‘কেন আমি স্কুলে গিয়ে শেখার চেয়ে অনলাইন পদ্ধতিতে বেশি শিখি’ - দৈনিকশিক্ষা

‘কেন আমি স্কুলে গিয়ে শেখার চেয়ে অনলাইন পদ্ধতিতে বেশি শিখি’

মোকলেচুর রহমান মোল্লা, নিউইয়র্ক প্রতিনিধি |

করোনা পরিস্থিতি সামাল দিতে আকস্মিকভাবে স্কুলপর্যায়ে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার মূল্যায়নের দিক থেকে যে পর্যায়েই থাকুক না কেন, নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন আবারো বাধ্য হয়েই চলতি বছরের ১৬ জুলাই শুরু হওয়া গ্রীষ্মকালীন স্কুলকার্যক্রমে (Summer School 2020) এ দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

গ্রীষ্মকালীন স্কুলকার্যক্রম হলো,  এক বছরের স্কুল শেষ থেকে নতুনবর্ষের স্কুলকার্যক্রম শুরুর মধ্যবর্তী সময়ে বিশেষ স্কুলকার্যক্রম। তার মানে, সেপ্টেম্বর ২০১৯ এ শুরু হওয়া স্কুলবর্ষের ক্লাস বেশিরভাগ স্কুলেই শেষ হয়ে গেছে এবং রেজাল্ট দেয়ার প্রস্তুতি চলছে। ১৫ জুনের মধ্যে রেজাল্ট দেয়া শেষ হওয়ার পরপরই শুরু হচ্ছে গ্রীস্মকালীন ছুটি। আর এই রেজাল্ট বা গ্রেডও দেয়া হয় দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে। আমি এর আগে দৈনিক শিক্ষায় এক লেখায় বলেছি, নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন ইতোমধ্যে স্কুলসমূহের জন্য তাদের প্রচলিত গ্রেডিং পদ্ধতির বাইরে এক নতুন ধরনের গ্রেডিং পদ্ধতির ঘোষণা দিয়েছে। সেখানে নতুন গ্রেডিং পদ্ধতির অনেকটা বিস্তারিত বিবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছি। নতুন গ্রেডিং পদ্ধতিতে যারা নতুন ক্লাসে উত্তীর্ণ হতে নিন্মতম চাহিদা মেটাতে অক্ষম হবে এবং যারা কোনো বিষয়ে অকৃতকার্য হবে তাদেরকে স্কুল নির্দিষ্ট গ্রীষ্মকালীন ক্লাস নির্ধারণ করে দেবে। এছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কোনো শিশুর যদি কোনো ধরণের বিশেষ কোনো কাউন্সেলিং বা ক্লাসের প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় তবে তা গ্রীষ্মকালীন ক্লাস এ নেয়ার জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হবে। আর এ সবই করা হবে, দূরশিক্ষণ পদ্ধতির বিভিন্ন কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে।

নিউইয়র্ক সিটির শিক্ষাব্যবস্থায় সমসাময়িককালে ব্যবহৃত দূরশিক্ষণ পদ্ধতির বিভিন্ন কৌশল ও এর সুবিধা ও অসুবিধাসমূহ সম্পর্কে বলতে হলে প্রথমেই এখানের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন ধাপসমূহ নিয়ে একটু বলা প্রয়োজন। তারও আগে বলে নেয়া প্রয়োজন, এখানে কলেজ লেভেল না বরং শুধু স্কুল লেভেলে ব্যবহৃত দূরশিক্ষণ পদ্ধতির অভিজ্ঞতা ও ব্যবহারের সার্বিক দিক নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছি।

নিউইয়র্ক সিটির স্কুলব্যবস্থায় চারটি ধাপ রয়েছে। যেমন: প্রি-স্কুল (Pre-Schools) এলিমেন্টারি (Elementary School), মিডেল স্কুল (Middle School) ও হাই স্কুল (High Schools)। প্রি স্কুল ধাপটি নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন সম্প্রতি অনুমোদন করেছে। দুই বছর আগেও শিক্ষার এ ধাপটি ছিল না। এখানে মূলত প্রাক-শিশুশিক্ষা, যার মধ্যে রয়েছে শিশুর পড়া, লেখা, সাধারণ গণিত ও বিজ্ঞান শিক্ষার দক্ষতা বাড়ানো চর্চাকরা হয়।

