এই লেখাটি অভিভাবকদের জন্য: ড. জাফর ইকবাল - দৈনিকশিক্ষা

এই লেখাটি অভিভাবকদের জন্য: ড. জাফর ইকবাল

ড. জাফর ইকবাল |

আমি আজকের লেখাটি একটি চিঠি দিয়ে শুরু করতে চাই। আমি চিঠিটি পেয়েছি দিন দশেক আগে, চিঠিটা পড়ার পর কী করব বুঝতে না পেরে ব্যাগে ঢুকিয়ে সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি। মনের ভেতর এক ধরনের চাপা অশান্তি। আমি চিঠিটা হুবহু তুলে দিচ্ছি। কে চিঠিটা লিখেছে সেটা যেন বোঝা না যায়, তাই দুই একটা শব্দ পাল্টে দিয়েছি। চিঠিটা এরকম :

‘প্রিয় লেখক,

জানেন আমি কতটা কষ্টের মধ্যে আছি? একটা রাতও আমি ভালোভাবে ঘুমাতে পারছি না, এখন বাজে রাত ২:৩৭ কিন্তু আমার চোখে বিন্দুমাত্র ঘুম নেই। আমি এসএসসি পরীক্ষার্থী, বয়স ১৬ বছর। আগামী ৪ মে আমাদের রেজাল্ট দিবে। আমি জানি যদি আমি এ-প্লাস না পাই তাহলে আমার বেঁচে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। এইজন্যই আমি আগে থেকে ঘুমের তেরোটা ট্যাবলেট জোগাড় করে ফেলেছি। আমি একটি উচ্চশিক্ষিত পরিবারের মেয়ে, কিন্তু জানেন তারা কিন্তু কখনো জিজ্ঞেস করেনি, তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও? তাদের ইচ্ছা আমি ডাক্তার হতে চাই, কিন্তু জানেন আমার সেটাতে বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই। আবার মেডিক্যালে ভর্তি হতে হলে নাইন পয়েন্ট দরকার কিন্তু আমি যদি এ-প্লাস না পাই এসএসসিতে তাহলে আমার আব্বু বলেছে সবকিছু আমার শেষ হয়ে যাবে। কারণ ইন্টারমিডিয়েট নাকি অনেক কঠিন।

২০১১ সালে আমি সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছিলাম কিন্তু এ-প্লাস পাইনি, আমার আম্মু চিত্কার করে মরা কান্নার মতো করে কেঁদেছেন। আমি কিন্তু তখনো বুঝতাম না এ-প্লাস কী? এ-প্লাস না পাওয়াতে আমার পৃথিবী অন্যরকম হয়ে গেল। সেই ছোট্ট বয়সেই আমি সবার অবহেলার পাত্র হলাম। ফ্যামিলির কেউ আমাকে মূল্যায়ন করত না। জানেন সেই ২০১২, ২০১৩, ২০১৪ প্রায় প্রত্যেকদিন আমি দরজা লাগিয়ে কেঁদেছি। আমার আব্বু প্রকাশ্যে সব মানুষের কাছে বলত, আমাকে দিয়ে কিছুই হবে না।

কিন্তু আমি আসলে সেরকম না। খেলাধুলা, নাচ, গান, অভিনয়, বক্তৃতা আবৃত্তি সব পারি। আমি গান প্রতিযোগিতায় বিভাগীয় পর্যায় পর্যন্ত গিয়েছিলাম। তারা কখনো আমার সুনাম করে না। সবসময় বলে আমি নাকি কিছুই পারি না। সবসময় অন্যসব বান্ধবীর সাথে আমাকে তুলনা করে। আমি ২০১৪ সালে এ-প্লাস পাই জেএসসিতে, কিন্তু আমাকে কিছুই দেওয়া হয়নি। কিন্তু আমার ছোটভাই ক্লাস এইটে পড়ে, ওকে স্মার্টফোন কিনে দেওয়া হয়েছে।

আপনি কী জানেন এখন আমার চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে? ২০১৪ সালের রেজাল্ট ভালো করার পর সবাই এখন ভালোভাবে দেখে, কিন্তু আমি জানি যদি আমি এ-প্লাস না পাই এসএসসিতে তাহলে আমার আবার আগের মতো দশা হবে।

আপনি কি বুঝতে পারছেন না, আমি কতোটা কষ্টের মধ্যে আছি? আমি আমার স্বপ্নের কথা যতবার আব্বু আর আম্মুর কাছে বলেছি ততোবার তারা বলেছে—ওটা আমাকে দিয়ে হবে না, কারণ আমি গাধা।

আচ্ছা, শুধুমাত্র পড়াশোনা নামক জিনিসটার জন্য ১৬ বছরের একটা কিশোরী কেন এতটা কষ্ট পাচ্ছে আপনি কি বলতে পারবেন?’

