‘মাইয়াডার ফেয়ারওয়েল ফি এত টাহা কই পামু। ক্যামনে দিমু ৭০০ টাহা। মোটরসাইকেলে যাত্রী টাইন্যা সংসার চলে। অর ল্যাহা-পড়ার খরচও চালাই। এ্যাহন ফাইন্যাল পরীক্ষার সময় ফেয়াওয়েলের চাঁদা একটু কম ধরলে কি অইতে’। দৈনিক শিক্ষাডটকমকে এসব কথা বলছিলেন ভাড়ায় মোটরসাইকেল চালক নুরুল ইসলাম। পটুয়াখালীর বাউফলের ৭০ নং ধানদী বাহাদুরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে তার মেয়ে শান্তা। তাই, স্কুল থেকে শনিবার (৯ নভেম্বর) দেয়া হবে ফেয়ারওয়েল। অনুষ্ঠানের আগেই পরীক্ষার্থীদের পরিশোধ করতে হবে মাথাপিছু ৭০০ টাকা চাঁদা (ফেওয়ারওয়েল ফি)। মেয়ের ফেয়ারওয়েলের ‘স্কুল নির্ধারিত’ চাঁদা পরিশোধের চিন্তায় চোখে-মুখে হতাশার ছাপ স্থানীয় বাজারের এক চাঁয়ের দোকানের সামনে মোটরসাইকেলের যাত্রীর অপেক্ষায় থাকা নুরুল ইসলামের।
জানা গেছে, আগামী ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা। মোট ২৪ জন পরীক্ষার্থী ধানদী বাহাদুরপুর সরকারি প্রাইমারি স্কুল থেকে সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবে। আগের মতো দাওয়াতি চিঠি ছাপানো না হলেও কমিটির লোকজন মিলে প্রাথমিকভাবে আলোচনা শেষে পরীক্ষার্থীদের বিদায় দিতে শনিবার স্কুলে আয়োজন করা হয়েছে অনুষ্ঠানের। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ফেয়ারওয়েলের চাঁদা বাবদ আদায় করাও হচ্ছে ৭০০ টাকা।
সমাপনী পরীক্ষার্থী ফারজানা, তমা, তন্ময়, শান্তাসহ কয়েকজন জানান, ১ম শ্রেণি থেকে ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও আদায় করা হচ্ছে ৩০ টাকা হারে। আর পরীক্ষার্থীদের থেকে নেয়া হচ্ছে ৭০০টাকা চাঁদা।
স্থানীয় বাজারের ক্ষুদ্র ব্যাবসায়ী শঙ্কর বাবু নামে একজন অভিভাবক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান,স্কুল সমাপনী পরীক্ষার ফি হিসেবে ৬০ টাকা হারে নেয়ার নিয়ম থাকলেও এর আগেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে একশ’ থেকে দেড়শ’ টাকা হারে আদায় করা হয়। এলাকায় নিজ পরিচিতি তুলে ধরতে স্কুলের সভাপতি তার নিজের খেয়াল-খুঁশি মতো স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে চাঁদা আদায়ের মতো নানা সব উদ্ভট সিদ্ধান্ত নেয়। নিজে প্রচুর টাকা-পয়সার মাালিক হওয়ায় স্থানীয়দের থোরাই কেয়ার করেন তিনি।
তিনি আরও জানান, স্কুলে নিম্ম-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীদের ব্যাপারে একবারেই উদাসীন কর্তৃপক্ষ। শিক্ষকরাও তারই মতো যাচ্ছে-তাই। স্কুল টাইমে শ্রেণি কক্ষে নির্ধারিত ক্লাস বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীদের কোচিং সারেন। হাতিয়ে নেন মোট অঙ্কের টাকা। অনেকে দুপুরের খাবার সারেন বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীদের টিফিন ক্যারিয়ারে আনা খাবারে। সভাপতি আর শিক্ষকদের স্কুল যেন এক পরিচিত বাণিজ্য।
অভিভাবক নুরুল ইসলাম দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘মাইয়াডার পরীক্ষায় বিরুপ অইবে। হ্যাইয়ার লইগ্যা টাহা দেওন লাগবে। মোটরসাইকলে এ্যাহন কড়াকড়ি আইন অইছে। সব কাগজ, হেলমেট না থাকলে সদরেও ওঠন যায় না; মোডা জরিমানার ডর। কাগজ করণ লাগবে। মাইয়াডার ফেয়ারওয়েলের লইগ্যা ৭০০ টাহা পামু কই।’
অভিভাবক শঙ্কর বাবুও প্রায় অভিন্ন সুরে দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘ধার-দেনায় সংসার চলে। সপ্তাহের ঋনের কিস্তি টানন লাগে। কমিটি আর স্যারেগো আমাগো মতোন গরীব মাইনষের পোলাপানের থাইক্যা কম লওন উচিত।’
স্থানীয়রা জানান, পাশের স্কুলের একজন প্রধান শিক্ষক জানান, সভাপতি ও কমিটির লোকজনের সহযোগিতায় স্কুল সমাপনী পরীক্ষার্থীদের প্রতিবার বিদায় উপলক্ষে পেন্সিলবক্স, জ্যামিতিবক্স, বোর্ড এসব উপহার সামগ্রী এবং শিক্ষকদের উদ্যোগে মিষ্টি খওয়ানোর আয়োজন করলেও ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোন রকমের চাঁদা নেননি।
প্রথমে এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে চাঁদা আদায়ের সত্যতা স্বীকার করে স্কুলের প্রধান শিক্ষক আভা রাণী দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘আমি স্কুলে অল্প কয়েকদিন আগে যোগদান করেছি। সভাপতি ও স্যাররা মিটিংয়ে টাকার বিষয়টি নির্ধারণ করেছেন। ওই দিন আমি স্কুলে ছিলাম না। এক স্যার কোচিং করিয়েছেন তার বাবদ ও অন্যান্য খরচ হিসেবে টাকা নেয়া হচ্ছে।’
৭০০ টাকা নেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে স্কুল কমিটির সভাপতি মো. দলিল উদ্দিন খান দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘স্যারদের প্রাইভেট ও অন্যান্য খরচ বাবদ টাকা নেয়া হচ্ছে। প্রতিবছর আমি পকেট থেকে অনেক খরচ করি। এবারেও আরো বাড়তি খবর আমার দেয়া লাগবে।’
এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রিয়াজুল হক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। তদন্ত করে দেখা হবে। ঘটনা সত্য হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে।’