‘হামরা পড়বার চাই, কিন্তু চরত যে স্কুল নাই’ - দৈনিকশিক্ষা

‘হামরা পড়বার চাই, কিন্তু চরত যে স্কুল নাই’

শফিকুল ইসলাম বেবু, কুড়িগ্রাম |

Kurigram-Chorপঞ্চম শ্রেণির গন্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকছে চরাঞ্চলের শিশুদের শিক্ষাজীবন। সেটিও অনেক কষ্টে এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানহীন ভাবে। শুধুমাত্র উচ্চ বিদ্যালয়না থাকায় এর বেশী এগুনো সম্ভব হয়না হাজারহাজার শিশুর।

ফলে শিক্ষাবঞ্চিত থেকে অনাদরেই বেড়ে উঠছে মূলভুখন্ডের বাইরে আগামী প্রজন্মের বিশালএকটি অংশ। এমনই চিত্র দেখা গেছে দেশের উত্তর জনপদের সীমান্তবর্তী অবহেলিত জেলা কুড়িগ্রামের বিভিন্ন চর ঘুরে।

আরডিআরএসসহ কয়েকটি এনজিও শিক্ষা বিস্তারের নামে কোটি কোটি ডলার বিদেশ থেকে এনে লুটপাট করছে। ঝরে পড়া কমানোতে এদের নেই কোনও ভূমিকা। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ে ব্যস্ত থাকেন আরডিআরেএস অফিসাররা।

এ জেলার ৪ শতাধিক চরাঞ্চলের হাজারও শিক্ষার্থী উচ্চ বিদ্যালয়ের অভাবে পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর ঝড়ে পড়ছে। মেয়েরা সংসারের কাজ করে। অল্প বয়সে বিয়ে দেয়া হয় আর ছেলেরা মাঠে গরু চড়ায়, খেতে বড়দের সঙ্গে কাজ করে। আবার কেউ কাজ করতে জেলার বাইরেও চলে যায়। এ চিত্র কুড়িগ্রামের বেশির ভাগ চরেরই।

চরের বিষয়টি মূলভুখন্ড থেকে পুরোপুরি আলাদা। এজন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর ব্যাপক বিস্তার এবং বিশেষ প্রকল্প নেয়া দরকার।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর জেলা সদস্য আহসান হাবীব নীলু’র মতে, নদী তীরবর্তী চরাঞ্চলের মানুষ শুধু যে প্রকৃতির কাছেই অসহায় তা নয়, বরং তারা যে দেশ ও সমাজে বসবাস করে সেখানেও বিচ্ছিন্ন থেকে সীমাহীন বঞ্চনার শিকার হয়। বিশেষ করে দ্বীপচর গুলোতে সরকারের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও সামাজিক নিরাপত্তাসহ কোন সেবাই সত্যিকার অর্থে এদের দোর গোড়ায় খুব একটা পৌঁছেনা।

প্রাথমিক শিক্ষায় প্রকৃত ভর্তির হার এবং প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় লৈঙ্গিক সমতা আনয়ন বিষয়ক লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু চরাঞ্চলে চিত্র একেবারেই ভিন্ন।

কুড়িগ্রামসদর উপজেলা থেকে ১২ কিলোমিটার গেলে যাত্রাপুর বাজার। বাজার থেকে কিছুদুর গিয়ে নৌকা ঘাট থেকে ব্রক্ষপুত্র নদ পার হয়ে প্রায় ৭ থেকে ৮ কিলোমিটার দুরে অবস্থান চর রসুলপুরের। এ চরে চলাচলের জন্য নির্দিষ্ট কোন রাস্তা নেই।

সম্প্রতি জমির আল দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় চোখে পড়ল বেশ কয়েকটি শিশু বাড়ির উঠোনে বসে মোবাইল ফোনে ছবি দেখছে। কাছে যেতেই দৌড়ে বাড়ির ভিতরে পালিয়ে যায় দুটিশিশু। এদের মধ্যে এক জন নুর আলম (১০) জানায় সে তৃতীয় শ্রেণিতে পরে। বাড়ী থেকে ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার দুরে দুধকুমর নদী পার হয়ে যেতে হয় রসুলপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।

এজন্য নিয়মিত স্কুলে যায়না সে। তার সমবয়সী রাশেদ ও প্রায় একই কথা জানায়। হাফেজি মাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী জোসনা খাতুন জানায়, এই চর থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার দুরে মধ্যকুমরপুরবালিকা উচ্চ বিদ্যালয় আছে। নদী পার হয়ে যেতে হয়। জানিনা পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর কি হবে। রাউলিয়ার চরের কৃষক এনামুল হক জানান, দুই মেয়ে তৃতীয় শ্রেণিতে পরে। কিন্তু একটু আকাশ খারাপ হলেই বাচ্চাদের ভয়ে স্কুলে পাঠাই না। তাছাড়া বন্যার সময় দুটি নদী পার হয়ে স্কুলে যেতে হয়। ফলে পুরো সময়টাই পড়া লেখাবন্ধ থাকে।

নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন আবুল হোসেন, তিনি জানান কাছাকাছি স্কুলের অভাবে মেয়ে দুটোকে পড়াতে পারিনি। ছোট বেলায়ই বিয়ে দিয়েছি। ছোট ছেলেটো দ্বিতীয় শ্রেণিতে পরে। জানিনা এর পর কি হবে।

