সৃজনশীলতাই হোক শিক্ষার লক্ষ্য - Dainikshiksha

সৃজনশীলতাই হোক শিক্ষার লক্ষ্য

সাদিকুর সাত্তার আকন্দ |

অকপটে সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতির বিরোধিতা করা উচিত নয়। কিন্তু সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পর হতে আজঅবধি শিক্ষিত, অর্ধ-শিক্ষিতসহ সমাজের প্রায় সকল শ্রেণির মানুষই সৃজনশীল পদ্ধতির বিপক্ষে বলেছেন, লিখেছেন এমনকি ছোটখাটো আন্দোলনও করেছেন আবার কিছু মহল আন্দোলন করার চেষ্টা করেছেন। একটু খেয়াল করলে দেখা যাবে যারা সৃজনশীল ব্যবস্থার বিরোধিতা করেছেন তারাও সৃজনশীল কর্মই করেছেন। সর্ববিদিত যে, কাউকে কিছু বোঝাতে গেলে যুক্তি, তর্ক, বাকপটুতা এমনকি উপস্থিত বুদ্ধিরও প্রয়োজন হয়। আর এসব আমরা শিখতে পারি সৃজনশীলতার মাধ্যমে। সৃজনশীলতা কি এবং আদৌ সৃজনশীল পদ্ধতি আমাদের বুদ্ধিমত্তাকে শক্তিশালী করে কি-না এ ব্যাপারে বহুমাত্রিক মতামত আজঅবধি রয়েছে।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সৃজনশীল পদ্ধতির সমালোচনাই হয়েছে হর-হামেশাই। পাঠ্যপুস্তকের সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে যদি বলি তাহলে বলতে হয়, কোনো একটি বিষয়ে বইয়ের একটি নির্দিষ্ট অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে এবং হয়ও। বইয়ের ঐ অধ্যায়ের শেষের দিকে পৃষ্ঠার আলোচিত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে কয়েকটা গল্প বা কেস স্টাডি দেয়া থাকে। কেস স্টাডির আলোচনার উপর ইঙ্গিত করে কয়েকটা ধারাবাহিক প্রশ্ন থাকে। পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের প্রশ্নগুলোর উত্তর করতে হয়। সৃজনশীল পদ্ধতির এই ধারাবাহিকতায় কোনো ত্রুটি বা খুঁত নেই। সমস্যাটা হলো সৃজনশীল পদ্ধতির বাস্তবায়নে। সৃজনশীল পদ্ধতির দ্বারা যে একজন শিক্ষার্থী মেধাকে শক্তিশালী করা সম্ভব এ ব্যাপারে অন্তরে-বাহিরে সম্ভবত সকলেরই একমত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে মতানৈক্য থাকতে পারে এ পদ্ধতি কীভাবে চর্চা করানো হচ্ছে সেটার উপর। সৃজনশীল পদ্ধতি একজন শিক্ষার্থীকে শিখায় কিভাবে বড় করে চিন্তা করতে হয়, কিভাবে একটি বিষয় অধ্যয়ন করেই বহুমাত্রিক বিষয়ের সঙ্গে মিলিয়ে একটি গভীর জ্ঞানের পসরা সাজানো যায়, সৃজনশীল পদ্ধতির মাধ্যমে একজন শিক্ষার্থী মুক্তচিন্তা ও মননের বিকাশ ঘটাতে পারে খুব কম বয়স থেকেই। তবে সৃজনশীল ব্যবস্থার কিছু ভুল প্রয়োগ শিক্ষার্থীদের যথাযথ জ্ঞান চর্চায় অন্তরায়ও বটে। সৃজনশীল পদ্ধতির ভুল প্রয়োগ বলতে আমি বোঝাতে চাচ্ছি বিভিন্ন ধরনের গাইড ও বাজারে প্রাপ্ত নোট বই নির্ভরতাকে। তাছাড়া অভিভাবকরাও চান তাদের ছেলে বা মেয়েটি যেন গোল্ডেন ‘এ’ প্লাস বা ‘এ’ প্লাস পায়। এজন্য অন্যতম ভরসাস্থল হয়ে ওঠে এসব গাইড বা নোটবুক। একটা সময় শুনতাম অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের বলতেন অনেক মেধাবী ও জ্ঞানী হতে হবে। এখন পড়াশোনার থিম ডায়লগ পরিবর্তিত হয়ে দাঁড়িয়েছে- অবশ্যই গোল্ডেন পেতে হবে। এভাবে করে যারা শিক্ষা দেবেন আর যারা শিক্ষা নেবেন অথবা যাদের সন্তানরা শিক্ষা গ্রহণ করবেন তাদের মধ্যকার উদ্দেশ্য ও চাওয়ার তফাতের কারণে শিক্ষার উদ্দেশ্য এবং প্রচলিত সৃজনশীল পদ্ধতির উদ্দেশ্য বালুর চরে মুখ থুবড়ে পড়ছে।