না, আমি বলতে পারব না। শুধু আমি নই, আমার ধারণা ১৬ বছরের এই মেয়েটির প্রশ্নের উত্তর কেউই দিতে পারবে না। এই চিঠি লেখার পর এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে, আমি জানি না পরীক্ষায় মেয়েটি এ-প্লাস পেয়েছে কি না। নাকি মেয়েটিকে তার জোগাড় করে রাখা তেরোটা ঘুমের ট্যাবলেটের কাছে আশ্রয় নিতে হয়েছে—আমি সেটাও জানি না।

হতে পারে মেয়েটি অনেক বেশি আবেগপ্রবণ, যেটি লিখেছে সেটা এই বয়সী ছেলে-মেয়েদের তীব্র আবেগের এক ধরনের বহির্প্রকাশ। কিন্তু মুশকিল হলো, এটি কিন্তু আমার কাছে লেখা একমাত্র চিঠি না। আমি হুবহু এই ধরনের অসংখ্য চিঠি, ইমেইল এসএমএস পেয়েছি যার বক্তব্য ঠিক এরকম। আমার কাছে কোনো পরিসংখ্যান নেই, কিন্তু আমি জানি আমাদের দেশে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের অভিভাবক প্রজাতির জন্ম হয়েছে—লেখাপড়া নিয়ে তাদের সম্পূর্ণ ভুল এক ধরনের চিন্তাভাবনা এই দেশের ছেলে-মেয়েদের শৈশবে পুরোপুরি ধ্বংস করে দিচ্ছে। একজন মানুষের কৈশোরটি হচ্ছে স্বপ্ন দেখার বয়স, এই বয়সে যদি একজনকে ঘুমের ট্যাবলেট মজুদ করতে হয় তাহলে তার জীবনকে আমরা কী নিয়ে স্বপ্ন দেখাতে শেখাব?

সব অভিভাবক নিশ্চয়ই এরকম নন, যাদের ওপর ভরসা করতে পারি সে রকম অভিভাবক নিশ্চয়ই আছেন। একটি ছেলে বা মেয়ের পরীক্ষা খারাপ হলে সান্ত্বনা দেন, তাদের দুঃখ, হতাশা বা স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাটা ভাগাভাগি করে নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখাতে সাহায্য করেন—এরকম অভিভাবকও নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। ছেলেমেয়েদের ভালো মানুষ হতে শেখানো, শত প্রলোভনেও সত্ মানুষ হয়ে থাকার কথা বলা বাবা-মাও নিশ্চয়ই আমাদের ভবিষতের মানুষ গড়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই কথাটা এখন নিশ্চয়ই কেউ আর অস্বীকার করবে না—আমাদের ভেতরে অভিভাবকের নতুন একটি প্রজন্মের জন্ম হয়েছে, তারা শুধু যে তাদের ছেলে-মেয়েদের পীড়ন করে তাদের শৈশবকে বিষাক্ত করে দিচ্ছেন তা নয়, তাদেরকে হাতে ধরে অন্যায় করতে শেখাচ্ছেন। পরীক্ষার হলে গেলেই সেগুলো দেখা যায়। একটা সময় ছিল যখন পরীক্ষা শুরুর আগের মুহূর্তে ছেলে-মেয়েরা শেষ বারের মতো বই আর ক্লাস নোটের ওপর চোখ বুলাত, এখন শেষ মুহূর্তে তারা তাদের স্মার্টফোনের ওপর চোখ বুলায়, তাদের বাবা-মায়েরা পাশে দাঁড়িয়ে থেকে তাদের উত্সাহ দেন। পরীক্ষা শুরুর আগে নিশ্চিতভাবে বহু নির্বাচনী প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়, তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে। ছেলে-মেয়েরা যেটুকু আগ্রহ নিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর মুখস্ত করে বাবা-মায়ের আগ্রহ তার থেকে কম না। আমরা চোখের সামনে একটা নতুন বিষয় দেখছি, বাবা-মায়েরা প্রকাশ্যে সবার চোখের সামনে নিজের ছেলে-মেয়েদের হাতে ধরে অন্যায় করতে শেখাচ্ছেন। পত্র-পত্রিকায় সেইসব ছবি এতবার ছাপা হয়েছে যে, এখন মনে হয় এগুলো সবার গা-সহা হয়ে গেছে।

