আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। শিক্ষামন্ত্রীও এর পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। ভর্তি পরীক্ষার জন্য একটি খসড়া নীতিমালাও প্রণয়ন করা হয়েছে। যদিও সমন্বিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি দেশের বড় ও পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। তাই বিষয়টি নিয়ে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনার জন্য ফের বৈঠক ডেকেছে ইউজিসি। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে পরিচালিত চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বিষয়ে এখনো দ্বিধায় রয়েছে। ইউজিসির পক্ষ থেকে ঘোষণা এলেও এসব বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখতে স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা নিতে চায়, যদিও গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষায় অংশ নিতে সরকারসহ বিভিন্ন মহলের চাপও রয়েছে বলে জানিয়েছেন এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও শিক্ষক নেতারা।
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে সিদ্ধান্ত আগামীকাল একাডেমিক কাউন্সিলের সভা ডেকেছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম বলেন, এ ব্যাপারে এখনো আমাদের সিদ্ধান্ত হয়নি। ৪ ফেব্রুয়ারি একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বান করা হয়েছে, সেখানে বিষয়টি উত্থাপন করা হবে। সবার মতামতের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। এছাড়া এ বিষয়ে ৭৩-এর অ্যাক্ট অনুসারে চলা চারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একমত হওয়ার ব্যাপার আছে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। সবার সিদ্ধান্তের ওপরই বিষয়টি নির্ভর করছে।
আরও পড়ুন: সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় ভোগান্তি কমবে : শিক্ষামন্ত্রী
শিক্ষার্থীবান্ধব সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা, তবে...
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে ঢাবির মিশ্র প্রতিক্রিয়া
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা একটি সাহসী সিদ্ধান্ত
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হবে দুই দিন, আবেদন ১০টিতে
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে ঢাবি শিক্ষকের যত যুক্তি
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা : বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় প্রাপ্তিতে মেধাই ভিত্তি
একই সুরে কথা বলেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. এএ মামুনও। তিনি বলেন ঢাবি, জাবি—এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা হলে এ স্ট্যান্ডার্ড বজায় থাকবে কিনা সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। মফস্বলের নতুন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেভাবে ছাত্র ভর্তি ও শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়, তার সঙ্গে বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে মিলিয়ে ফেললে ব্যাপারটা কেমন হবে? তার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় যে সিদ্ধান্ত হবে, আমরা তাকে স্বাগত জানাব।
ইউজিসির ঘোষণার পর থেকেই এ সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক। যদিও এখন পর্যন্ত গুচ্ছ পদ্ধতির পরীক্ষায় অংশগ্রহণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে একটি প্রক্রিয়া অনুসৃত হচ্ছে। এখন যদি নতুন কোনো পদ্ধতি আনতে হয়, সেক্ষেত্রে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সিন্ডিকেট, সিনেট, ডিনস কমিটিসহ বিভিন্ন ধরনের ফোরাম রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন ধাপে আলোচনার মাধ্যমে সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। হুট করে কোনো ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেয় না। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও আলোচনার সুযোগ রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়নি।
ইউজিসির সঙ্গে অনুষ্ঠিত সভায় গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিপক্ষে অবস্থান ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। তবে সব বিশ্ববিদ্যালয় একমত হলে এ প্রক্রিয়ায় আসতে মত রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য অধ্যাপক শিরীণ আখতার এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে চলে। ঢাকায় ইউজিসির সঙ্গে বৈঠকে বলেছি, আমরা গুচ্ছ পদ্ধতিতে যেতে পারব না। আমাদের একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিসিপ্লিন, সিলেবাস একেক রকম। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত হলে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় যেতে আমরা রাজি আছি। মহামান্য রাষ্ট্রপতিরও এক্ষেত্রে নির্দেশনা রয়েছে। তাই সবাই যদি চায় আমাদের আপত্তি নেই।’
সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা বিষয়ে দ্বিধায় রয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ও (বুয়েট)। এ বিষয়ে আলোচনা করতে আজ ইউজিসি সদস্যদের সঙ্গে সভা করবে বুয়েটের একটি প্রতিনিধি দল। ইউজিসির সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘যে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় শুরুতে সমন্বিত ভর্তি প্রক্রিয়ায় আসতে রাজি হয়নি, আমরা তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। বুয়েটের একটি প্রতিনিধি দল কাল ইউজিসিতে আসবে। এছাড়া ১২ ফেব্রুয়ারি ১৩টি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে বসবে ইউজিসি। ওইদিনই বলা যাবে, এ প্রক্রিয়ায় কারা থাকছেন বা থাকছেন না। তবে আমরা চাই, দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এ প্রক্রিয়ায় আসুক।’
এদিকে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় একযোগে গুচ্ছ বা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতে একটি খসড়া প্রস্তাব প্রণয়ন করেছে ইউজিসি। ১২ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠেয় উপাচার্যদের সঙ্গে ইউজিসির সভায় এ নীতিমালা উপস্থাপন করা হবে। ভর্তি পরীক্ষার খসড়া প্রস্তাবে দেখা গেছে, ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে মেধার ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হবে। আর ভর্তির আবেদন প্রক্রিয়া হবে অনলাইনে। দেশজুড়ে একযোগে দুই দিনেই শেষ হবে সব পরীক্ষা। ভর্তি পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে মনিটরিং কমিটি গঠন করা হবে। কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান ইউজিসির সদস্য অথবা বড় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি থাকবেন। অন্য ভিসিরা সদস্য হিসেবে থাকবেন। সদস্য সচিব ভিসিদের মধ্য থেকে নির্বাচন করা হবে। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কমিটিতে প্রশাসনিক এবং কারিগরি কমিটি গঠন করা হবে। ভর্তি প্রক্রিয়া শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসন সংখ্যা কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে পাঠানো হবে। তার ভিত্তিতে মেধাতালিকা তৈরি করা হবে।
খসড়ায় আরও বলা হয়েছে, উভয় কমিটির কয়েকজন সদস্য মিলে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে। এ কমিটি বিভিন্ন বিষয়ের প্রশ্নপত্র তৈরি, ভিন্ন ভিন্ন গুচ্ছের জন্য শিক্ষার্থীদের কাছে আবেদনপত্র আহ্বান ও যাচাই-বাছাই, শিক্ষার্থীদের নামের পাশে কোড দেয়া ও মেধাতালিকা তৈরি করবে। এছাড়া স্থানীয় কমিটিতে খাতা দেখা, ফলাফল প্রক্রিয়ায় সাব-কমিটি গঠন করা হবে। কড়া নিরাপত্তার মাধ্যমে পরীক্ষা আয়োজন করা হবে। পরীক্ষা গ্রহণের আগে এসব কমিটি গঠন করা হবে। অন্যদিকে স্থানীয় কমিটি পরীক্ষা নেয়া, খাতা মূল্যায়নে কোডিং, ফল প্রণয়ন প্রক্রিয়াকরণ ও তা যথাস্থানে পাঠানোর কাজ করবে।
বিভিন্ন পর্যায়ে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কমাতে সমন্বিত বা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয় ইউজিসি। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৩ জানুয়ারি দেশের সব ক্যাটাগরির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠক করে ইউজিসি।
সার্বিক বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ বলেন, এ মুহূর্তের অগ্রাধিকার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার পরিবর্তে গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতি প্রবর্তন। এটা সময়ের দাবি। গুচ্ছ বা সমন্বিত পদ্ধতির ব্যাপারে আরো আলোচনায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসবে। আমাদের লক্ষ্য যেহেতু শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সাশ্রয় ও ভোগান্তি থেকে মুক্তি দেয়া হবে।