আমাদের শিক্ষা কি সমাজে দুর্নীতি বন্ধের কথা বলে? - দৈনিকশিক্ষা

আমাদের শিক্ষা কি সমাজে দুর্নীতি বন্ধের কথা বলে?

মাছুম বিল্লাহ |

আমরা সর্বদাই সংবাদ শুনে থাকি, নিজেরা মুখোমুখি হই, পত্র-পত্রিকায় দেখি যে, প্রতিটি অফিসেই, প্রতিটি জায়গাতেই সামান্য কিছু পেতে হলেই  ঘুষ আর  অবৈধ অর্থের লেনদেন করতে হয়। মানুষের পেটে যখন ক্ষুধা থাকে তখন নীতি নৈতিকতার স্থানটি নড়বড়ে থাকে। তাই বেঁচে থাকার স্বার্থে স্বল্প আয়ের অনেক লোক অবৈধ অর্থের সন্ধান পেলে, সুযোগ এলে সেটি আর হাতছাড়া করেনা। করতে করতে একসময় সেটি তাদের কাছে সাধারন ব্যাপার হয়ে দাড়ায়।

সমাজেও সেটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়।যেমন ট্রাফিক পুলিশের ঘুষ আদায় করা।একজন ট্রাফিক পুলিশকে নিশ্চয়ই একটি মোটা অংকের অর্থ কাউকে দিতে হয়েছিল তার ঐ পোশাকটি পড়ার জন্য। এরপর সে লাইলেন্স পেয়ে গেল যে, প্রতিটি গাড়ী, রিক্সা ও ভ্যান থেকে একটি নির্দিষ্ট হারে বখরা আদায় করতে পারবে সে।সকাল বেলা যখন অফিসে আসি কিংবা অন্য কোথাও যাই তখন দেখি যেসব রোডে মানুষচালিত যানবাহন নিষিদ্ধ ঐসব রোডে ঢোকার জন্য কিছু যানবাহন নীরবে ট্রাফিক পুলিশের হাতে কিছু একটা গুঁজে দিচেছ। চমৎকার রকমের রফাদফা! মিউচুয়্যাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। শুনেছি গুরুত্বপূন ঐসব জায়গায় পোষ্টিং নিতেও নাকি ঐসব পুলিশকে মোটা অংকের একটি অর্থ উপহার দিতে হয় তাদের উপরোস্থদের।

পুলিশ বাচারা করবেই বা কি? তার বাসা ভাড়াটা হয়তো কোনরকমে বেতনের পয়সায় চলে কিন্তু বাকি সব? কাজেই তাকে কিছুটা অসততার আশ্রয় নিতেই হয়। আর এই নিতে নিতে এখন এটি নিয়মে পরিণত হয়েছে ।

সবাই জানে ট্রাফিক পুলিশকে কিছু দিলেই মোটামুটি খালাস। কিন্তু সমাজের বড় বড় কর্মকর্তারা যে ঘুষ খান তার পেছনে কি যুক্তি আছে? তাদের গাড়ী আছে, দুএকটি বাড়ী আছে , ব্যাংক ব্যালান্স আছে তারপরেও তারা লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা ঘুষ খান। কেন?

একজন মানুষ পাঁচজন মানুষের খাবার খেতে পারেনা, একজন মানুষের শোবার জায়গা যতটুকু লাগে সবারই তাই। তাহলে তারা কোটি কোটি টাকা কেন অসদুপায়ে উপার্জন করছেন? পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ বা সন্তান সন্ততির জন্য? যেসব সন্তানরা বাবা-মায়ের রেখে যাওয়া রেডিমেড সম্পত্তি পায় তাদের ঐসব সম্পদের প্রতি কোন মায়া থাকেনা।

যদি তারা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয় তা হলে তো ভাল কথা আর তা না হলে তারা ঐ সম্পদের জোরে তারা বিপথে যায় এ বিষয়টি  তো আমরা সমাজে প্রায় সর্বত্রই বা সর্বদাইপ্রত্যক্ষ করছি। আর অসৎ পয়সা দিয়ে সন্তানদের লেখাপড়া করানো বা আর যাই করানো হোক না কেন  তাতো সৎ থাকছেন, সেখান থেকে ভাল কিছু তো আশা করা যায়না।

একজন সন্তানের জন্য কতটুকা জমি আর কয়টি বাড়ী দরকার? তার ভরনপোষন ও চাহিদা কতটুকু? কিন্তু যারা ঘুষ খান তারাতো দেখা যায় একসন্তানের জন্য চারটি পাঁচটি বাড়ী কিনেও ক্ষান্ত হননা, কিনেতই থাকেন। একইভাবে কিছু কিছু শিক্ষক আছেন প্রাইভেট পড়াতে পড়াতে পাগলপ্রায়।জমির পর জমি ,ফ্ল্যাটের পর ফ্লাট কিনছেন তো কিনছেন, কার জন্য কিসের জন্য তার কোন হিসেব নেই, পরিকল্পনা নেই।  কেন এই অপরিসীম চাহিদা যা সমাজকে ইমব্যালান্সড করছে? সমাজে অস্থিরতা বাড়াচেছ? আমরা যাই করি সবকিছুর ঠিকানা তো একটিই সেটি হচেছ ’লিডিং টু গ্রেভ’।

