ভাষা হচ্ছে ‘সিসিম ফাঁক’-এর মতো জাদুকরী এক চাবি, যা দিয়ে সহজেই খুলে যায় একটি জাতির হাজার বছর ধরে সঞ্চিত ইতিহাস-ঐতিহ্য, ওষুধপত্র, আচার-আচরণ ও শিল্প- সাহিত্য-সংস্কৃতির মতো ‘বিবিধ রতনের’ অনন্য ভান্ডার। কোনো জাতি যদি তার মাতৃভাষা হারিয়ে ফেলে, তাহলে তার পূর্বপুরুষের অর্জিত অমূল্য সেই ভান্ডারের দ্বার শুধু তার জন্যই নয়, পুরো মানবজাতির জন্য চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়।
জৈব প্রজাতির মতো ভাষারও জন্ম, মৃত্যু, বেড়ে ওঠা, বুড়ো হওয়া এবং মরে যাওয়া স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু ভাষাবিদেরা লক্ষ করেছেন যে গত শতাব্দী থেকে বিপন্ন কিংবা মৃত ভাষার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী মোট ৪২ হাজার ১৯২টি ভাষার মধ্যে পৃথিবীতে এখন মাত্র ছয় হাজার ভাষা জীবিত। এবং এখন যে হারে ভাষা অবলুপ্ত হচ্ছে, তাতে আগামী ১০০ বছরে ৫০ শতাংশ ভাষা হারিয়ে যাবে। অর্থাৎ, প্রতি দুই সপ্তাহে মৃত্যু হবে অন্তত একটি ভাষার।
ভাষার স্বাভাবিক মৃত্যু নিয়ে তেমন চিন্তার কিছু নেই। অনেক সমৃদ্ধ ভাষা যেমন সংস্কৃত, লাতিন বা গ্রিকের স্বাভাবিক ‘মৃত্যু’ হয়েছে; তাতে এমন কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি। কারণ, এই ভাষাগুলো আবার অন্য ভাষা তৈরি করেছে বা অন্য ভাষায় ছড়িয়ে গেছে। যেমন সংস্কৃত থেকে উৎপত্তি হয়েছে ভারতের অনেক ভাষা, ব্যবহারিক লাতিন থেকে এসেছে রোমান ভাষাগুলো আর প্রাচীন গ্রিক থেকে তৈরি হয়েছে আধুনিক গ্রিক ভাষা।
ভাষার অস্বাভাবিক মৃত্যুটাই ভাবার বিষয়। কোনো ভাষা যদি অন্য ভাষার আক্রমণে নিহত হয় বা সে নিজে আত্মহত্যা করে, কিংবা হঠাৎ করে তার ভাষাভাষীদের মৃত্যুর কারণে সে হারিয়ে যায়, তাহলে সেই ক্ষতি আর পূরণ হয় না। ইংরেজির বিরুদ্ধে যে ভাষা হত্যার অভিযোগ আনা হয়, সে প্রসঙ্গে ডেভিড ক্রিস্টালদের মতো ভাষাবিদেরা বলেন, ইংরেজি নিজ গুণেই শক্তিশালী এবং তার শক্তিমত্তার কারণে অন্য দু-একটা ভাষা যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তো সেটা তার দোষ নয়। কিন্তু ফিলিস্তিন বা পেনিকুকদের মতো সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভাষাবিদদের মতে, ইংরেজি ভাষার বর্তমান দৌরাত্ম্য কোনো স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ফল নয়। এই ভাষাটিকে ইংল্যান্ড-আমেরিকার মতো দেশগুলো সুপরিকল্পিতভাবে শোষণের হাতিয়ার করার জন্য সর্বগ্রাসী করে তুলেছে। ফলে ইংরেজির চাপে এখন কোনো ভাষার মৃত্যু হলে তাকে আর স্বাভাবিক মৃত্যু বলা যাবে না, ‘হত্যা’ই বলতে হবে। যেমন আয়ারল্যান্ডে ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসকেরা সুপরিকল্পিতভাবে আইরিশ ভাষাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছেন।
