আয়কর ব্যবস্থাপনা ও বেসরকারি শিক্ষক সমাজ - দৈনিকশিক্ষা

আয়কর ব্যবস্থাপনা ও বেসরকারি শিক্ষক সমাজ

বিশ্বাজিৎ রায় |

স্বাধীনতার পর বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য যা অর্জিত হয়েছে তার ইতিহাস দীর্ঘদিনের। যারা এ ইতিহাসের সাথে নিজেদেরকে সম্পৃক্ত করেছেন তারা অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবেন বা আছেন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পির দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চলছিল খুড়িয়ে খুড়িয়ে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার খুব অভাব ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে দাবী আদায়ের লক্ষে সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমে আসে শিক্ষক সমাজ। বিরতিহীনভাবে ৬০ দিন ধর্মঘট চলার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫টি শর্তের উপর ভিত্তি করে প্রত্যাহার হলো আন্দোলন। শিক্ষক সমাজ পেল ফ্লাটরেটে ৭৫ টাকা মহার্ঘ ভাতা। ১৯৭৯ খ্রিস্টাব্দের ২৫ নভেম্বর শিক্ষক নেতৃবৃন্দ দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেন। টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া পর্যন্ত সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। পরবতীর্তে অর্জিত হয় জাতীয় বেতন স্কেললাভের চুড়ান্ত বিজয়।

১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষকরা জাতীয় বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ সরকারি অনুদান পেলেন। শুরু হল চাকরি বিধি মালা প্রনয়নের আন্দোলন। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন স্কেলের প্রারম্ভিক বেতনের ৫০ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ ও ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের জুন থেকে ৭০ শতাংশ ঘোষণা করেন। এছাড়া তৎকালীন সরকার চিকিৎসা ভাতা ৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা, একটি ইনক্রিমেন্ট ও ১০০ টাকা ফ্লাট রেটে আবাসিক ভাতা মঞ্জুর করেন। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া ঘোষণা করলেন মূলবেতনের সরকারি ৭০ শতাংশ থেকে ৮০ শতাংশ এ উন্নত করা হবে এবং টাইম স্কেল দেওয়া হবে এবং ১০০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় উন্নত হবে। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ জানয়ারি বেসরকারি শিক্ষক কর্মচারীর জন্য অবসর সুবিধা বোর্ড গঠন হয়।

২০০১ খ্রিস্টাব্দের ১ অক্টোবর নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি আবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হন। প্রবল আন্দোলনের ফলে এক পর্যায়ে সরকার ১০০ শতাংশ দিতে সম্মত হয়। ২০০৬ ক্রিস্টাব্দের ১ জুলাই থেকে ১০০ শতাংশ বেতন ভাতাদির সরকারি অংশ পেল। সেই থেকে ১০০ শতাংশ পেয়ে আসছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর জাতীয় বেতন গেজেটে অন্তর্ভুক্ত হলো বেসরকারি শিক্ষক সমাজ  কিন্তু ব্যত্যয় ঘটল অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ক্ষেত্রে। ঈদ বেনাস প্রাপ্তীর ক্ষেত্রে দেখা গেল নাটকীয়তা। কখনও নুতন স্কেলে, আবার কখনও পুরাতন স্কেলে বোনাস প্রস্তত করা হলো। সব চেয়ে বিস¥যকর ব্যাপার হলো সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারী বোনাস সহ অন্যান্য ভাতাদী নুতন স্কেলে  পাচ্ছে, বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হলো এভাবে। যা হোক নুতন স্কেলেই শেষে  ঈদ বোনাস পেল বেসরকারি শিক্ষকরা।