একজন মানুষ, একজন কর্মকর্তা অবৈধ অর্থ কেন নিবেননা, বা অবৈধ অর্থ কেন উপার্জন করবেন না সে বিষয়ে তার কোন শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ আছে কি? নেই। তার সারাজীবনের শিক্ষায় তিনি হয়তো এ বিষয়টি ভালভাবে পাননি। সবকিছুর মূলেই তো রয়েছে শিক্ষা? অবৈধ অর্থ না নেয়ার  শিক্ষা সে কোথায় পাবে? আমরা মসজিদে যাই কিন্তু বাস্তবধর্মী কথাবার্ত খুব কমই হয় সেখানে। সেখানে পুরনো ইতিহাসের কথাই বেশি আলোচিত হয়।

বাস্তব জগতের কথাবার্তা খুব কমই হয়। আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ ধরনের কোন লেখাপড়া বা আলোচনা কি হয়? হয় না। ধর্মীয় বা নৈতিক শিক্ষা নামে একটি বিষয় চালু আছে  তা কতটা কার্যকরী? সমাজ কিভাবে শিখবে যে, একজন মানুষে চাহিদা সীমিত, সময়কাল সীমিত। মৃতু্যুর পর তার সম্পদ তার  কোন কাজে আসবে না এতসব কষ্ট করা সম্পদ যা সে সমস্ত শান্তির বিনিময়ে অর্জন করেছে। একজন ধনী মানুষ অজস্র সম্পদের মালিক, কিন্তু তিনি চা পান করছেন তাতে দুধ নেই, চিনি নেই। ভাত খাচেছন তো শুধু সবজি দিয়ে, মাংস খেতে পারছেন না, মাছ খেতে পারছেন না, অথচ বাড়ী আছে তার কয়েকটি, দামী গাড়ী আছে কয়েকটি। এইতো তার পাওনা।কিন্তু অজানা এক আকর্ষণ, অজানা এক মোহ তাকে তাড়িয়ে বেড়ায় অজস্র সম্পদের মালিক হতে। এভাবে যারা মালিক হন তারা সমাজকে কিছু দিতে পারেন না, বরং সমাজের অনেককে ঠকিয়ে অনেককে ধোঁকা দিয়ে তাকে অর্জন করতে হয় এই বিপুল সম্পদ।

সেদিন এক প্রাক্তন ছাত্র এলো আমার সাথে দেখা করতে, পুরনো দিনের অনেক কথা হলো। কিছু শিক্ষকদের নাম বললো ছেলেটি তারা এখনও দিনরাত প্রাইভেট পড়িয়ে ফ্লাট আর জমি কিনছে তো কিনছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম ওনাদের ওগুলো ভোগ করবে কে? ছেলেটিও বললো তাইতো স্যার, কে খাবে ওসব সম্পদ ওনাদের মৃত্যুর পর? আমাদের বাবুগঞ্জ স্কুলের প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দিন স্যার আমাদের বলতেন তোমরা যে পোশাকটি পড়েছ হিসেব করে দেখ এর কত অংশ একেবারে  সৎ অর্থ দিয়ে তৈরি, কত শতাংশ অন্য মানুষের বা আত্মীয় স্বজনের বা প্রতিবেশীর হক বঞ্চিত অর্থ দিয়ে তৈরি। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তোমাদের এই হিসবে রাখতে হবে তা না হলে এই শিক্ষিত হওয়ার কোন মূল্য নেই, তুমি মানুষকে ঠকিয়ে কিভাবে নিজের আরাম আয়েশ বাড়ানো যায় সেটিই চিন্তা করবে।

এ ধরনের শিক্ষা, এ ধরনের শিক্ষক এ ধরনের শেণিকক্ষে আলোচনা হতেই হয়, তা না হলে আমরা কি শিখব? সরকারী আমলা হয়ে কিভাবে সাধারন মানুষের ওপর ছড়ি ঘোড়াতে হয়, পুলিশে চাকরি করে কিভাবে মানুষকে ভয় পাইয়ে দিতে হয়, ইনকাম ট্যাক্সের চাকরি করে অজস্র সম্পদের মালিক হওয়া যায়  ইত্যাদি ইত্যাদি।

