একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সাবেক নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেইল্যা রাজাকারের মুক্তি চেয়েছেন এমপিওভুক্ত জামাতপন্থী শিক্ষকরা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার খবর প্রকাশের পরপরই বেসরকারি শিক্ষক ফোরাম নামের একটি ফেসবুক পেইজের এডমিন ও এমপিওভুক্ত শিক্ষক নুরুল আলম ২৪ মার্চ সন্ধ্যায় প্রথমে সাঈদীর মুক্তি দাবি করেন। এরপর দাবির পক্ষে সারাদেশে জনমত গঠনের আহ্বান জানান নুরুল আলমের সমমনা অন্যান্য শিক্ষকরা। ফাসিঁতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেয়া রাজাকার কাদের মোল্লার পক্ষেও কমেন্ট করেন নুরুল আলম। সাঈদীকে ‘হাক্কানী আলেম’ হিসেবে অভিহিত করে তার মুক্তির পক্ষে নানা যুক্তি মন্তব্য করেন সরকারি কোষাগার থেকে নিয়মিত বেতন-ভাতা (এমপিও) পাওয়া শিক্ষকরা।
তবে, বেশ কয়েকজন শিক্ষক নুুরুল আলমের দাবির বিপক্ষে মন্তব্য করে বলেছেন, শিক্ষকদের দাবি আদায়ের একটি প্লাটফর্ম থেকে আদালতের রায়ে দণ্ডভোগরত রাজাকারের মুক্তি চাওয়া ঠিক নয়। এই প্লাটফর্মটি গঠন করা হয়েছিলো জাতীয়করণের দাবির পক্ষে কথা বলার আশ্বাস দিয়ে। যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর মুক্তির বিপক্ষে কথা বলা শিক্ষকদের নিয়েও বাজে মন্তব্য করেছেন নুরুল আলম ও সমমনা কয়েকজন শিক্ষক। নুরুল আলম বেসরকারি শিক্ষক ফোরাম নামের ফেসবুক পেইজটির অন্যতম এডমিন ও ফোরামের সদস্য। নিরপেক্ষ শিক্ষকরা বলেছেন, এই ফেসবুক পেইজ থেকে জাতীয়করণসহ বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা, তথ্য ও মতবিনিময় হওয়ার কথা।
আরো পড়ুন: ফেসবুকে করোনা নিয়ে উসকানি : সরকারি কলেজের দুই শিক্ষক বরখাস্ত
নুুরুল আলম ছাড়াও বেসরকারি শিক্ষক ফোরামের এই ফেসবুক পেইজের এডমিন/মডারেটরসহ নেতৃত্বে রয়েছেন ঢাকার একটি স্কুলে কর্মরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক এনামুল ইসলাম মাসুদ, ভোলায় কর্মরত মো: সাইদুল হাসান ও বাগেরহাটের কচুয়ার সবুজ হাসানসহ কয়েকজন। এদের মধ্যে অনেকেই আবার এটুআইয়ের করা শিক্ষক বাতায়নের সদস্য ও জেলা অ্যামবাসেডর।
এর আগে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ জুলাই সাঈদীর ভিডিও চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করার অভিযোগে রংপুরের বদরগঞ্জে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত পূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
জানা যায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেলওয়ার হোসেন সাঈদীর ওই ভিডিও চিত্র শেয়ার করেছিলেন রংপুরের বদরগঞ্জ মহিলা কলেজের প্রভাষক আহসান হাবীব। বিষয়টি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজরে আসে। তাই ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ। মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশে শিক্ষক আহসান হাবীবের কর্মকান্ডকে অপতৎপরতা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
ঢাকার বীরশ্রেষ্ঠ নুর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজের শিক্ষক আমান উল্লাহও সাঈদীকে মুক্তি দিয়ে ‘বিচক্ষণতার’ পরিচয় দেয়ার সুপারিশ করেছেন নিজ ফেসবুক পেজে।
এদিকে, গত ২৩ জানুয়ারি মাসে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার সরকারি মিডিয়া তালিকাভুক্তি বাতিল করা হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লাকে ‘শহীদ’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন প্রকাশ করার পরিপ্রেক্ষিতে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়। গ্রেফতার করা হয় সম্পাদককে।
মিডিয়া তালিকাভুক্তি বাতিল হওয়ার দৈনিক সংগ্রাম আর কোনও সরকারি বা কোনও সংস্থার বিজ্ঞাপন পাবে না। এছাড়া স্কুল-কলেজ ও মাদরাসায় নিয়োগ বিজ্ঞাপনের জন্য জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন প্রকাশের যে বাধ্যবাধকতা রয়েছে, মিডিয়া তালিকায় না থাকায় সংগ্রামে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞাপন কার্যকর হবে না।
তবে, দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, জামাত অধ্যুষিত কিছু মাদরাসা, হাইস্কুল ও কলেজে এখনও সংগ্রামে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।
এ বিষয়গুলো দেখার দায়িত্ব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর, মাদরাসা শিক্ষা অধিদপ্তর ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। কিন্তু ওই সংস্থাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতেও জামাতপন্থী কর্মকর্তারা রয়েছেন।
জানা যায়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ। ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে স্থানীয় তৃণমূল পর্যায়ের রাজাকারদের বিচার কাজ চলছে। এ ছাড়া তদন্ত কাজ এবং আসামি গ্রেপ্তারও অব্যাহত রয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত ও প্রসিকিউশন সংস্থার তথ্যমতে, ১০ বছরে ৪১ মামলার রায়ে ট্রাইব্যুনালে ৯৬ যুদ্ধাপরাধীর বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। এর মধ্যে মৃত্যুদণ্ডাদেশ (ফাঁসি) হয়েছে ৭০ জনের। আমৃত্যু সাজা হয়েছে ২৫ জনের এবং ২০ বছর সাজা হয়েছে একজনের। সর্বোচ্চ আদালতে মামলা চূড়ান্তভাবে নিষ্পত্তির পর সাজা কার্যকর হয়েছে ছয় যুদ্ধাপরাধীর। অন্যদিকে, সর্বোচ্চ আদালতে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছে আরও ২৯টি আপিল।
এদিকে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডপ্রাপ্ত কুখ্যাত সাইদীর মুক্তি দাবি করা শিক্ষকদের চিহ্নিত করে শাস্তি চেয়েছে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদ। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণট্রাস্টের সদস্য-সচিব অধ্যক্ষ মো: শাহজাহান আলম সাজু আজ ২৫ মার্চ দৈনিক শিক্ষায় পাঠানো এক বিবৃতিতে তিনি এই দাবি করেন।
তিনি বলেন, বেসরকারি শিক্ষক ফোরাম নামের ফেসবুক পেজের এডমিনদের খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানাাই।
শাহজাহান আলম সাজু বলেন, ‘যারা রাজাকার শিরোমনি যুদ্ধাপরাধী কুখ্যাত দেলোয়ার হোসেন সাঈদির মুক্তি চায় তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা উচিত। ফোরামের পেইজ থেকে সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপপ্রচার,ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানো নতুন ঘটনা নয়। ফোরামের ব্যানারে কারা সংঘবদ্ধ হয়ে বেসরকারি শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের উসকানি দিচ্ছে রাজাকার সাঈদির মুক্তির দাবির মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছে তা আজ পরিস্কার হয়েছে।’