প্রায় একই কথা জানালেন কৃষক সেকেন্দার আলী। বড় মেয়ে ফরিদা পঞ্চম শ্রেণি পাশ করার পর বিয়ে দিয়েছে, বাকী দুই মেয়ে রওশনআরা ও রেশমারও একই অবস্থা। এছাড়া ঝুনকার চরের মেধাবী ছাত্রী হাফিজা খাতুন জানায়, মুই তো পড়বার চাং। কিন্তু চরত হাই স্কুল নাই (আমি পড়তে চাই কিন্তু চরে উচ্চ বিদ্যালয় নাই)। কেমন করি পড়ি। খেয়ার আলগার চর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণি পাশ করা মেধাবী এ শির্ক্ষাথীর আর হাই স্কুল পড়া হয়নি। তার দিন কাটে মায়ের সাথে সংসারের কাজ করে। দেবাড়ী খোলার চরের পঞ্চম শ্রেণি পাশ করা আরিফা খাতুনের পিতা আজিজুল হক পেশায় জেলে।

আরিফার বাড়ীতে গিয়ে কথা বলতে চাইলে লজ্জায় মাথা নিচু করে। লেখাপড়া বন্ধ করলে কেন জানতে চাইলে বলে কোথায় পড়ব স্কুল নাই। বাড়ীতে মায়ের সাথে কাজ করি।

প্রতিবেশী হালেমা বেগম দুঃখ করে বলেন মেয়েটার মাথা খুব ভাল। ওয়ান থেকে ৫ শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি ক্লাসে ফাষ্ট হইছে। গরীব মানুষ পড়াতে পারেনা। কাছাকাছি কোনচরে স্কুলনাই। এখন বিয়ে দিবার জন্য ছেলে খোঁজা হচ্ছে। শুধু হাফিজাই নয় এরকম অবস্থা চরের অনেকেরই।

সরকারী বেসরকারী বিভিন্ন সুত্র জানায়, কুড়িগ্রাম জেলার উপর দিয়ে বয়ে গেছে ১৬টি নদ-নদী। এ গুলোর মধ্যে প্রধানত ব্রক্ষপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, সোনাভড়ি, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম ও ফুলকুমার অন্যতম। এসব চরের মধ্যবত্তি স্থানে রয়েছে ৪০৫টি চর। জেলা প্রথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সুত্র জানায়, চরাঞ্চলে প্রথমিক বিদ্যালয় রয়েছে ২ শত ৩৯ টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৯ হাজার। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ৬৬ হাজার। কিন্তু উচ্চ বিদ্যালয় রয়েছে মাত্র ৪টি। শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ১ হাজার।

চর নিয়ে কাজ করা কুড়িগ্রামের স্থানীয় এনজিও জীবিকার পরিচালক মানিক চৌধুরী জানান, চরে অবকাঠামো স্থায়ী হয়না। একারনে স্কুলের জন্য সরকারীভাবে অস্থায়ী অবকাঠামোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। তাছাড়া চরের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে সিএলপি প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চরের অন্যতম সমস্যা জমির মালিকানা। আমরা বর্তমানে বিভিন্ন চরের ৭ হাজার পরিবারকে সহযোগিতা করেছি।

কুড়িগ্রাম সদরের যাত্রপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আব্দুল গফুর জানান, চরের মানুষ নানা সমস্যায় জর্জরিত। ব্রক্ষপুত্রের ভাঙনে যাত্রাপুর ইউনিয়নের দুই তৃতীয়াংশ ব্রক্ষপুত্রের ভাঙনে শিকার হয়েছে। চরাঞ্চলের মানুষরা ব্যাংক ঋণও পায়না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে চরের শিশুরা অনেক পিছিয়ে। চরাঞ্চলের জন্য বিশেষ ও বেশী করে বরাদ্দ দরকার।

কুড়িগ্রামের জেলা শিক্ষাকর্মকর্তা ভবশংকর রায় জানান, চিলমারী উপজেলার ব্রক্ষপুত্রের চরে নয়ার হাট ইউনিয়নে দক্ষিণ খাওরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, অষ্টমীর চর ইউনিয়নে নটারকান্দি উ”” বিদ্যালয়, নাগেশ্বরী উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নে নরায়নপুর উচ্চ বিদ্যালয়, একই উপজেলার চৌদ্দ ঘুরি নি¤œমাধ্যমিক বিদ্যালয় এই ৪টি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া প্রায় ৪০০ চরে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। চরাঞ্চলে মাধ্যমিক বিদ্যালয়না থাকায় গরীব ও মেধাবীদের উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করার কোন সুযোগ নেই।

জাতীয় বাজেটে ও অবহেলিত থাকছে চরাঞ্চল। গত কয়েক বছরের বাজেট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চর বাসীর উন্নয়নে সুনিদিষ্ট কোন বরাদ্দ দেওয়া হয়নি।

অন্যদিকে দীর্ঘ বছর ধরে চরে কাজ করার অভিজ্ঞতা বর্ননা করেন এনজিও কর্মী মোফাচ্ছেল হক। রসুলপুর চরের মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, ভগবতিপুরে কোন হাই স্কুল নেই। তবে একটি প্রাইমারী স্কুল থাকলেও শিক্ষকরা যান না। কন্ট্রাকে চলে এ স্কুলে শিশুদের লেখাপড়া।

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.003242015838623