যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। বিশেষ করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ কাজ চলছে জোরেশোরে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে তালিকা তৈরির কাজ শেষ করেছে। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে তালিকার কাজ চলছে। যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে এ মাসের মধ্যেই তালিকার কাজ শেষ করতে চাইছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। আগামী মাসের শুরুর দিকেই তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিতে চান উপাচার্যরা।
গুলশান ও শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের শনাক্তকরণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুসারেই তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (বিশ্ববিদ্যালয়) হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘১০ দিন অনুপস্থিত থাকাটা হলো একটা মাপকাঠি। তবে একটি ছেলে যৌক্তিক কারণে এক বছরও অনুপস্থিত থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হলে প্রথমে অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাতে সন্তুষ্ট না হলে জেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে আমাদের জানাতে হবে। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই প্রাথমিক কাজটা শুরু করেছে।
শনিবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের নিয়ে বৈঠক হবে। এরপর হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ব্যাপারে আমরা এ বিষয়ে আরো গাইডলাইন দেব। সেটা ইউজিসির মাধ্যমেও বাস্তবায়ন করা হতে পারে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ায় আমাদের সুষ্ঠু কার্যক্রম নষ্ট করে ফেলছে। আর কিছুদিন পর থেকেই হয়তো অনুপস্থিতির তথ্য আমরা পেতে শুরু করব।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া ১০ দিনের বেশি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করবে সংশ্লিষ্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনার পর অনুপস্থিতির কারণ সন্দেহজনক বলে প্রমাণিত হলে উপজেলা শিক্ষা প্রশাসনকে জানাতে হবে। তারা জেলা শিক্ষা অফিসারের মাধ্যমে বিষয়টি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবে। সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ইউজিসির (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) মাধ্যমে বিষয়টি জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠাবে। জেলা প্রশাসক পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের ঠিকানা ও মোবাইল ফোন নম্বর সংরক্ষণ করবে। প্রয়োজন হলে অভিভাবকদের সঙ্গে আলোচনা করবে। পুরো বিষয়টি তদারক করবে শিক্ষা প্রশাসন।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষকদের যোগাযোগ খুব একটা না থাকলেও স্কুল-কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা পরস্পকে চেনে। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা পাওয়ার পর স্কুল-কলেজ কর্তৃপক্ষও জোরালোভাবে কাজ শুরু করেছে। তবে একাধিক স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা জানিয়েছেন, যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া তাঁদের প্রতিষ্ঠানে অনুপস্থিত শিক্ষার্থী নেই বললেই চলে। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৯৫টি। সূত্র জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সুনাম নিয়েও ভাবছে। জঙ্গি তত্পরতায় জড়িত শিক্ষার্থীর খোঁজ পাওয়া গেলে ওই প্রতিষ্ঠানে আর কেউ ভর্তি হবে না—এমন শঙ্কা থেকে বিষয়টি লুকানোর চিন্তাও রয়েছে অনেকের।
যোগাযোগ করলে আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এম এম সাইফুল্লাহ বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানে ১৫ দিনের বেশি যারা অনুপস্থিত রয়েছে তাদের তালিকা করেছি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক এসেছিল, তাদের এসব তথ্য দেওয়া হয়েছে। সংখ্যাটা ৩৮ জনের কাছাকাছি হবে। তবে তারা কী কারণে অনুপস্থিত তা আমরা খুঁজে বের করিনি।’
নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘অনুপস্থিতির তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছি। তালিকাটি আমরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দেব।’
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির উপাচার্য সৈয়দ সাদ আন্দালিব বলেন, ‘রেজিস্ট্রারের দপ্তরকে তত্পর করা হয়েছে। সব বিভাগকে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই আমরা তা হাতে পাব। এখন প্রত্যেক শিক্ষার্থীর আইডি চেক করে ঢোকানো হচ্ছে। হটলাইন খোলা হয়েছে, শিক্ষার্থীরা এখান থেকে সব সময় সেবা পাবে। শিক্ষকদের বলেছি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আরো বেশি সম্পৃক্ত হতে। সব ক্লাব সক্রিয় করা হয়েছে। তবে জঙ্গিবাদের চর্চা আমাদের প্রতিষ্ঠানে নেই বলেই মনে হচ্ছে।’
মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য প্রফেসর ড. চৌধুরী মাহমুদ হাছান বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে সব বিভাগে সার্কুলার জারি করেছি। প্রতিটি বিভাগ ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর তালিকা দেবে। এরপর আমরা অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলব। অনেক শিক্ষার্থীই আছে, যারা রেজিস্ট্রেশন করার পর ভালো ইউনিভার্সিটিতে সুযোগ পেয়ে চলে যায়। মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেলেও অনেকে যোগাযোগ করে না। আবার অনেকে অসুস্থ থাকে। তারা যাতে হয়রানির শিকার না হয় সেদিকটায় আমরা লক্ষ্য রাখব। আসলে শিক্ষার্থীদের জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে আনতে মোটিভেশন দরকার। পিতামাতাকেও আরো সচেতন হতে হবে।’
নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ বলেন, ‘আমরা অনুপস্থিতি নিয়ে আগে থেকেই সতর্ক। পরপর তিন দিন অনুপস্থিত থাকলে যুক্তিসংগত কারণসহ আবেদন করতে হয়। নইলে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হয় না। তার পরও আমরা অনুপস্থিতির তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। সাত দিনের মধ্যে শেষ করে ফেলব।’
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টসের (ইউল্যাব) উপাচার্য প্রফেসর ইমরান রহমান বলেন, ‘অনুপস্থিত শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছি। অভিভাবকদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো শিক্ষার্থীর অস্বাভাবিক অনুপস্থিতির তথ্য হাতে আসেনি।’
গ্রীন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক মো. গোলাম সামদানী ফকির বলেন, ‘আমরা সব বিভাগকে জানিয়ে দিয়েছি অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের তথ্য সংগ্রহের জন্য। খুব শিগগির এ কাজ শেষ করে মন্ত্রণালয়কে জানাব।’
রাজধানীর ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. মাকসুদ উদ্দিন বলেন, ‘নির্দেশনা পাওয়ার পরই আমরা সব শিক্ষককে জানিয়েছি।’