অভিভাবকের দিনলিপি - Dainikshiksha

অভিভাবকের দিনলিপি

আসিফ নজরুল |

আমার একটি পুরোনো গাড়ি আছে। এর ভেতর তিন সন্তানকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে বের হতে হয় সকাল ৭টা ১৫ মিনিটের মধ্যে। যদি ৫ মিনিট পর বের হই, সন্তানদের স্কুলে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাবে ১৫ মিনিট। আর ১০ মিনিট দেরি হলে যানজটে এমন অবস্থা হবে যে তাদের পৌঁছানোরই কোনো ঠিক-ঠিকানা থাকবে না। এসব এখন আমার মুখস্থ।

কাজেই আমাদের দিন শুরু হয় সকাল সাড়ে ছয়টায়। ৪৫ মিনিটের মধ্যে পাঁচ থেকে নয় বছর বয়সী তিন সন্তানকে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি করাতে হয়। তারপর প্রাণপণে ছুটতে হয় ধানমন্ডির স্কুলের দিকে। সকালবেলায় রাস্তায় গাড়ি আর রিকশার মিছিল। এই মিছিলে তবু এঁকেবেঁকে কোনোমতে পৌঁছোনো যায়। আসল সমস্যা শুরু হয় স্কুল ছুটির পর।

স্কুল ছুটির সময়টা নির্দিষ্ট। তবে সেখানে পৌঁছাতে কতক্ষণ লাগবে, তা বলার ক্ষমতা পৃথিবীর কারও নেই। তাই আগে আগে স্কুলের পথে রওনা দিতে হয়। স্কুলে পার্কিং নেই বলে আগে পৌঁছালে বাধ্য হয়ে রাস্তায় গাড়ি রাখতে হয়। ড্রাইভার গাড়িতে, আমি সন্তানকে আনতে অভিভাবকের ভিড় ঠেলে স্কুলে।

প্রতিদিনের এই রুটিন মেনে একদিন বড় মেয়েকে নিয়ে তার স্কুল থেকে বের হয়েছি। দেখি ড্রাইভার নেই আশপাশে কোথাও। ক্লাস থ্রি–তেই মেয়ের কাঁধ নুইয়ে দেওয়া প্রকাণ্ড বইয়ের ব্যাগ। আমি তার কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে হাতে নিই। ড্রাইভারকে ফোন করি। সে জানায় যে সার্জেন্ট আছেন রাস্তায়, তাই অন্য রাস্তা ঘুরে আবার আসছে সে। তার আসতে আসতে লাগে আরও ১০-১৫ মিনিট। ফুটপাতে তখন দাঁড়ানোর জায়গা নেই, মানুষের ভিড়ে ঘেমে-নেয়ে একাকার সবাই। আমি ভাবি, তবু রক্ষা যে ট্রাফিক সার্জেন্টের পাল্লায় পড়েনি আমার গাড়ি!

সার্জেন্টের পাল্লায় অবশ্য আমরা পড়েছিলাম আগে। ধানমন্ডির ভেতরের রাস্তায় পার্ক করে রাখা গাড়িগুলোকে সমানে জরিমানা করে যাচ্ছিলেন তিনি। যারা পালানোর তারা এর মধ্যে পালিয়েছে। আমি না পালিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম: ভাই গাড়ি তাহলে রাখব কোথায়? তিনি নির্বিকার গলায় বলেন: সেটা আমি কী জানি? কে জানেন? তিনি আবারও বলেন: আমি কী জানি!

ট্রাফিক সার্জেন্ট আমাকে ঠিক কথাই বলেছিলেন। তাঁর কাজ রাস্তার পাশে পার্ক করে থাকা গাড়িকে ফাইন করা। স্কুলের কাজ স্কুল বানানো, গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা বানানো না। সরকারের কাজ স্কুলকে চলতে দেওয়া, আমাদের গাড়ি চালাতে দেওয়া এবং পুলিশকে ফাইন করতে বলা। আমাদের কাজ হচ্ছে ফাইন দেওয়া। অথবা গাড়ি নিয়ে অনন্তকাল স্কুলের সামনে ঘুরতে থাকা। আমাদের সন্তানদের কাজ ভারী ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্ষুধার্ত মুখে গাড়ির জন্য অপেক্ষা করা!