আমার পরিচিত একজন পরীক্ষার ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র মুখস্ত করে পরীক্ষা দেওয়া একজনকে জিজ্ঞেস করেছিল, এরকম একটা অন্যায় কাজ করতে তাদের খারাপ লাগে না? ছেলেটি অবাক হয়ে তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো, খারাপ লাগবে কেন? আপনারা পরীক্ষা দেওয়ার সময় ‘সাজেশন’ নিয়ে পরীক্ষা দেননি? যারা ফাঁস করা প্রশ্নপত্র নিয়ে পরীক্ষা দেয় তাদের ভেতর অপরাধবোধ নেই। আমাদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রশ্নপত্র ফাঁসের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবার জন্য এগুলোকে ‘সাজেশন’ বলে অনেকবার ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এখন এটাই হয়েছে কাল। একজন যখন অন্যায় করে তখন তার ভেতরে অপরাধবোধ থাকলে আমরা তবুও আশা করতে পারি হয়তো কখনো তার ভেতরে পরিবর্তন আসবে। কিন্তু যদি অপরাধবোধ না থাকে তাহলে তো আমাদের সামনে তাকাবার কিছু নেই। আর যখন এই অশুভ অন্যায়ে সন্তানদের হাতেখড়ি হয় তাদের বাবা-মায়ের হাত ধরে, তখন আমরা কার দিকে মুখ তুলে তাকাব?

একজন বাবা-মা যখন তাদের সন্তানকে পৃথিবীতে নিয়ে আসেন তখন তাদের সন্তানের জন্যে কিছু দায়িত্ব থাকে। সবচেয়ে বড় দায়িত্বটি হচ্ছে যে এই সন্তানকে একটা আনন্দময় শৈশব দিতে হয়। কীভাবে কীভাবে জানি এই বিষয়টা অনেক বাবা-মায়েরা ভুলে গেছেন। তাদের সব হিসেবে গোলমাল হয়ে গেছে, তারা কীভাবে কীভাবে জানি মনে করছেন তাদের সন্তানদের জন্যে একটি মাত্র দায়িত্ব—সেটি হচ্ছে পরীক্ষায় এ-প্লাস পাওয়া! সেই এ-প্লাসের জন্যে পুরো শৈশবকে ধ্বংস করে ফেলতে তাদের কোনো দ্বিধা নেই, কোনো সংকোচ নেই।

একটা সময় ছিল যখন কোনো একজন বাবা কিংবা মা তার সন্তানকে দেখিয়ে আমাকে বলতেন, ‘স্যার আমার এই ছেলেটি (কিংবা মেয়েটি) গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে!’ আমি তখন আনন্দে আটখানা হয়ে বলতাম, ‘সত্যি? কী চমত্কার! বাহ! ওয়ান্ডারফুল! ফ্যান্টাস্টিক!’ তারপর ছেলেটা বা মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে একেবারে বুকের ভেতর থেকে আশীর্বাদ করে দিতাম।

আজকাল আর সেটি হয় না। আজকাল যখন একজন বাবা কিংবা মা আমাকে তার সন্তানকে দেখিয়ে বলেন, ‘স্যার, আমার ছেলেটি বা মেয়েটি গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছে’ তখন আমি আনন্দে আটখানা হই না, আমি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে এই ছেলেটি বা মেয়েটির দিকে তাকাই। আমার চোখের সামনে দিয়ে একের পর আরেক দৃশ্য খেলে যেতে থাকে। আমি জানি এই ছেলে বা মেয়েটির জীবনটি। নিশ্চয়ই ভয়ংকর একটি জীবন। এই ছেলেটি বা মেয়েটি শুধু যে স্কুলে গিয়েছে তা নয়, নিশ্চয়ই স্কুলের পর তাকে প্রাইভেট পড়তে হয়েছে, কোচিং সেন্টারে যেতে হয়েছে। এই ছেলে বা মেয়েটির জীবনে নিশ্চয়ই বিনোদনের জন্যে একটি মুহূর্তও রাখা হয়নি। তাকে গল্প বই পড়তে দেওয়া হয়নি, গান শুনতে দেওয়া হয়নি, ছবি আঁকতে দেওয়া হয়নি, তাকে শুধু পড়তে হয়েছে। নিরানন্দ পাঠ্যবই পড়েও শেষ হয়নি, তাকে গাইড বই পড়তে হয়েছে। শেখার জন্যে পড়ার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ আছে, কিন্তু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়ার জন্যে প্রশ্নের উত্তর হিসেবে মুখস্থ করার মাঝে কোনো আনন্দ নেই। বাংলাদেশের সব সম্ভ্রান্ত পত্রিকা নিয়মিত গাইড বই ছাপায়। বাবা-মায়েরা সেই পত্রিকার পৃষ্ঠা কেটে নিশ্চয়ই গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া এই ছেলেটি বা মেয়েটিকে মুখস্থ করতে দিয়েছেন। এই ছেলেটি বা মেয়েটি সেগুলো মাথা গুঁজে মুখস্থ করেছে।

