যুগ পাল্টালে এমনই হয় । মুরুব্বিদের মুখে শুনা, ‘ কলির কালে অমানুষ মানুষ হবে,আঘাটে ঘাট হবে ।’ এসব কথা কভু মিথ্যে হয়নি। কলির যুগ এসে পড়েছে কিনা জানিনে । কিন্তু মুরুব্বিদের অনেক কথাই ফলতে শুরু করেছে ।
তা না হলে আমাদের দেশে শিক্ষকদের নিয়ে এতো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য মনোভাব কেনো ? প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সকল স্তরের শিক্ষকদের হেয় চোখে দেখার দুঃসাহস ওরা পায় কী করে ? এই তো অষ্টম জাতীয় পে কমিশনে যারা কাজ করেছে,তারা কী কেরামতি ই না দেখালো ! দেশের আপামর শিক্ষকদের তারা হেয় জ্ঞান করে জাতিকে কলংকিত করলো ।
মাছের পঁচন শুরু হয় মাথা থেকে। একটি জাতির পঁচন যখন শুরু হয়, তখন সে জাতির বেঁচে থাকার আশা ক্ষীণ হয়ে ওঠে । আমাদের জাতিটাকে মেরে ফেলার এজেন্ডা কেউ বাস্তবায়ন করছে কীনা, কে জানে ?
কোনো জাতিকে হত্যা করতে হলে সে জাতির শিক্ষা,সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংশ করতে হয় । আর সে সবের ধারক ও বাহক হচ্ছেন শিক্ষক । শিক্ষক তিল তিল করে জাতিকে সভ্য করে তুলেন ।
অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কাজ করেন একজন শিক্ষক । এক প্রকার মোহে পড়ে শিক্ষক তাঁর সারাটি জীবন কাটিয়ে দেন । নিজের চিন্তা- চেতনা ও আদর্শকে সমাজে ফলাতে গিয়ে অনেক সময় নিগৃহীত হতে হয় তাঁকে ।
একজন শিক্ষকের কর্মের সুফল কোনো জাতি যুগ যুগান্তরে বছরের পর বছর ভোগ করতে পারে । শিক্ষকদের মধ্যে কোন দূর্ণীতিবাজ নেই । শিক্ষকের চাওয়া সীমিত কিন্তু আত্ম মর্যাদা বোধ প্রখর । শিক্ষকের গবেষণালব্ধ জ্ঞান জাতিকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ডঃ মুহম্মদ ইউনুসের উদাহরণ তুলে ধরা যেতে পারে । তাঁর অসামান্য কর্মের সুফল এ জাতি তো বটেই,বিশ্বের বহুদেশ ও বহুজাতি ভোগ করছে । তাঁর নোবেল প্রাপ্তিতে জাতি অনন্য মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । তিনি মূলতঃ একজন শিক্ষক হিসেবে দেশ ও জাতির জন্য এ অনন্য গৌরব বয়ে এনে কেবল নিজে নহে, দেশের গোটা শিক্ষক সমাজকে গৌরবান্বিত করেছেন ।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিষয়ে ‘আমলাতন্ত্র’ সম্পর্কে পড়েছিলাম । আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে কিভাবে দেশে নানা জটিলতার সৃষ্ঠি হয় তা কিছুটা পরীক্ষা পাসের জন্য শিখেছিলাম বটে, কিন্তু ততটুকু মনে প্রাণে বিশ্বাস করিনি । তবে তাদের ভীত খুব একটা মজবুত তা তখনি মনে হয়েছে । কেননা, তাদের প্রসঙ্গে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বলা হয়েছে – Minister may come & minister may go but the official remain in the office .