স্কুল ছুটির সময় এখন তাই প্রায় প্রতিদিন কাটে চোর-পুলিশ খেলায়। সার্জেন্ট আসামাত্র ড্রাইভার পালাবে। না হলে সার্জেন্ট আসার আগেই বাকি সব অভিভাবককে ঠেলে সন্তানসহ হুড়মুড় করে ঢুকে পড়তে হবে গাড়ির ভেতর।

কিন্তু সেখানে ঢুকেও নিস্তার নেই। সেখানে ঢুকে মাঝে মাঝে শুরু হয় নতুন যন্ত্রণা। কোনো দিন ভিভিআইপিরা চলাচল করেন রাস্তায়, কোনো দিন উল্টো পথে গাড়ি হাঁকান হর্তাকর্তারা, কোনো দিন রাস্তায় নামে মিছিলের শোরগোল। বাকি সব মানুষ নিশ্চল হয়ে দেখে এসব। আমিও।

আমার গাড়িতে এসি নেই ভালো, আমার গাড়িতে গ্যাস শেষ হয়ে যাওয়ার ভয়, আমার গাড়িতে আরও বহু ডিউটির তাড়া! অসহায় চোখে দেখি সন্তানের ঘর্মাক্ত মুখ। আশপাশে রিকশায় বা পিতার মোটরসাইকেলে ঝুলে থাকা বা ক্লান্ত পায়ে হেঁটে যাওয়া আরও বহু স্কুল-ফেরতা শিশুদের। তাদের অবস্থা আরও করুণ, আরও হৃদয়বিদারক। তাদের দেখি আর ভাবি, এই অরাজকতার শেষ কোথায়?

২.

আমি জানি, এই প্রশ্নের উত্তর আছে। এর উত্তর হচ্ছে সন্তানকে পাবলিক ট্রান্সপোর্টে করে স্কুলে নেওয়া। এর উত্তর হচ্ছে সন্তানকে বাড়ির কাছের স্কুলে ভর্তি করানো। কিন্তু এসব উত্তর উন্নত বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য, বাংলাদেশের জন্য নয়।

ইউরোপ-আমেরিকায় সন্তানকে ভর্তি করাতে হয় পাড়ার বা স্থানীয় স্কুলে। এটি সাধারণত বাধ্যতামূলক সবার জন্য। কাছে হলে হেঁটে সন্তানকে স্কুলে নেওয়া যায়। একটু দূরের যাত্রীদের জন্য থাকে স্কুলে নেওয়ার অত্যন্ত নিরাপদ, নিয়মিত ও নিশ্চিত বাস সার্ভিস। ফলে সেখানে এসব কাজে প্রাইভেট গাড়ির ব্যবহারও হয় খুব কম।

একই ব্যবস্থা রয়েছে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের উন্নত দেশগুলোতেও। প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কিছু শহরে এই ব্যবস্থা রয়েছে। আবার ভুটানে আমি দেখেছি, স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ সড়কপথে দলবদ্ধভাবে হেঁটেই যাতায়াত করে স্কুলের শিশুরা।

বাংলাদেশে এর কোনোটিরই সুব্যবস্থা নেই। এখানে একটা সময় সন্তানকে স্থানীয় স্কুলে পড়ানোর রেওয়াজ ছিল। কিন্তু তখন যেকোনো স্কুলে পড়াশোনার মান ছিল উন্নত পর্যায়ের এবং সমাজে শিক্ষাকেন্দ্রিক বৈষম্য ছিল বহুলাংশে অনুপস্থিত।

বর্তমান অবস্থায় এসব কল্পনাই করা যায় না। একটা উদাহরণ দিই। আমাদের ছাত্রাবস্থায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল ছিল অত্যন্ত উন্নতমানের। নব্বইয়ের দশকের আগ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু শিক্ষকের সন্তান সেখানেই পড়াশোনা করত। এরপর ক্রমে এই বিদ্যালয়টিতে রাজনৈতিক কর্মী ও আত্মীয় নিয়োগ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক অন্যায্য খবরদারি শুরু হয়, শুরু হয় কোচিং-বাণিজ্যের প্রকোপও। অবস্থা এখন এমন যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ও সচেতন অভিভাবকদের কেউ আর এখন এই স্কুলে তাঁর সন্তানকে পড়ানোর কথা চিন্তাই করেন না। নানা অব্যবস্থা রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত অন্য আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্কুল উদয়ন স্কুলেও।

স্থানীয় এলাকায় ভালো স্কুল না পেয়ে আমরা ছুটি ধানমন্ডি, কেউ কেউ গুলশান-বনানী এলাকায়। এসব এলাকায় আমরা যাব কীভাবে? স্কুল ছুটি আর শুরুর সময়ে স্কুলযাত্রী সন্তান নিয়ে ঢাকার পাবলিক বাসে চলাচল করা যায় না। ঢাকার পাবলিক বাস শিশুদের জন্য কতটা দুঃসাধ্য, কতটা অনিশ্চিত এবং কতটা ঝুঁকিপূর্ণ তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। বাকি থাকে রিকশা। ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় রিকশা চলাচলে বাধা রয়েছে, সকালে মানুষের ভিড়ে রিকশার স্বল্পতার সমস্যাও রয়েছে। বাধ্য হয়ে মধ্যবিত্ত পর্যায়ের বহু মানুষকে এখন সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে হলেও ব্যবহার করতে হচ্ছে প্রাইভেট কার।