এখানে থ্রি-কে (3-K) ও প্রি-কে (Pre-K) নামে দুইটি ক্লাস রয়েছে যাতে আড়াই বছর থেকে সাড়ে চার বছর বয়সী শিশুরা ভর্তি হয়ে থাকে। এখানে শিশুদের কিন্ডারগার্টেনে যাওয়ার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। তাই এটাকে কিন্ডারগার্টেন প্রস্তুতি (Kindergaten Preparetion) কার্যক্রমও বলা হয়ে থাকে।

এলিমেন্টারি হলো কিন্ডারগার্টেন থেকে পঞ্চম গ্রেড পর্যন্ত এবং এই লেভেলের শিক্ষার্থীদের বয়স হলো ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে। মিডেল স্কুল হলো ষষ্ঠ গ্রেড থেকে অষ্টম গ্রেড পর্যন্ত, যার শিক্ষার্থীদের বয়স ১১ বছর থেকে ১৩ বছরের মধ্যে এবং হাই স্কুল হলো নবম থেকে টুয়েলভ গ্রেড পর্যন্ত। এই লেভেলের শিক্ষার্থীদের বয়স ১৪ বছর থেকে ১৮ বছর। একদিকে যেমন এই সকল বিভিন্ন বয়স ও গ্রেড লেভেলের শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষাদানের পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, তেমনি দূরশিক্ষণ পদ্ধতির নতুন কোনো সার্বজনীন কৌশল উদ্ভাবন করে তাদের সার্বিক চাহিদা মিটায়ে মানসম্মত শিক্ষাদান সহজ কোনো কাজ নয়। তাই নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন, ছাত্রছাত্রীদের বয়সের কথা বিবেচনা করে একেক গ্রেড লেভেলে এক বা একাধিক দূরশিক্ষণপদ্ধতির কৌশল গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। কারণ বয়স, শিক্ষা ও ব্যক্তিগত দক্ষতার তারতম্যের জন্য দূরশিক্ষণ পদ্ধতির কৌশলসমূহের ব্যবহারের দক্ষতা ও তা থেকে শিক্ষা গ্রহণের মাত্রার তারতম্য কামিয়ে এনে একটা গ্রহণযোগ্য লেভেলে পৌঁছাতেই এই ব্যবস্থা করা হয়। আর এই বিভিন্ন দূরশিক্ষণ পদ্ধতির কৌশল ব্যবহারের সুবিধা, অসুবিধা ও অসুবিধাসমূহ কাটিয়ে ওঠার গল্প আসলে একেবারে নতুন ও ভিন্নরকম।

প্রি-স্কুল, এলিমেন্টারি এর শিক্ষার্থীদের যেহেতু বয়সে অনেক কম, তাই তাদের কম্পিউটার টাইপ ও ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষতা বলতে গেলে একেবারেই নেই। এক্ষেত্রে এতদিন দূরশিক্ষণ পদ্ধতির কৌশল ব্যবহারের কাজগুলো যেমন, অনলাইন পোর্টালে লগইন করা, পোর্টালে পোস্ট করা ভিডিও চালিয়ে দেখানো, এসাইনমেন্ট ডাউনলোড করা ও এসাইনমেন্ট শেষ করে আবার শিক্ষকদের পাঠানো শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা করে আসছিলেন। এক্ষেত্রে শিক্ষকরা সময় সময় ফোন করে শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সাথে কথা বলত ও কোনো ধরনের সমস্যা থাকলে তা সমাধানের চেষ্টা করতেন। কোনো শিক্ষার্থী যদি পরপর দুইদিন অনলাইন পোর্টালে লগইন না করত তাহলে শিক্ষকরা কল দিয়ে খোঁজ নিতো। কারণ অনলাইন পোর্টালে লগ ইন এ হিসাবই ছিল শিক্ষার্থীর উপস্থিতির হিসেব। তবে, যেসব অভিভাবকরা কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহারের দক্ষ না তাদেরকে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির কোনো কৌশলের আওতায়ই আনা সম্ভব হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রতি সপ্তাহে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা তাদের ক্লাস শিক্ষকের কাছ থেকে পুরা সপ্তাহের এসাইনমেন্ট নিয়ে আসতেন এবং তা শেষ করে স্কুলে জমা দিয়ে আসতেন।
 
