উঠতি বয়সী ছেলেদের গ্রুপবাজি - দৈনিকশিক্ষা

উঠতি বয়সী ছেলেদের গ্রুপবাজি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে রাজধানী ও তার আশপাশের এলাকার উঠতি বয়সের কিশোররা। তাদের চলাফেরা, কাজকর্ম সাধারণ মানুষকে ভাবিয়ে তুলছে। অপরাধ-প্রবণ এ কিশোররা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে নিজেদের সংগঠিত করে নানা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়েছে। একশ্রেণির উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিন্ম-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান এসব গ্রুপের সদস্য। রাজধানীর উত্তরা, গুলশান, ধানমণ্ডি ও মিরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় এবং দেশের শহরাঞ্চলে এই গ্যাংগুলো দেখা যায়। তাদের অধিকাংশের বয়স চৌদ্দ থেকে বিশ বছরের মধ্যে।

আইডিয়াল গ্রুপ:

রাজধানীর স্বনামধন্য আইডিয়াল স্কুল নিয়ম-শৃংখলা আর পড়াশোনায় সব স্কুলের চেয়ে এগিয়ে। কিন্তু বর্তমানে স্কুলটির কিছু ছাত্রের অসামাজিক কার্যকলাপ, মাস্তানি এবং মাদকসহ বিভিন্ন অনৈতিক বিষয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া নিয়ে স্কুলটি অনেক বিপাকে রয়েছে। আইডিয়াল স্কুলের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ও দশম শ্রেণীর গুটিকয়েক ছাত্রের সমন্বয়ে গঠিত আইডিয়াল গ্রুপ স্কুলটির আশপাশের এলাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের কাছে পরিচিত। আইডিয়াল গ্রুপের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পেছনে স্কুলটির কয়েকজন সাবেক ছাত্র এবং স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসী ও রাজনৈতিকের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। গ্রুপটির মারমুখী আচরণ ও মাদকসেবনের জালে জড়িয়ে পড়ার কারণে ভয়ংকর হিসেবে ইতিমধ্যে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে গ্রুপটির কিছু সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করলেও এতে হচ্ছে না কোনো ফল। গ্রুপটির অন্যতম সদস্য অর্ক গত কিছুদিন আগেও সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিল বলে জানা যায়, অর্ক ছাড়াও গ্রুপটিতে রয়েছে হাসিব, সোহাগ, আনাছ, রিদম, সৈকত, ছায়েমসহ আরও অনেকে, যারা সবাই এ বছর পরীক্ষার্থী ও দশম শ্রেণীর ছাত্র। আইডিয়াল গ্রুপের প্রত্যেক সদস্যই সদা মারমুখী ভূমিকায় থাকেন। গ্রুপটির সব সদস্যই মাদক সেবনের সঙ্গে জড়িত।

স্থানীয় কিছু মাদক ব্যবসায়ী ও সন্ত্রাসীদের ছত্রছায়ায় এসে এসব অনৈতিক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। স্থানীয় কিছু ছাত্রনেতা গ্রুপটিকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে বলেও জানা যায়। আইডিয়াল গ্রুপ পরিচালনায় রয়েছে আইডিয়াল জোনের মুন্না ওরফে কেবিআর মুন্না। মুন্না ওরফে কেবিআর মুন্না একটি বাইক রাইডিং গ্রুপের সঙ্গে জড়িত থাকায় আইডিয়াল গ্রুপের অন্য সবাই তার ভক্ত। গ্রুপটিকে ইয়াবা সেবন করানো এবং তাদের কাছে ইয়াবা বিক্রি করার কাজ করে মুন্না, তার নামে কথায় কথায় মারধরের অভিযোগও রয়েছে এবং গত বছর তালহা নামে এক ছাত্রকে পেটানোর অভিযোগে একটি জাতীয় পত্রিকায় রিপোর্ট হয়েছিল। অভিভাবকদের সঙ্গে বেয়াদবি, ইভটিজিং, প্রকাশ্যে ধূমপান ও বিভিন্ন অসামাজিক কাজে লিপ্ত হওয়ার বিষয়টি এলাকার সবারই জানা। এ ব্যাপারে মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক বলেন, স্কুলের গ্রুপগুলো দেখার দায়িত্ব আমাদের নয়, এটি সামাজিক ব্যাধি এবং স্কুল ব্যবস্থাপনা কমিটির দেখার বিষয়। তবে কেউ আমাদের কাছে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ করলে আমরা তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেই।

