আমার মেয়ে এক কঠিন প্রশ্ন করেছে। অন্যের কাছে প্রশ্নটা কঠিন হবে কি না জানি না। তবে আমার কাছে বেশ কঠিন মনে হয়েছে। তার প্রশ্নের ‘ঠিকঠাক’ জবাব দিতে পারিনি।
নিশ্চয়ই আপনাদের জানতে ইচ্ছা করছে প্রশ্নটা আসলে কী! কোন প্রশ্ন আমার কাছে জটিল ও কঠিন মনে হয়েছে?
মেয়ের প্রশ্ন ছিল—বাবা, পৌরসভার মেয়ররাই তো তাঁর এলাকার মানুষকে চরিত্রগত সার্টিফিকেট দেন? উত্তরে বললাম—হ্যাঁ। হঠাত্ এ প্রশ্ন? মেয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করে বলল, ধরো, আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়েছি। এলাকার বাসিন্দা হিসেবে আমার একটি চরিত্রগত সার্টিফিকেট দরকার। আমাকে সার্টিফিকেট দেবেন বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি এমন কোনো লোক? এইটা কি ঠিক বাবা?
মেয়ের কথা ঠিকমতো বুঝতে না পারলেও আন্দাজে ধরে নিলাম কোথাও কিছু একটা ঘটেছে এবং সেটা মারাত্মক কিছু। তাকে প্রশ্ন করলাম, কি বলতে চাচ্ছ বুঝিয়ে বলো। মেয়ে কালের কণ্ঠ’র ১৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি কপি হাতে ধরিয়ে দিয়ে অস্থিরতা প্রকাশ করে বলল, পড়ো, দেখো… পৃথিবী এগোচ্ছে, আর আমরা পেছাচ্ছি… কালের কণ্ঠ’র প্রথম পাতায় একটি রিপোর্টে মেয়র প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ অন্যান্য তথ্য প্রকাশিত হয়েছে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে ৩৬ মেয়র প্রার্থী হত্যা মামলার আসামি, ১৮ জনের ঋণ কোটি টাকার ওপরে, ২২৪ জন বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোননি।
মেয়ে ২২৪ জনের জায়গায় লাল কালির দাগ দিয়ে লিখেছে—শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। মেয়র প্রার্থীদের বেলায় কি কথাটি প্রযোজ্য নয়? ফেসবুক, ইন্টারনেট, ই-মেইল, ভাইবারের আধুনিক এই যুগে একজন জনপ্রতিনিধির শিক্ষাগত যোগ্যতা কী হওয়া উচিত? মেয়ে পত্রিকা আমার হাতে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেছে।
একবার ভাবলাম, ওকে ডেকে বোঝাই। অতীতকালের জননেতাদের গল্প বলি। অতীতকালে দেশে এমন অনেক নেতা ছিলেন যাঁরা তেমনভাবে লেখাপড়া জানতেন না। অথচ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। মেয়েকে ডাক দিলাম। সে এলো। তাকে বললাম, তুমি কী জানো, অতীতকালে আমাদের এই দেশের উন্নয়নের জন্য, স্বাধীনতার জন্য অসংখ্য মানুষ নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যাঁদের অনেকের শিক্ষাগত যোগ্যতা বলে তেমন কিছুই ছিল না। কাজেই তোমার বোঝা উচিত, শিক্ষাগত যোগ্যতাই প্রকৃত যোগ্যতা নয়।
মেয়ে রীতিমতো তর্ক জুড়ে দিল। প্রশ্ন করল, বাবা যুগ পাল্টেছে, এ কথা স্বীকার করো? উত্তরে বললাম, হ্যাঁ, স্বীকার করি। তুমি যে সময়ের কথা বলছ সেই সময় কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, ভাইবার ছিল? উত্তরে বললাম, না, ছিল না। মেয়ে আবার প্রশ্ন করল, সে সময় মোবাইল ফোন ছিল? উত্তরে বললাম, না, ছিল না।
মেয়ে এবার আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, সেই সময় আর এই সময়ের পার্থক্য কি বুঝতে পারছ? বাবা, ছোট মুখে বড় কথা হয়ে যাচ্ছে, তবু বলি। তুমি যে সময়ের কথা বলছ, সেই সময় নেতাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকলেও চলত। কারণ তখনকার দিনে নেতার মুখের কথাই ছিল আসল। আর এখন শুধু মুখের কথায় চলে না। নেতাকে জানতে হয়। জানতে গেলেই পড়তে হয়। পড়তে গেলেই শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্ন আসে।
মেয়ের কাছে কি হেরে যাচ্ছি? একটু প্রতিবাদের সুরে বললাম, তুমি যাই বলো না কেন, শিক্ষাগত যোগ্যতাই নেতা হওয়ার আসল মাপকাঠি নয়। আসল মাপকাঠি হলো মানুষ হওয়া। মেয়েও প্রতিবাদের ভঙ্গিতে বলল, আমাদের দেশে ইংরেজি শিক্ষার করুণ অবস্থা, এটা কি তুমি স্বীকার করো? উত্তরে বললাম, হ্যাঁ, স্বীকার করি।