আর এইসব সমস্যা কাটিয়ে সকল শিশুদের দূরশিক্ষণ পদ্ধতির আওতায় আনতে নিউইয়র্ক সিটি ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশন ও অনেটগ্রুপ (WNET Group) যৌথভাবে লেটসলার্ন এনওয়াইসি (Let's Learn NYC) নামে নতুন একটি টেলিভিশন প্রোগ্রাম চালু করে। এই প্রোগ্রামটি গত ৪ মে থেকে চালু হয়, যা সোম থেকে শুক্রবার সকাল ১১টা থেকে থার্টিন (THIRTEEN) টিভিতে চলত। এই উদ্দ্যোগ মূলত ৩কে থেকে সেকেন্ড গ্রেডের শিশুদের স্কুল কর্তৃক পরিচালিত দূরশিক্ষণ পদ্ধতির কার্যক্রমের সাথে সহায়ক শিক্ষণ হিসেবে পরিচালিত হতো।  এই টিভি শোতে যথাযথ বয়স বিষয়সমূহ দেখানো হতো, যার মধ্যে রয়েছে প্রাক-শিশুশিক্ষা, মৌলিকপড়ার দক্ষতা, স্বাক্ষরতা, গণিত, সামাজিক শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষা বিষয়ে শেখানো হতো। এর সাথে কথাবলার দক্ষতা, শব্দ শেখা, গদ্য পড়া এবং লেখার বিষয়গুলো অর্ন্তভুক্ত ছিল।

নিউইয়র্ক টাইমস (New York Times) পত্রিকায় গত ৫মে প্রকাশিত এক লেখায় ১৩ বছর বয়সী অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী ভেরোনিকমিনজ (Veronique Mintz) “কেন আমি দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে স্কুলে গিয়ে শেখার চেয়ে বেশি শিখি” (Why I’m Learning More With Distance Learning Than I Do in School) শিরোনামে এক লেখায় বলেন, আমি সে সকল সহ-শিক্ষার্থীদের অনুভব বা অভাব বোধ করি না যারা অযথা ও অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে, শিক্ষকদের সম্মান করে না এবং একে অন্যের সাথে মারামারি করে। সে আরো বলে, ক্লাসরুমের জিনিসপত্র ধ্বংস করা, পরীক্ষার সময় গোপনে লুকিয়ে বা নকল করা প্রশ্নের উত্তর দেয়া, ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি, লাথি ও ফ্লরে গড়াগড়ির মতো কাজ তার স্কুলে প্রতিদিনই ঘটে। মনে করতে পারেন আমি মসকারা করছি, কিন্তু না আমি প্রতিজ্ঞা করে বলছি। আমার কিছু সহপাঠীর কাজকর্ম দেখলে আমার মনে হয় আমি দ্বিতীয় কি চতুর্থ গ্রেডে পড়ছি। আমার বিগত তিন বছরের মিডল স্কুলের প্রতিটি ৪৫ মিনিটের ক্লাসে এমন সব ঘটনা অহরহ ঘটছে। আর এ কারণেই করোনভাইরাস মহামারির সময়কালে শুরু হওয়া দূরশিক্ষণ শিক্ষা পদ্ধতি চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে।

মিনজ আরো বলেন, যে, তিনি  গত ২৩ মার্চ থেকে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করেছন এবং তিনি মনে করে যখন তিনি স্কুলে ক্লাসে উপস্থিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতেন তার চেয়ে এখন অনেক সহজ ও আরামে আগের চেয়ে বেশি শিখতে পারছেন। এছাড়াও, তিনি সেই সব ছাত্রছাত্রী যারা ক্লাসে বিরক্ত করে ও সেইসব শিক্ষক যারা ক্লাসে নিজেদের ভাবমূর্তি ধরে রাখতে পারে না, তাদের এমন বিড়ম্বনা এড়িয়ে তিনি স্বাধীনভাবে লেখাপড়া করতে পারেন। আবার যে সকল ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের মূল্যবান সময় চুরি করে বা চুরি না করে থাকতে পারে না তারা অনেক সময় তাদের সহপাঠীদের ক্লাসের পড়া সম্পন্ন করা ও পরীক্ষার প্রস্তুতি নেয়ার ক্ষেত্রে বিঘ্ন ঘটায় বা বিরত রাখে। মিনজ বলেন, আমার স্কুল শিক্ষকদের কাজের সমালোচনা করছি না। একসাথে ২৬ জন উঠতি বয়সী ছেলে-মেয়েকে নিয়ন্ত্রণ করা একেবারেই সহজ কাজ নয়।