বাফার পোলাপাইন:

মতিঝিলের শাহজাহানপুর এলাকায় অবস্থিত মতিঝিল সরকারি কলোনি উচ্চ বিদ্যালয় যা বাফা নামে পরিচিত। সরকারি কলোনির মধ্যে স্কুলটি হওয়ায় এখানে প্রায় সারাদিন এবং রাতেও থাকে বিভিন্ন মানুষের আনাগোনা। স্কুলপড়ুয়া ছাত্র এবং কলোনির অন্যান্য ছাত্র এ স্কুল প্রাঙ্গণে আড্ডা দেয় আর যারা এ আড্ডার আসর বসায় তাদেরই বলা হয় ‘বাফার পোলাপাইন’। বাফার পোলাপাইনের কার্যকলাপ শুধু স্কুল প্রাঙ্গণের শুধু আড্ডাতেই সীমাবদ্ধ নয়, স্কুলের মাঠে ধূমপান, গাঁজা সেবন এমনকি স্কুলের পেছনে ইয়াবা সেবন করে বলেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। এছাড়াও ছিনতাই, মারধর এবং মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার ঘটনা ঘটছে হরহামেশা। এদের মধ্যে ছিয়াম, শামিম, রাকিব, সম্রাট, অপু, ফয়সাল ওরফে ভোটকা ফয়সাল ও শুভ অন্যতম। এদের মধ্যে ছিয়াম ও শামিম মতিঝিল কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী, এদের দু’জনের বিরুদ্ধে রয়েছে মামলা। গত কয়েক মাস আগে বেইলি রোডে প্রধানমন্ত্রীর পার্সোনাল ডাক্তারের ছেলেকে মারধরের কারণে এদের পুলিশ ধরে নেয়। ছিয়াম স্কুল থেকে সাময়িক বরখাস্ত হয়েছিল। বাফার পোলাপাইন হিসেবে পরিচিত ফয়সাল ওরফে ভোটকা ফয়সাল, শুভসহ আরও অনেকে গত এক মাস আগে কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থী সাফিনকে কুপিয়ে জখম করে। এ ব্যাপারে সাফিনের বাবা দানেশ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি ভয়ে মুখ খোলেননি। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ১০নং ওয়ার্ড কমিশনার মারুফ আহমেদ মনছুর  জানান, আমার এলাকায় যদি কোনো গ্রুপ থাকে আর এ ব্যাপারে এলাকাবাসী কিংবা কোনো শিক্ষক যদি আমাকে জানায় আমি সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেব।

মতিঝিল কলোনি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. শাহিদুর রহমান  বলেন, স্কুলের ছেলেদের এত অল্প বয়সে বিভিন্ন অসামাজিক কাজে জড়িয়ে যাওয়া দুঃখজনক। এজন্য অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তাছাড়া স্কুল চলাকালীন বিভিন্ন গ্রুপের স্কুলের সামনে উপস্থিতি বন্ধের জন্য সংশ্লিষ্ট থানার পক্ষ থেকে টহল পুলিশের ব্যবস্থা করলে স্কুলের এসব গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না বলেও তিনি অভিমত দেন।

ডি এক্স গ্রুপ:

ডি এক্স গ্রুপ রাজধানীর একটি প্রভাশালী গ্রুপ। ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা, মাদক সেবন ও মাদক ব্যবসার মতো বিভিন্ন কু-কাজে গ্রুপটি লিপ্ত আছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডি এক্স গ্রুপের সব সদস্যই অপ্রাপ্ত বয়স্ক, রাজধানীর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্ররা এই গ্রুপের সদস্য। এই গ্রুপের সব সদস্য মাদকের ভয়াবহ জালে জড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন অপরাধে লিপ্ত হচ্ছে। ডি এক্স গ্রুপের অন্যতম সদস্য রাহুল ওরফে ডি এক্স রাহুল রাজনৈতিক কিছু নেতার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় এলাকায় ছড়িয়ে দিয়েছে ইয়াবার মতো মরণ নেশা। এ গ্রুপের অন্যান্য সদস্য সাইফুল, কাব্য, মুন্না, শাবাব ও অন্তু ওরফে ডাক্তার অন্তু মাদক বিক্রির কাজে জড়িত। গ্রুপটি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মোটরসাইকেল চুরির সঙ্গে জড়িত বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডি এক্স গ্রুপের সঙ্গে কিছুদিন পর পরই অন্য গ্রুপের মারধর হয়- এদের মধ্যে বগা বাবু, বোমা রাকিব ও কেবিআর গ্রুপ অন্যতম। এ গ্রুপটির অনেক সদস্য ছিনতাই, মাদক সেবনসহ বিভিন্ন মামলায় জামিনে আছে।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু  বলেন, স্কুলের বাচ্চাদের এসব গ্রুপিং বন্ধ করতে সবার আগে প্রয়োজন পারিবারিক সচেতনতা। এছাড়াও শিক্ষকদের সচেতনতার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা উচিত। তিনি অভিযোগ করেন, রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় এসব কোমলমতি শিক্ষার্থী নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। মাদক ও অস্ত্রবহনসহ সব ধরনের অনৈতিক কাজ করানো হচ্ছে তাদের দিয়ে। তিনি প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান।

উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলে সক্রিয় একাধিক গ্রুপ:

রাজধানীর কাকরাইলে জনপ্রিয় স্কুল উইলস লিটল ফ্লাওয়ারে গ্রুপিংয়ের বিষয়টি অনেক আগে থেকেই চলছে। গ্রুপিং নিয়ে এখানে হরহামেশা মারধরের ঘটনা ঘটে। বর্তমান স্কুল প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে মারধর কিছুটা কমলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দশম শ্রেণীর একজন ছাত্র  বলেন, এখন তো মাত্র ক্লাস শুরু হল। অনেকেই স্কুলে আসা শুরু করেনি। কিছুদিন পর নতুন ছাত্র আসা শুরু করলেই হবে গ্রুপিং এবং গণ্ডগোল। সে জানায়, আগে অনেকেই স্কুল ব্যাগে সুইচ গিয়ার (চাকু) নিয়ে এলেও বর্তমানে স্কুল প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে সে প্রবণতা আপাতত: বন্ধ আছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, স্কুলটিতে নবম শ্রেণীর সাইন্স বিভাগের ছাত্র মোন্তা ও হিমেলের নেতৃত্বে আছে কমপক্ষে ৩০ জনের একটি গ্রুপ। এক সঙ্গে দল বেঁধে আড্ডা দেয়া ছাড়াও হরহামেশাই এরা লিপ্ত হয় মারধরে। আর অষ্টম শ্রেণীতে জয় রহমান নামের এক শিক্ষার্থীর আছে ৩০-৪০ জনের একটি গ্রুপ। এই জয় একজন প্রভাবশালীর সন্তান বলে জানা গেছে। স্কুলে অনুমতি ছাড়া সব ক্লাসেই মোবাইল ব্যবহার নিষিদ্ধ থাকলেও লুকিয়ে মোবাইল এনে গ্রুপিংয়ের কাজে ব্যবহার করছে এবং স্কুলের বাইরে গিয়ে মারধরে লিপ্ত হচ্ছে। পিয়াল নামের স্কুলের একজন সাবেক ছাত্র এদের শেলটার দিচ্ছে বলে জানা গেছে। এছাড়া গ্রুপিংয়ের পাশাপাশি স্কুলে চুরির ঘটনাতেও কিছু ছাত্র জড়িয়ে পড়ছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। বর্তমানে এসব গ্রুপের তৎপড়তা রোধে স্কুলের চারিদিকে ১৫৭টি সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। মাসুদ নামের স্কুলের একজন গার্ড  বলেন, বছরের শুরুতে স্কুলে তেমন একটা মারধর না হলেও প্রতি বছরেই মাঝামাঝি সময় থেকেই ঝামেলা শুরু হয়।

বিষয়টি স্বীকার করে স্কুলটির অধ্যক্ষ আবুল হোসেন  বলেন, গ্রুপিং করে মারধরের ঘটনায় আমরা কয়েক জনকে টিসি দিয়ে বের করে দিয়েছি। তবুও মারধর হলে আমরা প্রথমে শিক্ষার্থীদের ডেকে মীমাংসা করে দেই আবার অভিভাবকদেরও জানাই। মারধরের ঘটনা আগের থেকে ৯০ ভাগ কমেছে বলে তিনি দাবি করেন। রাজধানী অধিকাংশ স্কুল-কলেজ ছাড়াও দেশের বড় বড় শহরগুলোতে এ ধরনের অসংখ্য গ্রুপ রয়েছে।

স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও - dainik shiksha স্কুল-কলেজ খুলছে রোববার, ক্লাস চলবে শনিবারও নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0043580532073975