেই বিষয়টি মা-বাবাকে অত্যন্ত সচেতনতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। কিভাবে তাদের আনন্দ দেওয়া যায় এবং আনন্দের মাধ্যমে পড়ানো যায় সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তারা তাদের চারপাশে যা দেখে তাই শেখে। কাজেই শিশুদের প্রতি আমাদের আচরণ করতে হবে খুব সাবধানতার সঙ্গে।

একজন বাবা কিংবা মা শিশুকে পড়তে বসিয়ে যদি অন্য কোনো কাজে মনোনিবেশ করেন, তাহলে শিশুটিও কিন্তু ব্যাপারটি সেভাবে নেবে। খেলার ছলে, ছবি দেখিয়ে, গল্প বলে শিশুকে পড়ালে তারা মনোযোগী হবে, পড়তে আগ্রহী হবে।

অনেক অভিভাবকের সাধারণ একটি অভিযোগ হচ্ছে, ‘আমার বাচ্চা একদম পড়তে চায় না, শুধু খেলাধুলা আর টিভি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। ’ আসলে একটি শিশুর এই বয়সে ওগুলো করাটাই স্বাভাবিক। খেলার মতো করে যদি তাকে পড়ানো যায় তাহলেই সে পড়বে। এটির আর একটি প্রাকৃতিক কারণ হচ্ছে তাদের শিক্ষার জন্য শুধু বইয়ের মধ্যে তাদের আটকে না রাখা। ছবি, রং, প্রাকৃতিক উপায়ে বস্তুর সঙ্গে তাদের পরিচিত করানো, মৌখিকভাবে বিষয়গুলো সম্পর্কে তাদের ধারণা দেওয়া। তারা সেগুলো মনে রাখতে পারবে। কোন বস্তুর কী গুণ, কোন প্রাণীর আচরণ কী রকম ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তাদের ধারণা দিতে হবে এবং প্রয়োজন হলে অঙ্গভঙ্গি করে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে, এই বিষয়গুলো তাদের মনে গেঁথে থাকবে। এভাবেই তারা শিখবে কিন্তু অনেক অভিভাবক মনে করেন বাচ্চাকে সব কিছু বই পড়েই শিখতে হবে, বিষয়টি আসলে তা নয়। শিশুর শিক্ষা হতে হবে আকর্ষণীয় ও প্রাকৃতিক উপায়ে।

শিক্ষা সাধারণত তিনটি উপায়ে অর্জিত হয়। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক। শিক্ষার সুযোগের বিষয়টি অনেকটা নির্ভর করে সাক্ষরতার ওপর। প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক, অনানুষ্ঠানিক বা উপানুষ্ঠানিক যেকোনো শিক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি হিসেবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে অবশ্যই সাক্ষরতা জ্ঞান অর্জন করতে হয়। সাক্ষরতার সংজ্ঞা বিভিন্নভাবে নানা দেশে অনেক আগে থেকেই প্রচলিত থাকলেও ইউনেসকো ১৯৬৭ সালে প্রথম সাক্ষরতার একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা চিহ্নিত করে। তবে পরবর্তী সময়ে দেখা যায়, প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞার পরিধি ও ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে সাক্ষর হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য কমপক্ষে তিনটি বিষয় বিবেচনা করা হয়। শিশু  নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট ছোট বাক্য লিখতে পারে কি না এবং সে তার দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারে কি না। শিশুদের সাক্ষরতা জ্ঞান খুব কম বয়সেই শুরু হয় এবং বিদ্যালয়ে কিছু অর্জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। ভাষা ও অক্ষরের সঙ্গে যে শিশুর অভিজ্ঞতা বা সংস্পর্শ যত কম, তার সমস্যা তত বেশি।

ছোটবেলা থেকেই স্কুলের বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়ার অভ্যাস শিশুদের মধ্যে তৈরি করতে হবে। আমরা অনেকে মনে করি, গল্পের বই পড়া মানে ক্লাসে অমনোযোগী হওয়া, প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকা। আসলে বিষয়টি ঠিক তা নয়। আমাদের বুঝতে হবে, স্কুলের বই শিশুকে তার ভবিষ্যৎ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা দেয় না। আর ক্লাসের পড়াশোনা নিয়ে বিশেষ করে প্রথম ও দ্বিতীয় হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতা করা কতটা যুক্তিসংগত সে বিষয়টিও ভেবে দেখতে হবে। সুকুমার রায়ের একটি কবিতা হয়তো পাঠ্য বইয়ে আছে। সেই একটি কবিতা পড়া আর সুকুমার রায়ের পুরো একটি বই পড়া এক কথা নয়। যে শিশুটি সুকুমার রায়ের কবিতা সম্পর্কিত পুরো একটি বই পড়ে ফেলবে সুকুমার রায় সম্পর্কে তার ধারণা অবশ্যই আলাদা হবে। শিশুরা রূপকথার বই পড়তে বেশি পছন্দ করে। ঠাকুরমার ঝুলি, ডিজনিল্যান্ডের রঙিন বই যেকোনো শিশুকে আকৃষ্ট করবে। আমাদের দেশীয় শিশুসাহিত্যও তাদের পড়তে দিতে হবে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বইয়ের সংস্পর্শে ও বই পড়ে শোনানোর মধ্য দিয়ে বড় করে তোলা শিশুদের সঙ্গে পরে তাদের সহজে ভাষা শেখা ও স্কুলে সাফল্যের সংযোগ রয়েছে। ২০১৫ সালে পেডিয়াট্রিকস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানা গেছে, যেসব শিশুর বাসায় বেশি বই আছে এবং শিশুকে বেশি বই পড়ে শোনানো হয়, তাদের মস্তিষ্কের বাঁ অংশ উল্লেখযোগ্য হারে সক্রিয় হয়ে ওঠে। পেরিয়েটাল-টেম্পোরাল-অক্সিপেটাল অ্যাসোসিয়েশন করটেক্স নামে অভিহিত মস্তিষ্কের এই অংশে শব্দ ও চোখে দেখার অনুভূতির সংমিশ্রণ ঘটে। একটু বড় শিশুরা শব্দ করে পড়লে মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপিত হয়। কিন্তু শিশু চিকিৎসাবিদরা লক্ষ করেছেন, খুব ছোট বাচ্চাদের বইয়ের গল্প পড়ে শোনালেও একইভাবে মস্তিষ্কের এই অংশ উদ্দীপিত হয়। মায়ের মুখে গল্প শোনার সময় বাচ্চা মনে মনে কল্পনার জাল বোনে। তার কথার সঙ্গে সঙ্গে কল্পনার একটা যোগসূত্র স্থাপনের দক্ষতা অর্জিত হয়। গল্পের বইয়ে অনেক নতুন শব্দ থাকে, তাই গল্প পড়ে শোনালে বাচ্চাদের শব্দভাণ্ডার উন্নত হয় এবং কল্পনাশক্তি বাড়ে। তার ফল বিদ্যালয়েও পড়ে। শিশুদের বয়স যখন ছয়-সাত তখন তারা লিখিত যা পাবে তাই পড়তে চাইবে, যদি ছোট থেকেই তাদের সেভাবে গড়ে তোলা হয়। আট-নয় বছর বয়সে তারা একেকজন নিয়মিত পাঠকে পরিণত হবে।

মাছুম বিল্লাহ: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক, ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত সাবেক ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0082559585571289