বেসরকারি শিক্ষক সমাজ প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত নববর্ষ ভাতা হতে বঞ্চিত হলো। শিক্ষক পিতা হয়েও সমাজের সবচেয়ে মর্যাদাকর ব্যক্তির মর্যাদা সমুন্নত থাকলো কিনা প্রশ্ন থেকে যায়। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশ হলো জাতীয় বেতন গেজেট। তুলে নেওয়া হলে পুরাতন ইনক্রিমেন্ট প্রথা। চালু হল নতুন ইনক্রিমেন্ট প্রথা। প্রজাতন্ত্রের সকল কর্মকর্তা কর্মচারী জুলাই ২০১৬ হতে নতুন ভাবে ইনক্রিমেন্ট প্রথায় অন্তর্ভুক্ত হলো বাদ পড়ল সমাজের সেই মর্যাদা কর ব্যক্তি। আজও তারা ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি পাবে কিনা তাও স্পষ্ট নয়।

ইতোমধ্যে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বিটিএ) এর সভাপতি মুহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিকি সাহেবের নেতৃত্বে একটি আন্দোলনর রূপ রেখা ঘোষিত হয়েছে।  কিন্তু ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে কোন বিবৃতি আসে নাই। ব্যথিত, উদ্বিগ্ন ও উৎকন্ঠিত শিক্ষক সমাজ। পুরানো ধাচের উৎসব ভাতা এখনও চালু আছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজে। যেখানে  শিক্ষকরা পাচ্ছে ২৫ শতাংশ ও কর্মচারী পাচ্ছে ৫০ শতাংশ। যেটি পরিবর্তন হওয়া অত্যন্ত জরুরী। এই ধরনের কোন খোড়া উৎসব ভাতায় কোন উৎসব সঠিক ভাবে পালন করা যায় কিনা আমাদের সন্দেহ আছে। বদলি পদন্নোতির কথা শুধু কাগজে কলমে লেখা থাকলেও এ পর্যন্ত তার কোন নীতিমালা পরিলক্ষিত হয় নাই।

বেসরকারি শিক্ষক সমাজ চাকরি জীবনে ৮ বছর পূর্তিতে একটি টাইমস্কেল পেয়ে থাকবেন। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর জাতীয় বেতন গেজেট প্রকাশের পর টাইম স্কেল প্রাপ্তি বন্ধ। চালু হল অটোমেশন বা উচ্চতর স্কেল। জাতীয় বেতন গেজেট ২০১৫ তে বলা হল যারা নিরবি্িচ্ছন্ন ভাবে ১০ বছর একই বেতন স্কেলের চাকরি করবেন তারা ১১তম বছরে যেয়ে পরবর্তী বেতন গ্রেডে উন্নিত হবেন। অটোমেশন বা উচ্চতর স্কেল পাবে কিনা তা এখনও শিক্ষক সমাজের কাছে স্পষ্ট নয়। অথচ বেসরকারি হাজার হাজার শিক্ষক অটোমেশনের জন্য প্রহর গুনছে।

এরই মধ্যে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে আয় কর।  এ রকম গ্রেডে বেতন শিক্ষক সমাজ আগেও পেত কিন্তু তখন করের আওতায় আসে নাই। সরকারকে আয় কত দিয়ে দেশকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যেতে চায় তারা। যেমনটি বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েও সমাজে জ্ঞানের আলো ফুটাতে নিরলস পরিশ্রম চালিয়ে যাচ্ছে বেসরকারি শিক্ষক সমাজ। শিক্ষা দীক্ষায় দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় তারা। শিক্ষকরা সব সময়ই পরোক্ষ করের অন্তর্ভুক্ত ছিলো বা আছেন। কেরোসিন ডিম চাল তেল লবন ও তাদের বেতন গ্রহন করতে কর দিতে হবে। এখন তাদের প্রত্যক্ষ করের আওতায় আনা হলো। কর যোগ্য আয় থাকুক আর না থাকুক তাকে  অবশ্যই  ই টি আই এন খুলতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এর আয়কর আইনের বেতন- ভাতা ( পে- রোল) সংশোধন  করে  এমপিওভুক্তির  আওতায় ১৬ হাজার টাকা বা তদূর্ধ্ব বেতন ভাতা প্রকৃতির কোন অর্থ প্রাপ্ত হলে তাদের ক্ষেত্রে ই- টিআইএন গ্রহন বাধ্যতামুলক করা হয়েছে। বছরে আড়াই লাখ টাকা আয় করলে তাকে বাধ্যতামূলক আয়কর দিতে হবে আর তার কম আয় হলে চাকরিজিবীর ক্ষেত্রে ই-টিআইএন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সমাজের মৌলিক কর দাতার পরিমাণ সনাক্ত করা দুরূহ হবে। সমাজে আনেক বিওবান ব্যক্তি আছে তারা কিন্তু অগোচরে করের আওতার বাহিরে। অনেক উচ্চবিত্ত মধ্যবিত্তের আড়ালে থেকে যাচ্ছে।  দেশের অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশ হচ্ছে। ৭ শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি।