একটি ভাষার মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলা যায় তখন, যখন সেই ভাষাভাষী মানুষেরা স্বেচ্ছায় কোনো লাভের আশায় কিংবা অনধাবনতাবশত ‘কমল-কানন’ ভুলে ‘শৈবাল’ নিয়ে মত্ত হয়ে পড়ার ফলে তাদের ‘মাতৃভাষা-রূপ খনি’টি হারিয়ে ফেলে। ভাষাবিদ সালিকোকো মায়োন বলেছেন, এসব ক্ষেত্রে অনুরোধ করলেও তারা তাদের ভাষা ধরে রাখতে চায় না। প্রাকৃতিক কারণেও অনেক ভাষা নিশ্চিহ্ন হয়। জাতিসংঘের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, সুনামিতে বঙ্গোপসাগরের যে দ্বীপগুলো নিশ্চিহ্ন হয়েছে, তাতে অন্তত ছয়টি ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এখন দেখা যাক বাংলা ভাষার অবস্থা কী। বাংলা এখন পৃথিবীর আটটি বড় ভাষার মধ্যে একটি। এই ভাষায় উঁচু মানের সাহিত্য তৈরি হয়েছে; এই ভাষার কবি সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন; এই ভাষা সিয়েরা লিয়নে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে; এই ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছে; এই ভাষাই এখন মাতৃভাষা দিবসের মাধ্যমে সারা পৃথিবীর মানুষকে নিজ নিজ ভাষা রক্ষায় ও উন্নয়নে অনুপ্রাণিত করছে; এবং এই ভাষাতে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, আসাম, মণিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ৩০ কোটি লোক কথা বলছে।
কিন্তু প্রচুর ভাষাভাষী থাকার পরও একটি ভাষায় আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিতে পারে। যদিও ভাষাবিদ ইয়ামামোটো মনে করেন, ভাষার বিপন্নতা নির্ণয়ে ভাষাভাষীর সংখ্যা একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। ডেভিড ক্রিস্টাল বলছেন ভিন্ন কথা, প্রায় ২ কোটি লোক ইউরোবা ভাষায় কথা বললেও এটি একটি বঞ্চিত ভাষা হিসেবেই পরিচিত। আর বাংলা ভাষা? যত দিন যাচ্ছে, অবহেলায় ও ঔদাসীন্যে ক্রমেই মুমূর্ষু হয়ে পড়ছে বাংলা।
এখন ইংলিশ মিডিয়ামের অনেক ছাত্রছাত্রীর বাংলা শুনলে এটা যে তাদের মাতৃভাষা তা মনে হয় না। কোনো কোনো গণমাধ্যম বা বিজ্ঞাপনে এখন ইংরেজি-বাংলা-হিন্দি-আঞ্চলিক ভাষা মিশিয়ে যে কী বলা হচ্ছে, তার সংজ্ঞা দেওয়া দুষ্কর। তরুণেরা এখন যে ভাষার দিকে ঝুঁকছে, তা না প্রমিত, না বিশেষ কোনো আঞ্চলিক ভাষা। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এসএমএস এবং ই-মেইলের অসম্পূর্ণ শব্দ ও বাক্যের যথেচ্ছ ব্যবহার। ব্যাকরণ, বানান ও প্রথাকে তুচ্ছ করার এই প্রবণতা আত্মহননের সমতুল্য বলে ভাবছেন প্রবীণ বাণীসাধকেরা।
শহুরে অনেক তরুণ-তরুণী যে এখন তাদের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে পারে না, তার কারণ তাদের বাবা-মা এখন ছেলেমেয়েদের নিজেদের আঞ্চলিক ভাষা না শিখিয়ে প্রমিত ভাষা শেখাচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের বাবা-মায়ের সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছেন আর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে বলছেন প্রমিত ভাষা। এতে ভাষা মনস্তাত্ত্বিকদের ধারণা, দাদু-নানুদের সঙ্গে ভাষাগত সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ায় ছেলেমেয়েরা শিকড়হীন হয়ে পড়ছে।
তবে ছেলেমেয়েরা যে এতে প্রমিত ভাষা শিখছে, এটা ভাবলেও বিরাট ভুল হবে। তার কারণ, ইংরেজি বা হিন্দির কারণে আমাদের প্রমিত ভাষাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোনো বিদেশি ভাষা যখন একটি জাতি-রাষ্ট্রকে আক্রমণ করে, তার প্রধান লক্ষ্য হয় সেই দেশের প্রমিত ভাষা। এতে অবশ্য প্রমিত ভাষার চাপে থাকায় আঞ্চলিক ভাষাগুলোর কিছুটা লাভ হয়। প্রমিত ভাষা দুর্বল হলে তাদের ব্যবহার বেড়ে যায়। বাংলাদেশেও তা-ই হচ্ছে। আজকাল গণমাধ্যমে আঞ্চলিক ভাষার জয়জয়কার। উপরন্তু, ঢাকা এবং ঢাকার আশপাশের ভাষাগুলোর মিশ্রণে একটি জগাখিচুড়ি এখন বাংলাদেশি তরুণদের লিঙ্গুয়াফ্রাঙ্কা।