বাবা-মা নিশ্চয়ই এই ছেলেটি বা মেয়েটিকে কোনো রকম উত্সাহ দেননি, অনুপ্রেরণা দেননি। নিশ্চয়ই তাকে শুধু চাপের মাঝে রেখেছেন। প্রতি মুহূর্তে অন্য ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনা করে তাকে অপমান করেছেন, অপদস্ত করেছেন। তাকে ভয় দেখিয়েছেন। শুধু বাবা-মা নয়, নিশ্চয়ই স্কুলের শিক্ষকেরাও তাকে পীড়ন করেছে, তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্যে চাপ দিয়েছে। প্র্যাকটিক্যাল পরীক্ষায় পুরো পঁচিশ মার্ক পাইয়ে দেওয়ার জন্যে তার কাছ থেকে টাকা আদায় করেছে।

গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া এই ছেলে বা মেয়ের কষ্টের জীবন এখানেই শেষ হয়নি, পরীক্ষার আগে আগে তার বাবা-মা নিশ্চয়ই ফেসবুক আতিপাতি করে খুঁজেছেন প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে কি না সেটি দেখার জন্যে। ফেসবুক নিশ্চয়ই তাদের হতাশ করেনি, ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্নপত্র নিয়ে তখন তিনি শিক্ষকদের কাছে ‘মেধাবী’ প্রাইভেট টিউটরদের কাছে ছুটে গেছেন তার সমাধান বের করিয়ে দেবার জন্যে। সেই সমাধান তুলে দিয়েছেন তাদের সেই ছেলেটি বা মেয়েটির হাতে। তাকে দিয়ে সেটি মুখস্থ করিয়েছেন।

পরীক্ষার দিন তাকে পরীক্ষার হলে নিয়ে গেছেন। সেখানে তারা স্মার্টফোনের দিকে নজর রেখেছেন। পরীক্ষার আধাঘণ্টা আগে যখন এমসিকিউ প্রশ্নগুলো ‘হোয়াটসঅ্যাপ’ বা ‘ভাইবার’-এ চলে এসেছে তখন সেগুলো সমাধান করে সন্তানের হাতে তুলে দিয়েছেন, তাকে মুখস্থ করিয়েছেন। পরীক্ষা শেষে যখন ছেলেটি বা মেয়েটি পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েছে তখন তাকে ‘পরীক্ষা কেমন হয়েছে’ জিজ্ঞেস না করে ‘কতো নম্বর উত্তর দিয়েছিস’ জিজ্ঞেস করেছেন। পুরো উত্তর না দিয়ে থাকলে তাকে নিষ্ঠুর ভাষায় গালাগাল করেছেন, অপমান করেছেন।

পরীক্ষা শেষে ফলাফলের জন্যে যখন অপেক্ষা করছে তখন প্রতি মুহূর্তে সন্তানকে গালাগাল করছে। গোল্ডেন এ-প্লাস না পেলে যে কী সর্বনাশ হয়ে যাবে, বার বার সেটা মনে করিয়ে দিয়েছে।  তারপর পরীক্ষার ফলাফল বের হয়েছে এবং সন্তান গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছে। কাজেই গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়া ছেলেটি বা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমি মনে মনে ভাবি—আহা! এই ছেলেটিকে বা মেয়েটিকে না জানি কত কষ্ট কত অপমান, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা আর যন্ত্রণায় ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে।

শুধু তাই নয়, গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া ছেলে বা মেয়েটিকে দেখে আমার অন্যসব ছেলে বা মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়, যারা গোল্ডেন ফাইভ পায়নি। তারা না জানি কত যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। যখন একটি ছেলে বা মেয়ের আশাভঙ্গ হয় তখন বাবা-মায়েদের তাদের বুক আগলে সান্ত্বনা দিতে হয়, সাহস দিতে হয়। কিন্তু আমাদের হয় ঠিক তার উল্টোটা, বাবা মায়েরা ভয়ঙ্কর একটা আক্রোশে তাদের ছেলেমেয়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই প্রতিবছর যখন একটি পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল বের হয় আমি তখন কয়েকদিন নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকি, খবরের কাগজ খুলতে আমার ভয় হয়। কারণ আমি জানি, আমি দেখব যে, পরীক্ষায় ফল ভালো হয়নি বলে এই দেশের ছেলেরা বা মেয়েরা আত্মহত্যা করেছে। কেন জানি আমার নিজেদের দোষী মনে হয়। আমরা এখনো এই দেশের ছেলেমেয়েদের বোঝাতে পারিনি, জীবনটা অনেক বিশাল একটা ব্যাপার, তার মাঝে একটা পরীক্ষার ফলাফল অনেক ক্ষুদ্র একটা বিষয়!

