অবৈধভাবে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাস/স্ট্যাডি সেন্টারগুলোকে বৈধতা দেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য পাঁচ বছর আগে করা ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় বা প্রতিষ্ঠানের শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টার পরিচালনা বিধিমালা’ সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। চলতি মাসের শেষে অথবা আগামী মাসের প্রথম দিকে সংশোধিত বিধিমালার খসড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।
জানা যায়, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে অতি গোপনে বিধিমালাটি জারি করা হয়েছিল। কিন্তু শাখা ক্যাম্পাস ও স্টাডি সেন্টার করতে অসংখ্য উদ্যোক্তার চাপ রয়েছে। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মালিকদের চাপে ওই বিধিমালা স্থগিত করতে বাধ্য হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে চলতি বছরের এপ্রিল মাসে বিধিমালাটি সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তখন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির উপস্থিতিতে ইউজিসির ঊর্ধ্বতনদের নিয়ে একটি সভা করা হয়। এরপর বিধিমালা সংশোধনের জন্য ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আখতার হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি করা হয়।
দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, অবৈধভাবে পরিচালিত শাখা বা স্ট্যাডি সেন্টারগুলোর রয়েছে একটা মোর্চা। এদের নেপথ্যে রয়েছে শিক্ষা মাফিয়া ক্যামরিয়ানসহ কিছু শিক্ষা ব্যাবসায়ী ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কতিপয় বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তা।
ইউজিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর পুরানা পল্টন, ধানমণ্ডি, উত্তরা, লালমাটিয়া, বারিধারাসহ কয়েকটি এলাকার বিভিন্ন অবৈধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এভাবে সনদ বিক্রি অব্যাহত রয়েছে।
এর আগেও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সনদ বিক্রি করা ৫৬টি অবৈধ উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরি করেছিল ইউজিসি। জনস্বার্থে ওই প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেওয়া হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। আর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আদালতের স্থগিতাদেশ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ইউএসএ, ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেদার পিএইচডি ডিগ্রি বিক্রি করছে বলে একটি সংস্থা ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে।
কমিশনের অধ্যাপক আখতার হোসেন সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমাদের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে আরো দু-একটি মিটিংয়ের প্রয়োজন হবে। আশা করছি, খুব শিগগির আমরা সংশোধিত বিধিমালার খসড়া মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে পারব। সংশোধিত বিধিমালা জারি হলে শুধু মানসম্মত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ক্যাম্পাসই এ দেশে আসতে পারবে।’
কমিশনের এই সদস্য এখন এই কথা বললেও বাস্তবে কয়েকডজন মানহীন শাখা ক্যাম্পাস/স্ট্যাডি সেন্টার কয়েকবছর ধরে অনার্স/মাস্টার্স/পিএইচডিসহ বিভিন্ন ধরণের সনদ বিক্রি করে আসছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের একজন পিএস এই সব অবৈধ বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখার সাথে যুক্ত ছিলেন।
