উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়ভার ও কয়েকটি প্রশ্ন - Dainikshiksha

উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়ভার ও কয়েকটি প্রশ্ন

ড. সুলতান মাহমুদ রানা |

কয়েক দিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আবাসিক হল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ১০০টি উত্তরপত্র উদ্ধার করা হয়। মূলত একজন শিক্ষকের নামে বরাদ্দ করা উত্তরপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী কর্তৃক মূল্যায়নের অভিযোগ পাওয়া যায়। উত্তরপত্রগুলো রাজশাহী শহরের একটি সরকারি কলেজের শিক্ষকের নামে বরাদ্দ ছিল। এর মধ্যেই অভিযুক্ত শিক্ষককে ওএসডি করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল ও উত্তরপত্র মূল্যায়ন নিয়ে অনেক দিন থেকে নানা অসংগতির কথা আমাদের কানে আসে। শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে যেহেতু সবাই সোচ্চার, সেহেতু এ ধরনের অভিযোগে চারদিকে হৈচৈ পড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।

এসব ক্ষেত্রে শিক্ষকরা দায়ী হলেও শিক্ষা প্রশাসনও এর দায় কোনোভাবে এড়াতে পারে না। কারণ এগুলো যথাযথ দেখভাল ও তদারকির কাজটি শিক্ষা প্রশাসনের। উল্লেখ্য, শিক্ষা প্রশাসনের গাফিলতিতে অহরহ নানা ধরনের অনৈতিক কার্যক্রম ঘটে চলেছে। অনেক সময় পাকাপোক্ত আইন থাকলেও সেগুলো যথাযথ তদারকি কিংবা বাস্তবায়নের অভাবে অনিয়ম ঘটে থাকে। শিক্ষা কাঠামো নিয়ে নানা হতাশাব্যঞ্জক বক্তব্য আমরা প্রায়ই সরকারের উচ্চ মহল থেকে শুনে থাকি। কিন্তু এসবের সুরাহা কেন হয় না—সেই প্রশ্নটি অনেক দিনের।

কয়েক দিন আগেই শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ‘শিক্ষকতায় কিছু অসৎ লোক ঢুকে গেছেন। ’ তিনি বললেন, ‘তাঁরা ক্লাসে পড়ান না। কিন্তু বাড়িতে টাকা নিয়ে পড়ান। সংখ্যায় কম হলেও কিছু শিক্ষক পরীক্ষাকেন্দ্রে এমসিকিউ প্রশ্নের উত্তর বলে দিচ্ছেন। এর চেয়ে কুশিক্ষা আর কী হতে পারে?’ এমন অভিযোগ যখন স্বয়ং শিক্ষামন্ত্রী করে থাকেন তখন তো এর সমাধান সহজ হওয়ার কথা। তাহলে কেন এর সমাধান হচ্ছে না? কথিত অসৎ শিক্ষকদের চিহ্নিত করতে সরকার কিংবা প্রশাসনের খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা নয়।

শিক্ষাব্যবস্থায় যখন এ ধরনের অসৎ কারবার নিয়ে প্রশাসনের উচ্চপর্যায় থেকে শঙ্কা প্রকাশ পায় তখন কোনো পাবলিক পরীক্ষার উত্তরপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো আবাসিক শিক্ষার্থীর কক্ষে উদ্ধার হওয়ার ঘটনায় আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। শিক্ষামন্ত্রী প্রায়ই বলেন, শিক্ষার মান বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এটা আজকের দিনে যথেষ্ট নয়। মান আরো বাড়াতে হবে। সরকার এখন সে কাজটিই করছে। এ জন্য শিক্ষকরাই হলেন নিয়ামক শক্তি, তাঁরাই আসল শিক্ষাটা দেবেন। তাহলে সংগত কারণেই শিক্ষকের মান নিয়ে ভাবতে হবে। পাশাপাশি অনৈতিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের খুঁজে বের করতে হবে। নারায়ণগঞ্জের শ্যামল কান্তি ভক্তকে দৃশ্যত যে অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, এমন অভিযোগের কথা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেলায়ই আছে। অনেক ক্ষেত্রেই শুনে থাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন ফান্ডে টাকা না দিলে শিক্ষকের চাকরি হয় না। তাহলে ওই শিক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়ন কিংবা শিক্ষাক্ষেত্রে কেমন ভূমিকা রাখবেন সেটি আঁচ করতে খুব অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।

