ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার চালচিত্র - দৈনিকশিক্ষা

ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার চালচিত্র

ড. নিয়াজ আহম্মেদ |

ধনিক শ্রেণির মধ্যে সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করার প্রবণতা অতীতে বেশি দেখা গেলেও বর্তমানে মধ্যবিত্তদের মধ্যেও ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনার আগ্রহ তৈরি হয়েছে। উচ্চশিক্ষায়, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এখন মোটা দাগে লেখাপড়ার মাধ্যম ইংরেজি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা মাধ্যমে লেখাপড়া করেও উচ্চশিক্ষায় তাদের সমস্যা হয় না এবং সাফল্য অনেক ভালো। দেশের বড় বড় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের লেখাপড়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।

শুদ্ধ করে ইংরেজি বলতে ও লিখতে পারা বিশেষ করে লেখার পারদর্শিতা সব সময়, সব দেশে গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে যাদের মাধ্যম প্রাথমিক পর্যায় থেকে ইংরেজি নয় এবং এমনিতে ইংরেজিতে দক্ষতা কম, তাদের হঠাৎ ইংরেজি জটিল আকার ধারণ করে। ক্রমান্বয়ে নিজেকে তৈরি করা অনেকের পক্ষে সম্ভব হলেও কারো কারো পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ফলে ইংরেজিতে অতিমাত্রায় কাঁচা ভাব তৈরি হয় এবং তা চলতে থাকে। ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার ক্ষেত্রে দুটি ধারা। এক. কারিকুলাম পুরোটা ইংরেজি এবং বাইরের। দুই. জাতীয় কারিকুলাম অথচ মাধ্যম ইংরেজি। এই দুই ধারার মধ্যে কারিকুলামের ভিন্নতার জন্য ব্যবধান অনেক। কারিকুলামকে যখন আমরা বেশি গুরুত্ব দিই, তখন মানের বিষয় চলে আসে। অপরপক্ষে মান উভয়ের ক্ষেত্রে সমান কিংবা কমবেশি হলেও একমাত্র বাইরের কারিকুলামের কারণে তার দরজা বিশেষ করে বিদেশে বেশি খোলা। ঠিক একই কারণে ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন ধরনের ইংরেজি টেস্ট যেমন টোফেল ও জিআরইয়ের মতো পরীক্ষার ক্ষেত্রে ছাড় পায়। আপনার চিন্তা যদি এমন হয় যে সন্তানকে বাইরের কোনো দেশে পড়াবেন, তখন আপনি বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন। এর অর্থ এই নয় যে অন্যরা আপনাকে কখনো টপকাতে পারবে না। এমন সুযোগের কারণে বর্তমান সময়ে আমাদের মধ্যবিত্তরা তাদের সন্তানদের ইংরেজি মাধ্যমে পড়াতে চাচ্ছে।

ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, সক্ষমতা এবং ভালো-মন্দের বিচারে প্রতিনিয়ত অভিভাবকদের মধ্যে ইংরেজি মাধ্যমে সন্তানদের পড়াশোনা করানোর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। বর্তমানে জেলা শহর পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় রয়েছে। দেশে ও দেশের বাইরের জন্য হয়তো ভালো ইংরেজি শিখছে এবং নিজেকে তৈরি করছে কিন্তু ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভিন্ন বিষয়াবলির সঙ্গে তাদের পরিচয় বেশি হচ্ছে। এখানে পাঠ্য বইয়ে আমার দেশের উদাহরণ থাকছে না। যা কিছু তার বেশির ভাগই দেশের বাইরের। এমনকি ছড়া ও কবিতাগুলোও বাইরের। ফলে নিজের দেশ ও তার সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার ক্ষেত্র সংকুচিত হচ্ছে। অপরপক্ষে পরিবার থেকেও যদি বিদ্যালয়ের মতো নিজেকে জানার ক্ষেত্র তৈরি না হয়, তখন সমস্যা আরো প্রকট হয়। ফলে ভিন্ন এক ধাঁচে ও পরিবেশে মানুষ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এ কথা সত্য যে বিদ্যালয়ের বাইরে পরিবার ও অন্যরা মিলে চেষ্টা করলে নিজস্বতা ধরে রাখা অসম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন মানসিকতা, যা অনেকের মধ্যে রয়েছেও। ইংরেজি মাধ্যমে পড়লেই যে আমার সন্তানের কাছ থেকে সব কিছু হারিয়ে যাবে তা নয়। আমার মোকাবেলা করার কৌশলের ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। এ কথা সত্য যে শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজি কিন্তু আমার সংস্কৃতির মাধ্যম তো ইংরেজি নয়। একজন খুদে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থী যখন কাউকে দেখে হ্যালো বলে, তখন আমরা চিন্তিত হই। শিক্ষা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য খুঁজলে আমরা আমাদের সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারি।

