আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার দৈন্যদশা - দৈনিকশিক্ষা

আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার দৈন্যদশা

সৈয়দ জাহিদ হাসান |

‘শিক্ষা’ মানুষের মৌলিক অধিকার। একটি সুস্থ, সুন্দর, উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষিত মানুষ অমূল্য সম্পদ। যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত লোকবলের অধিকারী, সে জাতি তত বেশি উন্নত ও মর্যাদাবান। আমাদের দেশের মানুষ অতীতে শিক্ষার কদর খুব একটা না বুঝলেও এখন কিছুটা বুঝতে শিখেছে। শিক্ষার প্রতি এই যে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এর ফলে আমরা অনেক ঝামেলা থেকে ধীরে ধীরে মুক্ত হচ্ছি। কুসংস্কার, সংকীর্ণতা, অন্ধবিশ্বাস, অপবিশ্বাস, সামপ্রদায়িকতা, প্রতারণা— এসব যেমন সমাজদেহ থেকে লোপ পাচ্ছে, তেমনি আর্থিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকেও আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করছি বিশ্ববাসীর।

বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছে শিক্ষা ছাড়া মুক্তির অন্য কোনো সুন্দর ও টেকসই পথ নেই। তাই সরকার থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত প্রত্যেকেই শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত মনোযোগী। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে নানা রকম ত্রুটি আছে। আমরা যদি কিছু মোটা দাগের ত্রুটি শনাক্ত করি তাহলে দেখব, কারিকুলামে ত্রুটি, প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে ত্রুটি, শিক্ষক নিয়োগে ত্রুটি, শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে ত্রুটি, পরীক্ষা পদ্ধতিতে ত্রুটি, শহর ও গ্রামীণ পরিবেশগত ত্রুটি। এতসব ত্রুটি নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা সেবা।

তবে প্রাথমিক শিক্ষায় সবচেয়ে সমস্যা হলো শিক্ষকের পর্যাপ্ততা ও শিক্ষার্থীর উপযুক্ত ক্লাসরুম সংকট। হাতে গোনা শহরের কয়েকটি স্কুল ছাড়া— বাংলাদেশের সব গ্রামের স্কুলগুলোর চিত্র মোটামুটি একই রকম। একবিংশ শতাব্দীর এই অত্যাশ্চর্য যুগে এসেও বাংলাদেশের গ্রামীণ প্রাথমিক শিক্ষা পদ্ধতি হাসির উদ্রেক না করে পারে না। একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান দিই তাহলে হয়তো বিষয়টি আরো পরিষ্কার হবে। ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় একটি ছোট্ট খবর ছাপা হয় ইঞ্চি দুয়েক জায়গা জুড়ে। ওই ছোট খবরটি মূলত সমগ্র বাংলাদেশেরই একটি বাস্তবচিত্র। সেই খবরে প্রকাশিত হয় ‘নরসিংদী জেলার রায়পুরা উপজেলার ২০৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য থাকায় এসব বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হাজার হাজার কোমলমতি শিক্ষার্থীর পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। জানা যায়, রায়পুরা উপজেলার ২৪টি ইউনিয়নে ২০৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে প্রধান শিক্ষকের ৬৬টি ও সহকারী শিক্ষকের ১০৭টি পদ শূন্য রয়েছে।’ এই তথ্য প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে উদ্বেগের না হলেও একজন শিক্ষক হিসেবে আমার কাছে যথেষ্ট দুশ্চিন্তার কারণ বলেই মনে হয়। একটি উপজেলার ২০৪টি স্কুলের মধ্যে যদি ১৭৩ জন শিক্ষকের পদই শূন্য থাকে, তাহলে বুঝতে হবে গ্রামের মানুষেরা প্রাথমিক শিক্ষার নামে যা পাচ্ছে তা মূলত শুভংকরের ফাঁকি।

শুধু শিক্ষক সংকটই প্রাথমিক শিক্ষাকে পিছনের দিকে টানছে এমন নয়। শিক্ষার্থীর চেয়ে স্কুলগুলোতে শ্রেণিকক্ষের সংখ্যা অত্যন্ত অপ্রতুল। এদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বেশির ভাগ বাচ্চাই ক্লাসরুমে বসে ঠিকমতো ক্লাস করতে পারে না। প্রায় স্কুলেই বেঞ্চের চেয়ে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা বেশি। দেশের অনেক স্কুলের শিক্ষার্থীরাই ক্লাস করে খোলা আকাশের নিচে। পৃথিবীর কোনো সভ্য দেশে খোলা আকাশের নিচে এরকম অভিনব পাঠদান পদ্ধতি আছে কিনা আমার জানা নেই। ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাকের আরেকটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলার পুনঘরদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চার বছরের করুণ কাহিনি। সচিত্র সেই প্রতিবেদন পড়তে বেশ ভালো লাগলেও যারা প্রতিদিনই ওইভাবে ক্লাস করে কেবল তারাই জানে, বিষয়টি কত যন্ত্রণাদায়ক। পুনঘরদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন ভবনটিতে তিনটি কক্ষ ছিল। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ভবনটি জীর্ণ হয়ে পড়ে এবং ২০১১ সালের ২৮ অক্টোবর প্রকাশ্য নিলামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠাকালীন ভবনটি ভেঙে নিলামে বিক্রি করা হয়। তৈরি করা হয় ছয়গজের একটি টিনের ঘর। সেই ঘরে ১৫৭ জন শিক্ষার্থীর স্থান সংকুলান অসম্ভব। তাই বাধ্য হয়েই স্কুল কর্তৃপক্ষ দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য বাইরে গাছতলায় ক্লাসের ব্যবস্থা করে।

দীর্ঘ চার বছর ধরে এভাবেই পাঠদান চলছে পুনঘরদীঘি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। পুনঘরদীঘির সূত্র ধরেই বলতে চাই ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত যে বিদ্যালয়ে তিনটি শ্রেণিকক্ষ ছিল আজ ২০১৬ সালে সেই বিদ্যালয়ে কতজন শিক্ষক আর কয়টি শ্রেণিকক্ষ থাকার কথা, আর সেখানে বর্তমানে কী আছে এই কথাটি চিন্তা করলেই বোঝা যায়, বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক অবস্থা। চরাঞ্চল আর বিলাঞ্চলের যে চিত্র তা যে আরো কত ভয়াবহ তার বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না।

কথায় আছে ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে, কিন্তু গোয়ালে নেই’ আমাদের দেশের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা কাজীর গরুর মতোই। সরকারি-বেসরকারি পরিসংখ্যানে প্রাথমিক শিক্ষার গুণগত ও সংখ্যাগত উন্নতি যতই দেখানো হোক না কেন, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার রুগ্ন স্বাস্থ্যের দিকে যদি এখন সবাই নজর না দেয়া হয়, তাহলে আমাদের উচ্চশিক্ষা মুখ থুবড়ে পড়তে আর বেশি দেরি নেই। প্রাথমিক শিক্ষাকে মানসম্মত করতে এখনই কার্যকর উদ্যোগ নেয়া দরকার। মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন যত দ্রুত করা হবে, ততই শিক্ষার ক্ষেত্র টেকসই ও আশানুরূপ হবে।

লেখক : সৈয়দ জাহিদ হাসান, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0066661834716797