মিনজ বলেন, দূরশিক্ষণ আমাকে আমার পড়াশুনার ওপর নিয়ন্ত্রণ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। যে বিষয়ের প্রতি আমার আরো বেশি জোড় দেয়া প্রয়োজন মনে করি সেই বিষয়ে আরো বেশি সময় দেয়ার সুযোগ পাই। শিক্ষকদের সেইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য বসে থাকতে হয় না যা আগে থেকেই জানা। এখনও অন্য ছাত্রছাত্রীদের সাথে আগের চেয়েও বেশি কার্যকর যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছি। দূরশিক্ষণের কৌশল ফেস টাইমিং (Face Timing) এ যে সকল বন্ধুরা কাজে বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে আনে ও শক্তি যোগায় আমি তা ভীষণ উপভোগ করি। এখানে আমরা একে অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা করি যা আরো উন্নত শিক্ষার অভিজ্ঞতা। আবার, গুগল ক্লাসরুমে (Google Classroom) পোস্ট করা কিছু শিক্ষকের ধারণকৃত ভিডিও ক্লাসসমূহ আমি তাদের ক্লাসরুমে দেয়া শিক্ষার চেয়েও পছন্দ করেছি। দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ক্লাসে অযথা সময় নষ্ট হওয়ার পরিমাণ কমে গেছে। এখন আমি শিক্ষকের ধারণকৃত ক্লাসকে বন্ধ করে আবার চালু করে আবার কখনো সামনে পিছনে টেনে শুনতে ও দেখতে পারি। যার ফলে ক্লাসের সকল বিষয় সহজেই বুঝতে পারি। এরপরও কোনো বিষয় যদি না বুঝি, তখন শিক্ষকের সাপ্তাহিক ৩০ থেকে ৯০ মিনিটের অনলাইন অফিস সময়ে যোগ দিয়ে বুঝে নিতে পারি। কারণ, তার এই অফিস সময়ে কখনোই একসাথে দুই থেকে তিনজনের বেশি শিক্ষার্থী যোগ দেয় না। মূলত আমি এখানে ক্লাসরুমের চেয়ে অনেক বেশি শিখছি। তার মানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোথাও না কোথাও সমস্যা আছে। তবে, দুর্ভাগ্যক্রমে, যে সকল শিক্ষকরা ক্লাসরুমে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয় তারা দূরশিক্ষণ ক্লাসেও একই পরিস্থিতির মধ্যে পরে।

মিনজ দূরশিক্ষণ ক্লাসের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু পরামর্শ তুলে ধরেন যা কি না ক্লাসরুমে শিক্ষার বেলায় ব্যবহার করা যেতে পারে। সেগুলো হলো, ক্লাসরুমে ক্লাস নেয়ার সময় ভিডিও করে তা ক্লাস শেষে সকল শিক্ষার্থীদের ই-মেইল বা যে কোনো অনলাইন মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া। প্রত্যেক শিক্ষকের সপ্তাহে একটা নির্দিষ্ট অফিস সময় থাকা দরকার যেখানে শিক্ষার্থীরা একজন করে বা ছোট গ্রুপ করে তাদের সমস্যাগুলো বুঝে নিতে পারে। আবার যে সকল শিক্ষকরা ক্লাসরুম নিয়ন্ত্রণে দক্ষ ও যারা দক্ষ না এমন দুইয়ের সমন্বয়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে এই সমস্যার দূর করা। তবে, তিনটি পরামর্শে প্রথম দুটি যে ভীষণ কার্যকর তা ইতোমধ্যে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ব্যবহারের মাধ্যমে কার্যকর।

