পাঠ্যপুস্তকে ভুলের বিষয়টি আমাকে খুবই কষ্ট দিচ্ছে। আমি শিক্ষা সচিব হওয়ার আগেও এমন ভুল দেখেছি। কমপক্ষে ২০/২৫ বছর যাবত খবরের কাগজে দেখেছি, মানুষের কাছে শুনেছি পাঠ্যবইয়ে ভুলের খবর।
এসবের পেছনের কারণ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শিক্ষা সংস্কারক ও সাবেক শিক্ষাসচিব মো. নজরুল ইসলাম খান (এনআই খান) দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, পাঠ্যপুস্তকে ভুল, এটি নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। দায়িত্ব নিয়েই এ ব্যাপারে আমি কিছু গাইডলাইন দেই। কিন্তু আমার উপস্থিতিতেও ভিন্নভাবে প্রভাব খাটানোর চেষ্টা হয়। তারা যদি আমার দেয়া গাইডলাইন অনুসরণ করত, তাহলে আজ হয়তো এমন ভুল হতো না। ভুল হতেই পারে। কিন্তু এত ব্যাপকভাবে ভুল মেনে নেয়া যায় না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই এবার ভুল হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রযুক্তিবিদ স্টিভ জবস বলেছেন, যথাযথ নিয়োগই হচ্ছে প্রতিষ্ঠানের হার্ট (হৃদয়)। এনসিটিবিতে ডেপুটেশনে নিয়োগ দেয়া হয়। কিন্তু সিলেকশনের ব্যাপার থাকে। কারা আসছে নিয়োগ পেয়ে? কতদিন থেকে কাজ করছেন? প্রশিক্ষিত কি না?
মাত্র কয়েকমাস ধরে এনসিটিবির চেয়ারম্যানের পদে আছেন নারায়ণ সাহা। তিনি একটি সরকারি কলেজ থেকে এসেছেন। তার ভালো অভিজ্ঞতা আছে কি না আমার জানা নেই। প্রশিক্ষিত হওয়ার তো কোনো সুযোগই নেই।
আমরা জানি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পর্যায়ের শিক্ষকদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ থাকে না। শিক্ষা হচ্ছে সাধারণ প্রস্তুতি। প্রশিক্ষণ হচ্ছে বিশেষ প্রস্তুতি। আর অভিজ্ঞরা হচ্ছেন দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেয়ার কারিগর। এর আগের চেয়ারম্যান নারায়ণ পাল মাত্র এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। তার আগের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমানও এক বছর দায়িত্ব পালন করেন। আবুল কাশেমও এক বছর থাকলেন। তার মানে আসা যাওয়াই সার। এমন একটি জায়গায় দায়িত্ব যদি এভাবে দেয়া হয়, তাহলে অভিজ্ঞতা দাঁড়ায় না। কারণ একটি জায়গার কাজ এবং কাজের পরিবেশ বুঝে উঠতেই তো সময় লাগে।
এন আই খান বলেন, আমরা দেখেছি, প্রত্যেকেই তার পছন্দের ব্যক্তিকে রাখতে চায়। বাংলাদেশের জন্য একটি ধারা তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশে দুর্বল লোককে উপরে রাখা হয়। আর নিচের দিকে রাখা হয় শক্তিমানদের। এই শক্তিমানরাই লেজ নাড়িয়ে প্রভাবশালীর পক্ষে লেজুড়বৃত্তি করেন। একটি প্রতিষ্ঠানে নিচের দিকের লোক মাতব্বরি করলে যা হবার তাই হয়।
পাঠ্যবইয়ের বিষয়টি একটি সিস্টেমেটিক পন্থায় নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু সিস্টেমে যদি অযাচিত হস্তক্ষেপ হয়, তখন অনেক কিছুই ঘটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বই কারা লিখবেন তার একটি সিস্টেম আছে। আমি আগে দেখেছি, পছন্দের ব্যক্তিকে দিয়ে বইয়ের কাজ করানো হচ্ছে। বিশেষ খাতিরে এটি হয়। নানা সুবিধার বিনিময় হয় এমন খাতিরে। ক্ষমতাবান এই লোকরা টেলিভিশনে গিয়ে টকশো বা বিবৃতি দিলে আরও সুবিধা হয়। অন্য সুবিধা আছে।