শিক্ষা মানুষের দায়িত্ববোধকে জাগ্রত করে, তার অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে সজাগ , সবাক, সকর্ম করে তোলে মানুষের মধ্যে ঘুমন্ত মানবতাকে জাগ্রত করে, আর তা না করতে পারলে সে শিক্ষার মূল্য কি? মানব সম্পদ উন্নয়নে  শিক্ষার যেমন বিকল্প নেই, জাতীয় জীবনমানের সার্বিক উন্নয়নে শিক্ষায় বিনিয়োগেরও কোন বিকল্প নেই। একটি বৃক্ষকে সত্যই সবল ও সুস্থ হয়ে বড় বা বৃদ্ধপ্রাপ্ত হলে তার সকল পর্যায়ে পরিচর্যা প্রয়োজন।

শুধু এর গোড়ায় কিংবা আগায় না সর্বত্র দেখভালের প্রয়োজনীয়তা এজন্য জরুরী ও আবশ্যক । এর কোন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত, জরাগ্রস্ত, দৃর্দশাগ্রস্ত হলে অপরাপর  অংশে সংক্রমনের আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠবে এবং একসময় গোটা গাছটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা শিক্ষার্থীদের পাশ করিয়ে সমাজে ছেড়ে দিচেছ তারা নিজ পরিবারকে, সমাজকে, মানুষকে কি দিবে তার কোন শিক্ষা দিচিছনা। তাহলে সমাজের বর্তমান অবস্থা তো হবেই।

বিগত শতাব্দদির গোড়ার দিকে ওপনিবেশিক শাসন আমলে এ দেশেরই একজন সরকারি স্কুল পরিদর্শক তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন মাইলের মাইলের পর মাইল হেঁটে নিজের সাথে আহারাদি পরিপাকের উপায় উপকরণ বয়ে নিয়ে তিনি স্কুল পরিদর্শন করতেন। পরিদর্শতদের পক্ষ থেকে তাকে কোনপ্রকার পরিসেবার সুযোগ তিনি দিতেন না।

এই অবস্থার বিপরীতে এই অতি সম্প্রতিককালে দেখা দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় নিরীক্ষা ও পরিদর্শন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা  খোদ কেন্দ্রে বসে ৬০০ কিলোমিটার দূরের  শিক্ষায়তনের প্রধান শিক্ষককে তার পরিদর্শন সনদ প্রতিবেদন পূরন করতে বলেছেন। যিনি নিজে এতবড় দর্নীতির আশ্রয় নিচেছন তিনি কিভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের  স্বচছতার জবাবদিহিতার মূল্যায়ণ প্রতিবেদন দেবেন?( একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত)।

শিক্ষা ভবেন যান, দেখবেন প্রতিদিন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শত শত শিক্ষক এসে ভীড় করছেন ঐ ভবনে। আর অর্থ ছাড়া কোন কাজ কতটা হচেছ তার হিসেব কে রাখছে? একমাত্র ভুক্তভোগীই জানছেন কত ধানে কত চাল।

ভারতের একাদশতম রাষ্ট্রপতি বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ড. এ পি জে আবদুল কালাম বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। স্থানীয় একটি  টেলিভিশন চ্যানেলের তরফ থেকে তিরাশি বছর বয়সী এই চিরতরুন তত্তবিদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল গোটা উপমহাদেশের টেকসই উন্নয়ন অভীপ্সায়  তার বার্তা কি? তিনি পরামর্শে বলেছেন, বাড়িতে পিতামাতা ও প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষককে দায়িত্বশীল হতে হবে, তাদেরকে দায়িত্বশীল পেতে হবে। তা হলে মানবসম্পদ তথা সার্বিক অর্থনৈতিক  উন্নয়নে নবযুগের যে শিক্ষার  দরকার সেই শিক্ষার পথে আমরা আছি কিনা বার বার তার মূল্যায়ন ও পর্যালোচনা করতে হবে। যথার্থই বলেছেন তিনি।

শিক্ষার্থীরা বর্তমানে সমাজে নিজেরা কি প্রত্যক্ষ করছে? কি ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচেছ তারা প্রতিটি মুহুর্ত? হরতাল বোমাবাজি, স্কুলে যেতে না দেয়া, গেলে বোমার আতঙ্ক।গুলির আঘাতে শিশুর প্রাণ সংহার। তাই আধুনিক যুগের এক কবি তার কবিতায় যথার্থই বলেছেন গুলির আঘাতে মৃত্যু হওয়া শিশু বলছে’ তোমরা এখানে যা কিছু করছ আমি কিন্তু ঈশ্বরের কাছে গিয়ে সব বলে দেব।”মানবজাতি মানবতা হারিয়ে যে অন্ধকারে হাতরাচেছ, শিশু তার সব অধিকার হারিয়ে গুলি আঘাতে প্রাণ দিচেছ এবং এর রকম হাজারো অপকর্ম মানুষ করছে দেখার যেন কেই নেই ।

তাই শিশুটি শুধু স্রষ্টার কাছেই অভিযোগ করবে বলে আমাদেরকে সাবধান করে দিচ্ছে কিন্তু আমরা কি এ থেকে কিছু শিখব?

লেখক: শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।

শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0042109489440918