আমরা আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা বেশি চিন্তা করে ইংরেজি মাধ্যমে পড়াচ্ছি। কেউ কেউ এমনও করছি যে কিছুদিন ইংরেজি মাধ্যমে পড়িয়ে আবার বাংলা মাধ্যমে নিয়ে আসছি। কারণ একটিই ইংরেজিতে যেন সন্তানটি দক্ষ ও পাকাপোক্ত হয়। এমন ধারণা খারাপও নয়। কেননা ইংরেজি এখনকার সময়ে শুধু মাধ্যমই নয়, কৌশলও বটে। কিন্তু যারা ইংরেজি মাধ্যমে রাখছি তারা কতগুলো বিষয়কে বিবেচনা করি। দেশে-বিদেশে চাকরি ও আরো উচ্চশিক্ষার সুযোগের বিষয়টি তো রয়েছে। তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে মর্যাদার বিষয়টিও। এখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো ভর্তিযুদ্ধের বিষয় নেই। আপনার সংগতি থাকলে সুযোগের অভাব নেই। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে ছোট বয়সের ছেলে-মেয়েদের ভর্তি করানো হয়, যেমনটি বিদেশে হচ্ছে। পরিবেশ এমন যে আপনি কিছুটা সময় নিশ্চিন্ত থাকতে পারছেন। এমনকি তাদের পাঠদানের কৌশল অন্যান্য মাধ্যমের তুলনায় আলাদা। ফলে একেবারে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা স্কুলকে উপভোগ করে। স্কুলের মালিকদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ রয়েছে, যেমন তাঁরা নিজেদের মতো করে বেতন-ভাতা নির্ধারণ করেন। যেহেতু এখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কম, সেহেতু এমনটি স্বাভাবিক হিসেবে নিতে হয়। তবে মালিকপক্ষের উচিত মান বজায় রাখার জন্য ভালো শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া এবং টিউশন ফি কমানো।

আনুষ্ঠানিক শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হলো পরিপূর্ণ, সঠিক ও শুদ্ধভাবে সব কিছু জানা। এখানে মাধ্যম বাংলা কিংবা ইংরেজি যা-ই হোক না কেন। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য সংকুচিত হয় যখন আমরা দেখি আমাদের পাঠ্য বই অসংখ্য ভুলে ভরা এবং বিকৃতির ছাপ। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে এমন হওয়ায় অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে, যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ওপর। মাধ্যম উন্নত হলে তা যে মাধ্যমই হোক না কেন শিক্ষার্থীদের ভিত শক্ত ও মজবুত হয়। ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের প্রতি আমাদের মনোযোগ আরো বেশি বাড়ানো উচিত। কেননা এখন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরাও এ মাধ্যমে লেখাপড়া করছে। সন্তানদের অভিভাবকরা সব সময় যে শিক্ষিত হবেন এবং সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি যত্নবান হতে পারবেন, তা নয়। ইংরেজি মাধ্যম হওয়ায় কারো কারো পক্ষে কাজটি করা কঠিন হয়।   ভুল-শুদ্ধের হিসাব মেলানো যায় না। পরিপূর্ণ সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কেননা মাধ্যমের সঙ্গে রয়েছে সংস্কৃতি ও বেড়ে ওঠা অর্থাৎ সামাজিকীকরণের গভীর সম্পর্ক। কোনো কিছুর প্রতি অত্যধিক আসক্তি ও মোহের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না।

লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত - dainik shiksha ফল জালিয়াতি: পদে রেখেই সচিবের বিরুদ্ধে তদন্ত শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল - dainik shiksha শিক্ষক-কর্মচারী বদলি নীতিমালার কর্মশালা কাল দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha দুবাইয়ে বন্যায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে - dainik shiksha ৯৬ হাজার ৭৩৬ শিক্ষক নিয়োগ, আবেদন করবেন যেভাবে ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল - dainik shiksha ফিলিস্তিনকে সমর্থনের ‘অভিযোগে’ সেরা ছাত্রীর বক্তৃতা বাতিল মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে - dainik shiksha মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা হতে পারে জানুয়ারিতে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.012166976928711