আমি এই লেখাটি লিখছি অভিভাবকদের জন্যে। আমি তাদের বলতে চাই, আপনার সন্তানকে একটি আনন্দময় শৈশব উপহার দিন। আপনি আপনার জীবনে যেটি পাননি সেটি পাওয়ার জন্যে আপনার সন্তানকে জোর করবেন না। তাকে তার মতো করে নিজের জীবনের স্বপ্নকে বেছে নিতে দিন। সে হয়তো জীবনের অনেক বাস্তবতা জানে না, তাকে সেই তথ্যটুকু দিতে পারেন, কিন্তু তার স্বপ্নের ওপর আপনার ইচ্ছেটুকু জোর করে চাপিয়ে দেবেন না। পৃথিবীর সব ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়াররা সবচেয়ে সুখী মানুষ নয়। একটি মাত্র জীবন, সেই জীবনটিতে যদি সুখ আর আনন্দ না থাকে তাহলে সেই জীবন দিয়ে আমি কী করব?

স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার বাইরে আনন্দ করার জন্যে, উপভোগ করার জন্যে অনেক সময় থাকতে হয়। তাদের জন্যে সেই সময়টুকু বের করে দিন। মাঠে গিয়ে ছোটাছুটি করতে দিন। গল্পের বই পড়তে দিন, গান গাইতে দিন, নাচতে দিন, অভিনয় করতে দিন। যদি কিছু না করে আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন দেখতে চায়, তাকে সেটাই করতে দিন। লেখাপড়ার বাইরে আনন্দ উপভোগ করার জন্যে সময় বের করা খুব সহজ। তাকে প্রাইভেট আর কোচিং থেকে মুক্তি দিন। একটা ছেলে বা মেয়ে নিজে নিজে পড়ালেখা করতে পারে, তাকে সেই আত্মবিশ্বাসটি নিয়ে বড় করে তুলুন। আপনাদের মনে রাখতে হবে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশের নেতৃত্ব দেবে এই প্রজন্মের আত্মবিশ্বাসী ছেলেমেয়েরা—গোল্ডেন ফাইভ পাওয়া ছেলেমেয়েরা নয়।

আমি এই লেখাটি শুরু করেছিলাম একটি চিঠি দিয়ে। লেখাটি শেষ করতে চাই আরেকটা চিঠি দিয়ে। একজন আমাকে লিখেছে—

‘দাদু,

আমি দশম শ্রেণিতে পড়ি। আমি কখনো প্রাইভেট বা কোচিং করিনি, কিন্তু আমি আমার ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল আর আমার স্কুলের হেড গার্লও। সবাই বলে প্রাইভেট না পড়লে নাকি ভালো রেজাল্ট করা যায় না, কিন্তু আমি একা একা পড়ে যখন ভালো রেজাল্ট করি তখন আমার সব বন্ধুরা একদম অবাক হয়ে যায়। সবাই আমাকে বলে আমি নাকি লুকিয়ে কোচিং করি, কিন্তু তাদের বলি না! আমি ওদের কীভাবে বোঝাব যে, নিজে নিজে পড়তে আনন্দটা অনেক বেশি এবং কোনো প্রাইভেট এর প্রয়োজন আমাদের নেই। (আমি জানি না তুমি আমাকে বিশ্বাস করবে কি না। কারণ আমার এ কথা কেউ বিশ্বাস করতে চায় না!)’

অবশ্যই আমি এই ছোট মেয়েটির কথা বিশ্বাস করেছি, কারণ আমি নিজেই এই কথা বহুদিন থেকে বলে আসছি। অভিভাবকদের অনুরোধ আপনারাও এই মেয়েটির কথা বিশ্বাস করুন। প্রাইভেট, কোচিং থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের আনন্দ করার সময় বের করে চমত্কার একটা শৈশব উপহার দিন।

লেখক :কথাসাহিত্যিক, শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041089057922363