একজন শিক্ষকের নামে বরাদ্দ করা উত্তরপত্র অন্য কাউকে দিয়ে মূল্যায়ন করার ঘটনা আমাদের দেশে হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ আমাদের কানে এসেছে। প্রবাদে আছে, ‘চোরের ১০ দিন আর গৃহস্থের এক দিন’। কাজেই কদাচিৎ অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশ পায়। বাকিগুলো অন্ধকারেই থেকে যায়। মাধ্যমিক কিংবা উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যত শিক্ষার্থী রয়েছে সেই তুলনায় উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষক নেই। মূলত একজন শিক্ষক বিভিন্ন ধরনের দায়িত্ব পালন করেন। পরীক্ষার উত্তরপত্র মূল্যায়ন তাঁর একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। পরীক্ষা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষককে পাল্লা দিয়ে উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজ করতে হয়। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফলাফল দিতে মরিয়া কর্তৃপক্ষ। এ কর্মযজ্ঞ সাধন করতে চতুর্মুখী সংকটে পড়ে যান পরীক্ষকরা।

এ বছরের মাধ্যমিক ফলাফলের পর শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে আগে পরীক্ষকদের গাফিলতি আর পদ্ধতিতে ত্রুটি ছিল। এবার নতুন পদ্ধতিতে ‘যথাযথ’ মূল্যায়ন হওয়ায় পাসের হার কিছুটা কমেছে। তাঁর বক্তব্যের সারকথা হলো, আগে পরীক্ষকরা দায়সারাভাবে খাতা দেখতেন, তাঁদের মূল্যায়নের পার্থক্যও হতো অনেক বেশি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগের দায়সারাগ্রস্ততা থেকে কি এখন মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়েছে? যদি সম্ভবই হয়, তাহলে উত্তরপত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে কেন?

তা ছাড়া উত্তরপত্র মূল্যায়নে শিক্ষা বোর্ডের নানা রকম ধরাবাঁধা বাধ্যবাধকতা থাকে। এ কারণেও কেউ কেউ চুপচাপ বিষয়টি মেনে নিলেও অনেকেই উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে অবলম্বন করেন অসদুপায়। অবশ্য যাঁরা উত্তরপত্র মূল্যায়নের দায়িত্ব পান তাঁরা তো শিক্ষকও। আবার তাঁরা কোচিং সেন্টারও চালাচ্ছেন। কাজেই অল্প সময়ে অপেক্ষাকৃত বেশি উত্তরপত্র মূল্যায়নে গাফিলতির বিষয়টি এসেই যায়।

উত্তরপত্র মূল্যায়নে গাফিলতির অন্যতম কারণ হলো প্রাইভেট টিউটর ও কোচিংমুখী শিক্ষাব্যবস্থা। স্কুল-কলেজে কোনো রকম হাজিরা দিয়েই অনেক শিক্ষক কোচিংবাজি করে থাকেন। দায়সারা গোছের ক্লাস নিয়েই প্রতিদিনের কাজ শেষ করেন তাঁরা। তথাকথিত অসৎ শিক্ষকরা তাঁদের কাছে কোচিং করতে বাধ্য করছেন শিক্ষার্থীদের। এসব কোচিংবাজ শিক্ষকের কাছে রীতিমতো জিম্মি হয়ে পড়েছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এটি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। শিক্ষককে কোচিং, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও উত্তরপত্র একসঙ্গে ম্যানেজ করতে স্বাভাবিকভাবেই হিমশিম খেতে হচ্ছে।

এ ছাড়া লক্ষ করা যায় যে কম যোগ্যতাসম্পন্ন কিন্তু যোগাযোগের মাত্রায় এগিয়ে থাকা শিক্ষককে অধিক পরিমাণে উত্তরপত্র দেওয়া হচ্ছে। আবার যোগ্য শিক্ষকদের অনেকেই বোর্ডের পরীক্ষকই হতে পারেন না। অন্যদিকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফলাফল প্রস্তুত করার লক্ষ্যে উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য সময় দেওয়া হচ্ছে সীমিত। সীমিত সময়ের জন্য বরাদ্দ করা উত্তরপত্রের সংখ্যা বিবেচনায় যথাযথ মূল্যায়নে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। বিশেষত সময় স্বল্পতার অজুহাতে পরীক্ষকরা অন্য কারো দ্বারা উত্তরপত্র মূল্যায়ন করাচ্ছেন।

উত্তরপত্র মূল্যায়নের বিষয়সহ বিভিন্ন সময়ে শিক্ষাক্ষেত্রে উত্থিত সব অভিযোগ সমাধানে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষা প্রশাসনের আন্তরিকতার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। কারণ গুণগত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষাক্ষেত্রে উঠে আসা অভিযোগগুলো গুরুত্ব সহকারে মোকাবেলার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক, স্থায়ী পরীক্ষাপদ্ধতি, শিক্ষকদের কোচিং-বাণিজ্যের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, কোচিংবাজ শিক্ষককে চিহ্নিতকরণ সাপেক্ষে শাস্তির আওতায় আনার মাধ্যমে মানসম্মত শিক্ষার যাত্রা সুগম করা যেতে পারে।

লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.025158882141113