মিনজ এর এই বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে লেখার যদি একটু বিশ্লেষণ করি তবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ইতিবাচক দিকগুলো আরো স্পষ্ট হবে। দূরশিক্ষণ পদ্ধতি আসলে মহামারি, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও শারীরিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠে সকলকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারে। শিক্ষার্থীদের প্রকৃত অবস্থা ও গ্রহণ ক্ষমতা বিচারে শিক্ষাদানের কৌশল গ্রহণের সুযোগ রয়েছে। এখানে শিক্ষার্থীর সুবিধামতো সময়ে ও স্থানে স্বাধীনভাবে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ উম্মুক্ত।

শিক্ষার্থীর বাড়ির পড়া বা ক্লাস পরীক্ষার পড়া এমনকি চূড়ান্ত পরীক্ষার পড়ার জন্য প্রয়োজনীয় সময় নির্ধারণ ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল বিষয়ে প্রয়োজনীয় সময় প্রদান ও পরিকল্পনা করা সহজতর হয়। দূরশিক্ষণ পদ্ধতি শিক্ষার্থী-কেন্দ্রীক হওয়ায় শিক্ষা গ্রহণের মূল দায়িত্ব শিকার্থীর ওপর বর্তায়, যার ফলে শিক্ষার্থীরা সচল ও আত্ম-নিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থীদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ চমৎকার হয়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের মধ্যে প্রযুক্তির ধারণা ও প্রযুক্তির ব্যবহারের দক্ষতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বিশ্ব জ্ঞান ও দক্ষ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ তৈরি হয়। আর্ন্তজাতিক মানের শিক্ষা গ্রহণে দাঁড় উন্মুক্ত হয়ে যায়। কেন্দ্রীভূত জ্ঞান ও শিক্ষা সম্পদের সমান বন্টন ও উপভোগের সুযোগ তৈরি হয়। শিক্ষার্থীদের অর্থের খরচ কমে, যা তাকে শিক্ষার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি ক্রয় করতে সুবিধা দেয়। দেশের বাইরে শিক্ষা গ্রহণ করতে ভিসা, যাতায়ত বা আইনি জটিলতা  ও বিদেশে থাকা খাওয়ার বিড়ম্বনা থাকে না।  

দূরশিক্ষণ পদ্ধতি এত শত ইতিবাচক দিক থাকলেও নেতিবাচক দিকও কিন্ত কম নয়। এখানে শিক্ষক শারিরীকভাবে উপস্থিত না থাকায় সময়বিশেষে প্রয়োজনের সময় শিক্ষার্থীরা দিক নির্দেশনা ও সহায়তা পায় না। শুধুমাত্র যখন শিক্ষার্থী ক্লাসে যোগ দেবে তখনই শিক্ষককে পাবে, এর বাইরে শিক্ষকের সাক্ষাৎ পাওয়ার কোনো সুযোগ নাই। অনেক সময় প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়ার সুযোগ থাকলেও তা পাওয়া বা না পাওয়া নির্ভর করে শিক্ষার্থীর যথাযথ প্রয়োজনীয়তা বোধ, সহায়তা চাওয়ার ধরন ও সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন করার দক্ষতার উপর। কোনো শিক্ষার্থী যদি কোনো ধারণাকে ভুলভাবে বুঝে থাকে তবে তা যথাযথ জ্ঞান দেবে না। আর সে সেই সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ও করবে না।

দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে অনেক সময় শিশুরা একাকীত্ব বোধ করে এবং ক্লাসরুমের পরিবেশে যে আনন্দ পায় তা এখানে পায় না। ক্লাসরুমে অনেক দলভিত্তিক শিক্ষা আছে যেমন, দলভিত্তিক আলোচনা, দলীয় কাজ, শিক্ষা সরঞ্জাম তৈরি করা, অন্যকে শিখিয়ে দেয়া, নিজেদের মধ্যে বিষয় নিয়ে আলোচনা ও একে অপরকে প্রশ্ন করা ও প্রশ্নের উত্তর যেগুলো সবই গভীর চিন্তা ও যথাযথ শিক্ষার সহায়ক। আর দূরশিক্ষণ পদ্ধতির বেলায় এগুলোর উপস্থিতি খুবই সীমিত। আবার ক্লাসরুমের বাইরে শিক্ষার্থীদের যে বাড়তি যোগাযোগও সম্পর্ক যা স্পোর্টসক্লাব, নাচের ক্লাস, সামার ক্যাম্প ইত্যাদির সুযোগ থাকে তা দূরশিক্ষণপদ্ধতির বেলায় একেবারেই অনুপস্থিত।