মেয়ে আবার প্রশ্ন করল, কেন এই করুণ অবস্থা জানো? উত্তরে বললাম, দক্ষ শিক্ষকের অভাব। আমার কথা টেনে নিয়ে মেয়ে বলল, হ্যাঁ, এবার তুমি লাইনে এসেছ; দক্ষ শিক্ষক-শিক্ষিকা নেই বলে দেশের ছেলেমেয়েরা ভালো করে ইংরেজি শিখতে পারছে না। বাবা, তুমি কি মনে করো না একেকজন জননেতাও একেকজন শিক্ষক।
ধরো, কম্পিউটার বিষয়ক এক প্রদর্শনীর উদ্বোধন করবেন একজন মেয়র। অথচ এ ব্যাপারে তাঁর কোনো ধারণা নেই। তিনি যদি টাইপরাইটারকে কম্পিউটার ভেবে বক্তৃতা দেন, তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? বলেই আরো কিছু পত্রিকা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল মেয়ে।
একটি পত্রিকায় দেখলাম, আখাউড়া পৌরসভার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। হেডিং ছাপা হয়েছে—বেশির ভাগ কাউন্সিলর প্রার্থী মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোননি।
আরেকটি পত্রিকার মানিকগঞ্জের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়েছে, শিক্ষায় একদল এগিয়ে আর সম্পদে অন্য দল…। আরেকটি পত্রিকায় সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে কে কতটি হত্যা মামলায় জড়িত তার বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এ রকম অনেক খবর পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, যা পড়ে সম্ভাব্য জনপ্রতিনিধিদের ব্যাপারে কোনোভাবেই স্বস্তি আসার কথা নয়। কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ তো স্বস্তি চাই। যিনি ভবিষ্যতের নেতা হবেন, তাঁর ব্যাপারে অহংকার করতে চাই। অহংকারটা এমন-আমাদের নেতা সত্, অমায়িক এবং অবশ্যই বিদ্বান হবেন। তাঁকে দেখলে অজান্তে শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসবে। আমরা যে সময় ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি সে সময়ে নেতার সংজ্ঞা বোধ করি পাল্টে ফেলা জরুরি। অঢেল টাকা আছে। তার সঙ্গে মাসলম্যান আছে… এটা বোধ করি এখন আর নেতা হওয়ার যোগ্যতা হতে পারে না। চাকরির ক্ষেত্রে যেমন যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়, তেমনি নেতা হওয়ার জন্যও যোগ্যতা নির্ধারণ করা জরুরি। বিশেষ করে জনপ্রতিনিধির ক্ষেত্রে যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া এখন সময়ের দাবি।
৩০ ডিসেম্বর (আজ) সারা দেশে যে মেয়র নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে অনেক উচ্চশিক্ষিত প্রার্থীও রয়েছেন। কাজেই ঢালাওভাবে মেয়র প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করা ঠিক হবে না। তবে শঙ্কা হচ্ছে শিক্ষিতরা যদি জিতে না যায়? একটি গল্পের মাধ্যমে লেখাটি শেষ করতে চাই।
এক সভায় মসজিদ নির্মাণের জন্য উপস্থিত অতিথিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সভা পরিচালনা করছেন স্থানীয় এক নেতা। যাঁরা অর্থ দান করছেন তিনি তাঁদের নাম বলেই চলেছেন… এই মাত্র এলাকার একজন ব্যবসায়ী মসজিদের জন্য ১০ হাজার টাকা দান করলেন। আসেন, আমরা তাঁর জন্য দোয়া করি। তাঁর ব্যবসায় যেন অনেক উন্নতি হয়… এই মাত্র এলাকার একজন ডাক্তার ১০ হাজার টাকা দান করলেন। আসেন, আমরা তাঁর জন্য দোয়া করি… এবার স্থানীয় ব্যাংকের ম্যানেজার আসাদুল ইসলাম মসজিদের জন্য ২০ হাজার টাকা দান করলেন। আসেন, আমরা সবাই মিল্যা তাঁর জন্য দোয়া করি… তিনি যেন ম্যানেজার থেকে ক্যাশিয়ার হয়ে যান…।
বলা বাহুল্য, ঘোষক নেতার ধারণা ব্যাংকের ম্যানেজারের চেয়ে ক্যাশিয়ারের দাম বেশি। কারণ ক্যাশিয়ারের কাছে অনেক টাকা থাকে। এভাবেই টাকাওয়ালারা নেতা হচ্ছেন। ফলে উপেক্ষিত হচ্ছে শিক্ষার বিষয়টি। এভাবে আর কত দিন?
রেজানুর রহমান : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো, দৈনিক ইত্তেফাকের সাবেক শিক্ষা সাংবাদিক।