উচ্চ বিত্তের আড়ালে যদি নিম্নবিত্ত থেকে যায় তাহলে সামজে শ্রেণি বৈসম্য তৈরি হবে। এমন অনেক শিক্ষক আছে যাদের শুধু মাত্র সরকারি অনুদানের উপর নির্ভর করে সংসার চালাতে হয়। সমাজে অনেকে আছেন তারা এধরণের শিক্ষকদের টাকা ধার দিতে চায় না। তারা জানে যে তারা সঠিক সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পারবে না। যদি টাকা ধার দেয় তাও সেটা কোন কিছু বন্ধক রাখার মাধ্যমে। এই হলো সমাজের সব চেয়ে মর্যাদাকর ব্যক্তির অবস্থান।  অনেকে আবার আমার লেখা পড়ে বলবে যে এমন টিচার সমাজে এখনও আছে নাকি। তাদের বলব যে খোজ নিয়ে দেখুন। বর্তমানে ৭৩ হাজার শিক্ষক কর্মচারি অবসর ভাতা ও কল্যাণ ট্রাস্টের টাকা পাচ্ছে না  চাকরি জীবনের শেষে তাদের সে দুর্দশা দেখার লোক নাই।

অনেকে আবার টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় মারাও যাচ্ছে। লিখতে গেলে শিক্ষকদের দৈন্য দশা লিখে শেষ করা যাবে না। তারপর চাপলো করের বোঝা। যারা করের বোঝা চাপালেন তারা কি দেখেছেন তাদের অর্থনৈতিক অবস্থা। হয়তো বলবেন অনুদান সহায়তা দ্বিগুন বেড়েছে। যেমন অনুদান সহায়তা দ্বিগুন বেড়েছে, তেমনি জিনিসের দাম দ্বিগুন বেড়েছে। একটি মাসে একজন শিক্ষক ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা পাচ্ছে। তাতে কি হচ্ছে? হচ্ছে না। সংসারে যদি ৪ জন সদস্য থাকে, তাহলে তাদের জন্য এই ৫০০ টাকা পর্যাপ্ত নয়।

বাংলাদেশ বিশ্বে একটি ওন্ডার কান্ট্রি। বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ। ২০২১ বাস্তবায়নে দেশ ক্রমাগত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৪১ খ্রিস্টাব্দেরদেশ কেমন হবে তার রূপরেখা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করছেন। দেশের মাথাপিছু আয় ১ হাজার ৪৬৬ মার্কিন ডলার। দেশে পদ্মা সেতুর মত অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সেটি বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে পদ্মা সেতু যেটি বর্তমানে দৃশ্যমান। প্রাক্তন শিক্ষা সচিব এনআই খান মহোদয় বেসরকারি শিক্ষক জাতীয়করণের কথা বলে শিক্ষকদের আলোর মুখ দেখিয়ে বিদায় নিলেন। তার বিদায়ের পর বিষয়টি আর এগোয়নি। তিনি শিক্ষক সমাজের তারা হয়ে বেচে থাকবেন বা আছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত আরোজ তিনি বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি দিয়ে সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণ করবেন এ প্রত্যাশা সকল বেসরকারি শিক্ষকের।

লেখক: বিশ্বজিৎ রায়, শিক্ষক, মৃজাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, তালা, সাতক্ষীরা।

[মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নন।]

জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00547194480896