এই প্রাইভেট কারে এখনই সয়লাব ঢাকার রাস্তা। আধা ঘণ্টার পথ প​াড়ি দিতে লাগে দেড় ঘণ্টা। তার মানে ১০০ টাকার গ্যাস যেখানে খরচ হবে, সেখানে আমরা খরচ করি ৩০০ টাকার। গ্যাস নেই বলে এখন বাসাবাড়িতেই দেওয়া হচ্ছে না। আর আমরা একটু সুবিধাভোগীরা সন্তানদের স্কুলে দিতে-আনতেই অপচয় করে ফেলছি দুষ্প্রাপ্য গ্যাস। অপচয় করছি নিজের টাকা, নিজের আর সন্তানের সময়, শক্তি, সম্ভাবনা!

এখনই এই অবস্থা হলে, আগামী পাঁচ-দশ বছর পর আরও কী ভয়াবহ অবস্থা হবে দেশে? বিশেষ করে ঢাকার মতো অতি জনবহুল শহরে?

৩.

আমি শিক্ষার সংস্কার নিয়ে ভাবার মতো বড় মানুষ নই। সৃজনশীল পদ্ধতি, গুচ্ছ প্রশ্ন, অভিন্ন ধারার শিক্ষা, পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু—এসব নিয়ে ভাবার মতো বিশাল বিশাল মানুষ আছেন এ দেশে। আমি তাঁদের কেউ না, আমি কেবলই একজন অভিভাবক। সমাজের আরও বহু মানুষের মতো একজন ভুক্তভোগী অভিভাবক।

আমি তাই ভাবি সন্তানকে প্রতিদিন স্কুলে আনা-নেওয়ার ভোগান্তি নিয়ে। ভাবি, চাইলেই তো এর কিছুটা সমাধান করতে পারত আমাদের সরকারগুলো। এলাকাভিত্তিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা যেত, স্কুলগুলোর প্রশাসনে স্বাধীনতা এবং কার্যক্ষেত্রে মান নিশ্চিত করার ব্যবস্থা নেওয়া যেত, যোগাযোগব্যবস্থায় সত্যিকারের উন্নয়ন করা যেত, ব্যাপকভাবে উন্নতমানের পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালু করা যেত, ঢাকা ও অন্যান্য বড় শহর থেকে সব গার্মেন্টস, শিল্পকারখানা এবং বিভিন্ন বাহিনীর অফিসগুলো সরিয়ে নেওয়া যেত।

স্বার্থপরের মতো আবার শুধু নিজেদের কথাও ভাবি। এত বড় বড় উপাচার্য ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, চাইলেই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুলগুলোর মান রক্ষা করতে পারতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল এলাকায় নিজেরাই একটি সেরা মানের ইংরেজি মাধ্যম স্কুলও গড়ে তুলতে পারতেন, এমনকি দেশের সেরা স্কুলগুলোর কোনো একটিকে শাখা খোলার ব্যবস্থাও নিতে পারতেন।

চাইলেই কত কিছু করা যেত, কত কিছু করা যায়। পিলপিল করে বের হয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো গাড়ি বা রিকশা খুঁজতে থাকা শিশু, রাস্তায় ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়া স্কুলড্রেস আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশ্চল যানজট দেখি প্রতিদিন। ভাবি, চাইলেই যাঁরা করতে পারেন কিছু, সমাজের সেই হর্তাকর্তা কেন করেন না তেমন কিছু?

ভাবি, হয়তো তাঁদের জীবন আর জগৎটা আলাদা বলেই হয় না কিছু। তাঁদের সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য আছে উন্নত বিশ্বের স্কুল

অথবা স্বনির্মিত এলাকার নিরাপদ স্কুল। তাঁদের অভিধানে রাস্তায় থেমে থাকা নেই, আশপাশের মানুষের ভোগান্তি দেখার চোখ নেই, অন্যকে

নিয়ে ভাবার হৃদয় নেই। যদি থাকত তাহলে সমাজের এই আধা শতাংশ মানুষ শুধু নিজেরটা না ভেবে বাকিদের জন্য ভাবতেন, তাদের জন্য কিছু করতেন।

এমন কিছু করার সুযোগ এখনো রয়েছে। সব জায়গায়, সব ক্ষেত্রে।

 

আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036678314208984