তিনি বলেন, আমি সচিব হিসেবে যোগ দিয়েই বলেছিলাম, বিশেষ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দিয়ে এ কাজ করানো যাবে না। কারণ এটি স্কুলের শিক্ষকরা আরও ভালো বোঝেন। কবিতায় ভুল হয়েছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, স্কুল শিক্ষক থাকলে কবিতায় এই ভুল হতো না। একজন স্কুল শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দুই বেলা পড়ান। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের অনেক স্কলার শিক্ষক আছেন, যারা ক থেকে বিসর্গ পর্যন্ত টানা বলতে পারবেন না। বলতে পারবেন না বলেই তিনি মেধাহীন নন। মানে তার মাঝে চর্চা নেই। অর্থাৎ তার দরকার হয় না বলেই চর্চা হয় না। এ কারণেই আমি নিশ্চিত করে বলেছিলাম, এনসিসিসিতে (ন্যাশনাল কারিকুলাম কো-অর্ডিনেশন কমিটি) একজন স্কুল শিক্ষক অবশ্যই থাকতে হবে। এরপর বলেছিলাম, এক এলাকা থেকে নেয়া যাবে না। ভিন্ন ভিন্ন এলাকা থেকে কমিটির সদস্য নিতে হবে। ভাষাগত পার্থক্য থাকে এলাকাভিত্তিক। কিন্তু বইয়ের সার্বজনীনতা আনতে গেলে ক্রস চেক করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন এলাকার মানুষের অংশগ্রহণ থাকা জরুরি।
আমি যতটুকু জানি, এবার এনসিসিসিতে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নেয়া হয়েছিল,যাদের অনেকেই অবসরে গেছেন। কর্মকর্তা পর্যায়েরও লোক ছিলো। অবসরে যাওয়া শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা অবশ্যই অনেক বেশি। কিন্তু সব কাজেই তারা সমান ভালো করতে পারবেন এই ধারণা ঠিক নয়। আমি যে স্ট্যান্ডার্ড সিস্টেম লিখে দিয়ে এসেছিলাম, সেটা এবার অনুসরণ করা হয়নি। কোনো প্রকার বাছবিচার না করে পছন্দের লোকদের দিয়ে কাজ করালো।
এন আই খান আরও বলেন, লেখক টিম গঠন করার ব্যাপারেও প্রোগ্রাম করা আছে। এখন হচ্ছে কো-ক্রিয়েশনের যুগ। একা তো সব করা যায় না। বাংলা বইয়ে ভুল এসেছে। তাহলে কেন বাংলা একাডেমি থেকে এক্সপার্ট নিল না? বাংলা একাডেমির কাছে বইটির খসড়াও পাঠিয়ে দিতে পারত। এর বিনিময়ে কিছু টাকাও দিতে পারে সংশ্লিষ্ট দফতর। সব টাকা এনসিটিবি কুক্ষিগত করে রাখবে কেন? আমি দেখেছি, সেখানে বহু অর্থ জমা আছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা নামের একটি ইনস্টিটিউট রয়েছে। তাদের কাজটা কি? তারা খায় আর ঘুমায়। কুমিরের মতো জীবনযাপন এখানকার জনবলের। চাইলে এদেরও কাজে লাগানো যেতে পারে। জাতীয় ইস্যু। এখানে নেটওয়ার্ক বাড়ানো যেতেই পারে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হয়। লেখক হিসেবে তাদের অন্তর্ভুক্তি করা যেতে পারে। নির্বাচিত লেখকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। প্রশিক্ষণ ছাড়া কিছুই ভালো হতে পারে না। একাডেমিক বই লেখক কেন তৈরি করা যাবে না? বাংলা একাডেমিকে এ দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে। অর্থ ব্যয় করতে হবে।