যে সকল শিক্ষার্থীরা নিজে সুশৃঙ্খল না তারা তাদের লেখাপড়ার সময়ের ব্যবস্থাপনা, কার্যকরী দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে। এখানে শিক্ষার্থী সংগঠন করার দক্ষতা, কাজের গুরুত্ব বিচারের দক্ষতা, শিক্ষণের দক্ষতা ও সময় ব্যবস্থাপনার দক্ষতার অভাব দেখা যেতে পারে। এখানে কোনো একজন কার্যকর দূরশিক্ষণ শিক্ষার্থী হতে হলে বা সফল দূরশিক্ষণ শিক্ষক হতে হলে তাদের উভয়কে নিশ্চিতভাবে তার প্রয়োজনীয় সকল প্রযুক্তি থাকতে হবে এবং সেগুলোর যথাযথ ব্যবহার জানতে হবে ও এ সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তি কৌশলসমূহ রপ্ত করতে হবে। দূরশিক্ষণ পদ্ধতির সময় ব্যবহৃত সকল প্রযুক্তি সেবা যেমন, ইন্টারনেট ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। আবার যে স্থানে বসে শিক্ষার্থী শিক্ষা গ্রহণ করবে ও শিক্ষক শিক্ষা দেবে উভয় স্থানেই যথাযথ পরিবেশ বজায় রাখতে হবে তা না হলে এর পুরা উদ্যোগই ব্যর্থ হবে। এছাড়াও দূরশিক্ষণ পদ্ধতির জন্য যথাযথ শিক্ষা উপকরণ তৈরি অনেক কষ্টকর ও ব্যয় বহুল এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি কাঠামো তৈরি ও তা ব্যবস্থাপনা অনেক কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল।

শুধু উচ্চশিক্ষা ও বয়স্ক শিক্ষার বেলায় দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার ও আলোচনা সচারাচর শোনা গেলেও, কিন্ডারগার্টেন থেকে টুয়েলভ গ্রেডেও দূরশিক্ষণ পদ্ধতির ব্যবহার বেড়ে চলছে। সম্প্রতি ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এডুকেশনের এক গবেষণা তথ্য মতে, (U.S. Department of Education) হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ক্লাস করার হার ২০০২ খ্রিষ্টাব্দে ছিল ৩০ শতাংশ যা বেড়ে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে হয়েছে ৫৩ শতাংশ। তাই, স্কুল লেভেলে শিক্ষার্থীদের দূরশিক্ষণ পদ্ধতিতে ক্লাস করার প্রয়োজনীয়তা যে হঠাৎ করে একেবারেই উঠে যাবে এমনটা ভাবার কোনো সুযোগ নাই। তাইএ টা আরো সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায় সে দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। এই শিক্ষাপদ্ধতির কোথায় কোথায় প্রয়োজনীয় সংযোজন ও বিয়োজন সম্ভব তা নির্ধারণের জন্য গবেষণাভিত্তিক বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

মোকলেচুর রহমান মোল্লা, নিউইয়র্ক প্রতিনিধি, দৈনিক শিক্ষাডটকম। 

 

আরও পড়ুন:

নিউইয়র্কে অজানা রোগে মারা যাচ্ছে স্কুল শিক্ষার্থীরা

নিউইয়র্কের শিক্ষার্থীরা স্কুল থেকে যেসব খাবার পায়

স্থায়ী দূরশিক্ষণ পদ্ধতি : যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্রদের নতুন উদ্যোগ

করোনাকালে যুক্তরাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থা: এক বাংলাদেশির বয়ান

শিক্ষা নিয়ে নিউইয়র্ক মেয়রের পাঁচ পরিকল্পনা, বাংলাদেশও করতে পারে অনুকরণ

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006554126739502