আমলারা নিজেদের খুব গুরুত্বপূর্ণ ও শক্তিশালী মনে করেন। দেশটার দন্ডমুন্ডের কর্তা বুঝি তারাই ! তাদের ইচ্ছায় সবই হবে । আমাদের রাজনৈতিক অনেক নেতাকে ও তারা কাবু করে বসেন । তাদের পরামর্শেই দেশ ও রাষ্ট্র চলে । পরামর্শ দানে দোষের কিছু দেখিনা । কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত পর্যন্ত তারা দিয়ে বসেন,তখন সঙ্গত কারণেই যে কোন নাগরিক আহত হন ।’পাবলিক সার্ভেন্ট’ হয়ে পাবলিকের উপর তাদের মোড়লিপনা কারোই কাম্য নহে।
আমলাদের ঔদ্ধত্যপনায় জাতি কখনো কখনো ভয়াবহ জটিলতায় পতিত হয় । তারা আইনের ফাঁক- ফোকর খুব ভাল বুঝেন এবং এরই সুযোগে নানা দূর্ণীতির জন্ম হয় ।
আমাদের দেশে আমলারা দিনে দিনে নিয়ন্ত্রণহীন ও বেপরোযা হয়ে উঠছেন।নানা সময়ে জনগণের ইচ্ছা বা সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে তারা তাদের নিজস্ব মত ও পথকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।নিজেরাই একটি স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছেন।কোনো কোনো অদক্ষ রাজনেতিক নেতার সরলতাকে তারা স্বীয় স্বার্থে ব্যবহার করে সংকট সৃষ্ঠি করেন, যার খেসারত সমগ্র জাতিকে দিতে হয়।তাই আমাদের দেশের আমলাদের সরকারকেই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এ সব আমলারাই অষ্টম পে -স্কেলে সরকারের অবস্থা লেজে গোবরে করে ফেলেছে । সরকারকে তারা কতোই না বেকায়দায় ফেলে রেখেছে ! সরকারের সাথে অন্য অনেককে মুখোমুখি করলে ও শিক্ষকদের সরকারের মুখোমুখি করাটা মোটে ও তাদের সাজে নাই । বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ আন্দোলনের মাঠে নেমেই পড়েছিলেন । ভাগ্যিস,আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রি এগিয়ে না এলে কী যে হতো বলা- ই কঠিন । সরকারি কলেজের শিক্ষকরা আন্দোলনের মাঠে শক্তভাবে গেঁড়ে বসতে যাচ্ছেন । পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেলে সামনে এগুনো ছাড়া পেছনে যাবার পথ তো থাকে না ।
বেসরকারি স্কুল কলেজের শিক্ষক কর্মচারীদের নিয়ে এবার হঠকারিতা কম হয়নি । শিক্ষকতো নয়ই,তাঁদের মানুষ ভাবতে ও যেন আমাদের আমলাদের কষ্ট হয় ! পরিসংখ্যান মেলালে দেখা যাবে,আমলাদের ৯৫% জন না হলেও অন্তত ৯০% জন বেসরকারি স্কুল কলেজে লেখাপড়া করে এ পর্যায়ে পৌঁছেছেন।কিন্তু বেসরকারি শিক্ষকদের প্রতি তাদের এ অন্যায় আচরণ কেন ?
প্রথম দফা পে- স্কেলের গেজেটে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের কথা বলা হয়নি কেনো ? তাঁদের জন্য কী আলাদা গেজেট অত্যাবশ্যক ছিলো? নাকি ইচ্ছা করে ‘বেতন’ কে ‘অনুদান’ বলার জন্য এ কারসাজি ? ডিসেম্বর মাসের বেতন বকেয়া সহ নতুন স্কেলে দিতে বাঁধা কি ছিলো ? জানুয়ারিতে এসে আবার টালবাহানা কেনো ?
বকেয়া যা পারেন দিন, কিন্তু নতুন স্কেলে জানুয়ারি মাসের বেতন এমপিওভুক্ত শিক্ষক কর্মচারীদের না দিলে তা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক কর্মচারীদের সাথে চরম উপহাসের শামিল হবে। যাদের জন্য সংকট সৃষ্টি হবে,জাতি তাদের কোনোদিন ক্ষমা করবে না।
লেখক : অধক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ,কানাইঘাট, সিলেট।