কখনো কখনো ভালো ফলাফল করতে চাওয়ার চেষ্টাই সৃজনশীল ও প্রতিভাবান হওয়ার সম্ভাবনাকে  অঙ্কুরে বিনষ্ট করে। কোনো একজন ছাত্র বা ছাত্রী যখন দেখে তার বন্ধু মুখস্থ করে তার চেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে যাচ্ছে তখন সেও তার বন্ধু বা বান্ধবীর মতো মুখস্থ করার কাজে নেমে পড়ে। লক্ষ্য একটাই— বেশি নম্বর পেতে হবে। মুখস্থ করার এই প্রতিযোগিতার সঙ্গে সৃজনশীলতার সম্পর্ক পুরোটাই উল্টো। প্রমথ চৌধুরী তাঁর একটি প্রবন্ধে মুখস্থ করাকে না বুঝে না জেনে গলদকরণ করার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি আরও বলেছেন- কোনো বিষয়ের প্রতি রুচি না থাকলে তা যদি জোর করে খাওয়া হয় বা খাওয়ানো হয় তবে বদহজম হতে পারে। পড়াশোনার ক্ষেত্রেও বিষয়টি এমন সম্ভবত প্রমথ চৌধুরী এটাই বোঝাতে চেয়েছেন।

কিন্তু বর্তমান সময়ের শিক্ষার্থী এমনকি তাদের অভিভাবকরাও মুখস্থ করার বিপক্ষে নন।  সকল স্তরের শিক্ষার্থীকে যে কোনো বিষয়ে সৃজনশীল করে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার যে সৃজনশীল পদ্ধতি রয়েছে সেটির সার-উদ্দেশ্য বোঝাতে হবে। একজন শিক্ষককে অবশ্যই শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য কি তা শিক্ষার্থীদের অন্তরে বুনন করতে হবে। সৃষ্টিশীল যে কোনো কাজই যে শিক্ষার লক্ষ্যকে পূর্ণ করতে পারে এটি ভালোভাবে শিক্ষার্থীদের বোঝানোটাও হাল-আমলে সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভেদে মেধা ও সৃজনশীলতার তারতম্য ঘটে—এটা সত্যি। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু বেশি লক্ষণীয়।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যেহেতু মুখস্থ করার বিষয়টি এতো জোরালো স্থান পায় না সেক্ষেত্রে পাবলিক ও প্রাইভেট উভয় অঙ্গনের শিক্ষার্থীরাই কম বেশি সৃজনশীল ও প্রতিভাবান হয়ে থাকে। তবে খেয়াল রাখতে হবে সৃষ্টিশীল পড়াশোনা ও সৃজনশীল কর্মের হাতেখড়ি হয় কিন্তু প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে। এমনকি এই সময়টাতে কোনো শিক্ষার্থী যদি সৃজনশীল মানসিকতার নাও হয় সেক্ষেত্রে ঐ পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানকে উদ্যোগ নিতে হবে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল কাজে ও পড়াশোনায় উত্সাহিত করার। কিন্তু অনেক প্রাইভেট স্কুল-কলেজই তাদের উদ্দেশ্য হিসেবে নিয়েছে কথিত ভালো রেজাল্টকে। মনে রাখতে হবে, সৃজনশীল মানসিকতাহীন কিন্তু ভালো রেজাল্টধারী একজন শিক্ষার্থী সমাজ ও দেশের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াতে পারে। শিক্ষার্থীরা ভালো রেজাল্ট করবে। অবশ্যই ভালো রেজাল্টের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা সৃজনশীলতা, বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞার সমন্বয়ে হতে হবে। শিক্ষার ক্ষেত্রে সংখ্যা নয়, গুণগতমান জরুরি। আর গুণগতমান বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট নীতিমালার মধ্যদিয়ে প্রতিষ্ঠান পরিচালনা অতীব জরুরি। একটা বিষয় বুঝতে হবে, সৃজনশীলতা ও ভালো ফলাফল সবসময় সমান্তরালভাবে এগোয় না।

 লেখক: শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038440227508545