কলেজগুলোতে নেই পর্যাপ্ত ও যোগ্য শিক্ষক, অবকাঠামো, লাইব্রেরি এবং ল্যাবরেটরি। যেখানে একাদশ বা ডিগ্রির (পাস কোর্স) শিক্ষা কার্যক্রম চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। সেখানে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর অনুমতি দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শিক্ষক ও অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় এসব কলেজে ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে না। যোগ্য শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার মান নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন ।
শিক্ষকদের অভিযোগ, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কয়েকশ বেসরকারি কলেজে অনার্স-মাস্টার্স শ্রেণি চালু করেছে, কিন্তু এর গুণগত মান নিশ্চিত করতে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা যেমন— নিয়ম অনুযায়ী পর্যাপ্ত সংখ্যক শিক্ষক পাঠদানে নিয়োজিত আছেন কি না, নিয়মিত ক্লান হয় কি না, পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ ও ক্লাসের পরিবেশ আছে কি না, নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষকদের পাঠদানে নিযুক্ত করা হয়েছে কি না, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সমস্যাগুলো কোথায় এ বিষয়গুলো একেবারেই ভাবছে না। এছাড়া অনার্স এবং মাস্টার্স কোর্স চালুর ক্ষেত্রে যে নিয়ম আছে তা মানা হচ্ছে না।
বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিম উল্লাহ খন্দকার বলেন, যোগ্য শিক্ষক নেই, ভালো মানের গ্রন্থাগার নেই, তবুও গ্রামে-গঞ্জের বিভিন্ন কলেজে অনার্স পঠন-পাঠনের অনুমতি দিয়েছে। উচ্চশিক্ষার সর্বনাশ হচ্ছে এসব কারণেই। বিভাগে শিক্ষক আছেন তিনজন অথচ অনার্সে ভর্তি করা হয়েছে ২শ ছাত্র-ছাত্রীকে, এমন অনেক কলেজ রয়েছে বলে অভিযোগ করেন রফিকুল আলম নামে এক অভিভাবক। ঐ অভিভাবক আরো জানান, ভর্তির পর ক্লাস হয়নি বা ক্লাসেই আসেনি। কিন্তু প্রথম অথবা দ্বিতীয় শ্রেণির সনদ নিয়ে ঠিকই বের হয়ে গেছে এমন শিক্ষার্থীও কম নয়।
তথ্য অনুযায়ী, ৬৮৫টি অনার্স ও মাস্টার্স কলেজ, ১২৩টি মহিলা কলেজ, ৩৬৪টি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানসহ মোট ২ হাজার ১৯১টি কলেজ, ২১ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী এবং ৬০ হাজারের বেশি শিক্ষক নিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশেই নয়, সংখ্যার বিবেচনায় বিশ্বের অন্যতম বৃহত্ বিশ্ববিদ্যালয়। মোট উচ্চশিক্ষার ৭০% জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এত সংখ্যক শিক্ষার্থীদের দেখভালের দায়িত্ব পালনে সক্ষম কি না তা নিয়ে ইতোমধ্যে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এ কারণে রাজধানীর সাতটি গুরুত্বপূর্ণ কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে দেয়া হয়েছে।
শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৫ সালে দেশে বেসরকারি অনার্স কলেজের সংখ্যা ছিল ২০টি। ২০১০ সালে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮টি। আর ২০১৫ সালে তা দাঁড়ায় ৩৪৩টিতে। সরকারি অনার্স কলেজ সংখ্যা ২০০৫ সালে ছিল ৪১, ২০১০ সালে ৫৮ এবং ২০১৫ সালে ১০২টি। আর বেসরকারি মাস্টার্স কলেজের সংখ্যা ২০০৫ সালে ছিল ২৮, ২০১০ সালে ৩০ এবং ২০১৫ সালে ছিল ৪৩ ট।
অনার্স কলেজের আমিনুল আলম নামে এক শিক্ষক জানিয়েছেন, অনার্স চালুর পর গত ২৪ বছরেও সরকার অথবা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রতিনিধি কোনো কলেজ সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন কি না সন্দেহ।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও কলেজ শিক্ষকদের নেতা আসাদুল হক বলেন, কলেজগুলোতে অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালুর অনুমতি দেয়া হয়েছে, কিন্তু শিক্ষক এমপিওভুক্তি করা হচ্ছে না। এর ফলে ভালো শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষক এমপিওভুক্তির অনুমতি না দিলে কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স চালুর অনুমতি দেয়া হলো কেন, প্রশ্ন এই শিক্ষক নেতার।
মীর্জাপুর ডিগ্রি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু করে হয় মীর্জাপুর বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ। ২০১০ সালে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর পর এখনো ঘুড়ে দাঁড়াতে পারেনি প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষকদের নামমাত্র বেতন দিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে অনার্স ও মাস্টার্সের কার্যক্রম। ফলে মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অভিভাবকরা।
নজরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষক বলেন, উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হলেও অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সের শিক্ষকরা এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ নেই। মহানগরীর কলেজগুলোতে শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশি থাকায় প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আয় থেকে শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেয়া যায়। কিন্তু মফস্বলের কলেজের নিজস্ব কোনো আয় নেই। ফলে শিক্ষকদের বেতন ভাতা দেয়া হয় না। এ কারণে শিক্ষক নেই। থাকলেও ভাল ও যোগ্য শিক্ষক নেই। অথচ কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স রয়েছে। ফলে শিক্ষার মান নিম্নমুখী হচ্ছে।
অন্যদিকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসের অর্ধেকটা শেষ না হতেই পরীক্ষা নেয়া হচ্ছে। সেশনজট কমানোর জন্য সিলেবাস শেষ করার আগেই পরীক্ষা নেয়ায় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ রয়েছে। তারা পরীক্ষা পেছানোর জন্য এরই মধ্যে বিভিন্ন কলেজে মানববন্ধন ও অবরোধ কর্মসূচি পালনও করছে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অনৈতিক সিদ্ধান্ত আমরা মানি না। সেশনজট কমানোর নামে ১ বছরের কোর্স ৬ মাসে সমাপ্তির সিদ্ধান্ত নিয়ে শিক্ষার্থীদের জীবন বিপন্ন করা হচ্ছে এমন অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেকের মতে, শিক্ষার্থীদের সিলেবাস শেষ না করে পরীক্ষা নেওয়া অনৈতিক কাজ। আমাদের কলেজগুলোতে সেই অনৈতিক কাজ চলছে। সীমিতসংখ্যক শিক্ষক দিয়ে কলেজে অনার্স-মাস্টার্স পড়াতে গেলে উচ্চ শিক্ষার মান নেমে যেতে বাধ্য।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, দেশের যে সব কলেজে অবকাঠামো সুবিধা নেই, সেখানে অবকাঠামো সুবিধা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ইতোমধ্যে অবকাঠামো উন্নয়নে ৫০০ কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্প গত একনেকে পাস হয়েছে। অবকাঠামো এবং শিক্ষক না থাকার পরও গ্রামের কলেজগুলোতে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালুর অনুমোদন দেয়া হয় কেন এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর স্থানীয়দের চাপ থাকে। এ কারণে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খুলতে বাধ্য হয়। মন্ত্রী বলেন, দেশের শিক্ষার উন্নয়নে সরকার সব ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এ কারণে শিক্ষায় নানামুখী উন্নয়ন হচ্ছে।
সৌজন্যে: ইত্তেফাক।