তবে ভাষা তো পরিবর্তিত হবেই। পরিবর্তন হয় বলেই তো সে বেঁচে থাকে। ২৫০০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দের ইন্দো-ইউরোপিয়ান থেকে ১১০০ খ্রিষ্টাব্দে এসে প্রাচীন বাংলা, ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দে আদি মধ্য বাংলা, ১৬০০ সালে অর্বাচীন মধ্য বাংলা হয়ে ১৮০০-তে তৈরি হলো আধুনিক বাংলা। অর্থাৎ ‘আদি মধ্য’ থেকে ‘অর্বাচীন মধ্য’ এবং ‘অর্বাচীন মধ্য’ থেকে ‘আধুনিক বাংলা ভাষা’য় রূপান্তরের প্রতিটি ক্ষেত্রে সময় লেগেছে ২০০ বছর। তাহলে এই টিভি-ইন্টারনেট অধ্যুষিত দ্রুত ধাবমান যুগে আধুনিক থেকে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে উত্তরাধুনিক বাংলায় পৌঁছাতে এর চেয়ে অনেক কম সময় লাগার কথা।
তাহলে আমাদের ভাষাবিদ বা ভাষা কারিগরেরা এ ধরনের রূপান্তর পছন্দ করছেন না কেন? তাঁরা সম্ভবত আশঙ্কা করছেন পরিবর্তনের এই বল্গাহীন গতি বাংলা ভাষাকে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে অক্ষম, সাহিত্যের ক্ষেত্র হিসেবে অনুর্বর এবং শিক্ষার বাহন হিসেবে অকেজো করে তুলতে পারে। পরিবর্তনের ঘোড়া ছুটলে তো কোনো আধুনিক মানুষের তাতে আপত্তি থাকার কথা নয়, তবে শক্ত হাতে লাগাম ধরে রাখা চাই there should be method in madness।
একুশে যেমন আমাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীতকে মনে করিয়ে দেয়, তেমনি সাবধানবাণীও উচ্চারণ করে। মনে করিয়ে দেয় ভাষার স্বাভাবিক মৃত্যুর কোনো গ্যারান্টি নেই। বিশ্বায়নের এই যুগে বাইরের আক্রমণ সম্পর্কে যেমন সজাগ থাকতে হয়, তেমনি ঔদাসীন্য ঝেড়ে মাতৃভাষা পরিচর্যায় আরও অনেক বেশি যত্নশীল হওয়ারও কোনো বিকল্প নেই। মানবদেহ যেমন প্রতিদিন খাদ্য ও যত্ন দাবি করে, ভাষাও তেমনি। মানুষ যেমন তার শৈশব, যৌবন, বার্ধক্য পার করে মৃত্যুবরণ করে অন্যভাবে পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে বেঁচে থাকে, ভাষারও সে রকম মৃত্যু বা স্বাভাবিক রূপান্তর হলে ক্ষতি নেই। অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায় তখনই, যখন সে অযত্নে, অবহেলায়, অকালে শুকিয়ে যায় কিংবা সুপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়।
এই ফেব্রুয়ারি মাসে একুশ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে ঝিমোতে ঝিমোতে সুবর্ণ অতীতের জাবর কাটতে থাকলে একদিন দেখব কখন অলক্ষ্যে আমাদের প্রাণের ভাষাটি হারিয়ে গেছে, সেই সঙ্গে অনুর্বর হয়ে গেছে জ্ঞান-বিজ্ঞান-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার নিজস্ব ক্ষেত্র। কিন্তু সমস্যার গভীরতা উপলব্ধি করি না বলে এই মাস পেরোলেই আমরা আবার সব বেমালুম ভুলে যাই। কবি হায়াৎ মামুদের ভাষায় একুশে ফেব্রুয়ারি ‘…চলে গেলে হায়/বুক থেকে অভিধানে শব্দ চলে যায়।’
লেখক: গোলাম ফারুক, ফলিত ভাষাতত্ত্ববিদ, গবেষক, অধ্যাপক।