ইউজিসি সূত্রে জানা যায়, মূল বিধিমালার বেশ কিছু জায়গায় সংশোধন আনা হচ্ছে। সংশোধিত বিধিমালায় স্টাডি সেন্টার রাখা হচ্ছে না, শুধু শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীদের এক সেমিস্টার মূল ক্যাম্পাসে পড়তে হবে। শাখা ক্যাম্পাসেও বোর্ড অব গভর্ন্যান্স বা ট্রাস্টি বোর্ড থাকতে হবে। বিদেশি শিক্ষক নিয়োগসহ অন্যান্য কাজে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ইউজিসির মতামত নিতে হবে। আগের বিধিমালায় শাখা ক্যাম্পাসের জন্য নিজস্ব বা ভাড়া ভবনে ২৫ হাজার বর্গফুট জায়গা ও ব্যাংকে পাঁচ কোটি টাকার সংরক্ষিত তহবিল থাকার কথা বলা হয়েছিল। সেখানেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে।
এ ছাড়া আগের বিধিমালায় বলা হয়েছিল, এই বিধিমালা জারির আগে স্থাপিত ও পরিচালিত সব শাখা ক্যাম্পাস ও স্টাডি সেন্টারকে বিধিমালা জারির তারিখ থেকে পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে পরিদর্শন ফি দাখিল করতে হবে। এর আগে কোনো শিক্ষার্থী কোনো শাখা ক্যাম্পাস বা স্টাডি সেন্টারে পরীক্ষা দিয়ে ডিগ্রি অর্জন করলে সেগুলোর প্রত্যয়ন দেবে ইউজিসি। কিন্তু সংশোধিত বিধিমালায় বলা হচ্ছে, যারা আগে থেকেই কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার পরিচালনা করছে, তারা ফি দিয়েও বৈধ হতে পারবে না। তাদের ইস্যু করা সার্টিফিকেটের বৈধতাও দেবে না ইউজিসি।
জানা যায়, দেশে বর্তমানে শতাধিক স্টাডি সেন্টার/শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা করা হচ্ছে। ইউজিসি থেকে বারবার এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও তারা তা মানছে না। এমনকি কয়েক বছর আগে ৫৬টি স্টাডি সেন্টার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছিল ইউজিসি। সংশোধিত বিধিমালা জারির পর অনুমোদনহীন অবস্থায় চলা এসব স্টাডি সেন্টার আইনগতভাবেই নিষিদ্ধ হবে।
দেশে এখন ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চালু আছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১৫ থেকে ২০টি বাদে বাকি সবই মানহীন। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই ভর্তি হলে পড়ালেখা ছাড়াই ভালো ফলাফলের সার্টিফিকেট দেওয়ার গ্যারান্টি দেয়। এই অবস্থায় দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে শাখা ক্যাম্পাস আসা নিয়ে দুই ধরনের বক্তব্য রয়েছে সংশ্লিষ্টদের। কেউ বলছে, অখ্যাত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট বিক্রির দ্বার উন্মোচিত হবে। আর কেউ বলছে, শুধু মানসম্মত নামি বিশ্ববিদ্যালয় এলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে। এতে উচ্চশিক্ষার মান বাড়বে।
জানা যায়, বাংলাদেশে যাতে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা/ক্যাম্পাস চলতে পারে সে লক্ষ্যে শিক্ষা মাফিয়ারা কতিপয় নামধারী সাংবাদিকদের দিয়ে কৌশলে পক্ষে রিপোর্ট করাচ্ছে। আবার কয়েকটি জাতীয় পত্রিকা ও টিভিতে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দিয়ে আসছে। এর ফলে ওইসব পত্রিকা এদের অবৈধ কার্যক্রম নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ ও প্রচার করে না। আবার একটি বড় পত্রিকা ইনিয়ে-বিনিয়ে এইসব সনদ বিক্রেতাদের পক্ষে সাফাই গায়।
জানা যায়, ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে বিধিমালাটি জারির পর শাখা ক্যাম্পাস ও স্টাডি সেন্টার অনুমোদনের জন্য ১৪ জন বাংলাদেশি উদ্যোক্তা আবেদন করেন। এরপর নানা যাচাই শেষে এডুকো বাংলাদেশের মোনাস কলেজ প্রা. লি. অস্ট্রেলিয়া স্টাডি সেন্টার, ব্যাক ইন্টারন্যাশনালের ইউনিভার্সিটি অব ডার্বি স্টাডি সেন্টার ও সেন্টার ফর ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ইনফরমেশনের লন্ডন স্কুল অব কমার্স স্টাডি সেন্টার অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠায় ইউজিসি। তবে বিধিমালাটি স্থগিত হওয়ার পর ওই স্টাডি সেন্টার আর অনুমোদন পায়নি। তবে সংশোধিত বিধিমালায় স্টাডি সেন্টার না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় এই তিনটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনের সুযোগ বন্ধ হচ্ছে।
আবেদনকারীরা নিজ খরচে ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিদেশে ঘুরিয়ে এনেছে বলেও জানা যায়।