একত্রে জাতীয়করণ করে ম্যানেজিং কমিটি উঠিয়ে দিন - দৈনিকশিক্ষা

একত্রে জাতীয়করণ করে ম্যানেজিং কমিটি উঠিয়ে দিন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |
Mujammel Ali
অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী

আমাদের শিক্ষামন্ত্রী সেদিন বলেছেন, `শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিটি মাতব্বরি করলে এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা।’ শিক্ষামন্ত্রী সাম্প্রতিক সময়ে কমিটির মাতব্বরীর ব্যাপারটি নিশ্চয় অনুধাবন করতে পেরেছেন। এ কথা বলে তিনি শিক্ষকদের মনোবল যেমন কিছুটা হলেও দৃঢ় করেছেন, তেমনি কমিটির লোকজনকে সংযত থেকে কাজ করার জন্য সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেছেন। মন্ত্রি মহোদয়ের এ উপলব্ধির জন্য ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে কমিটির সর্ব সাম্প্রতিক মাতব্বরীর দু’একটা খন্ডচিত্র তুলে ধরতে চাই।

আসলে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ম্যানেজিং কমিটি অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতার মালিক। তারা ‘পুরুষকে নারী আর নারীকে পুরুষে পরিণত করা’ কিংবা ‘দিনকে রাত আর রাতকে দিন করা’ ছাড়া অন্য সবই যেন করতে পারে। ফলে ম্যানেজিং কমিটির স্বেচ্ছাচারীতা ও স্বৈরাচারীতা কোন কোন জায়গায় এখন চরম পর্যায়ে উপনীত হয়েছে। এ সবের দু’একটি নজির তুলে ধরার জন্য এবং শিক্ষার সব জঞ্জাল দূর করতে সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণ করে ম্যানেজিং কমিটি  উঠিয়ে দেবার বিষয়টি সদাশয় সরকারের দৃষ্টিগোচর করতে আজকের এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। অন্যথায় বিভিন্ন স্থানে ম্যানেজিং কমিটির নানা দৌরাত্ম্যের কারণে আমাদের লেখাপড়ার যেমন বারটা বাজবে, তেমনি বছরে কোটি কোটি টাকা ম্যানেজিং কমিটির রাগব বোয়ালদের পেটে যাবে। এ সব টাকা দিয়ে সব স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের ব্যয় নির্বাহ করা একান্তই সম্ভব।

ঘটনা-১ : মাস কয়েক পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলার বন্দর উপজেলার পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ে যা ঘটেছিল, সে তো সকলের জানা। প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তকে কমিটির লোকজন কান ধরে উঠবস করিয়েছে। একজন প্রধান শিক্ষককে যারা কান ধরে উঠবস করাতে পারে, তাদের কাছে তো সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারী কিছুই না। সেদিনের সে ঘটনার জন্য এদের কোন শাস্তি হয়নি। কে এদের শাস্তি দেবে? শিক্ষা মন্ত্রণালয় কমিটি বাতিল করেছে। তাতে কী হয়েছে ওদের? ওরাই আবার কমিটিতে আসবে। এরাই বার বার ঘুরে ফেরে আসে। এটি কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ ভাবে কত শ্যামল কান্তি যে কত জায়গায় কান ধরে উঠবস করেছেন, তার হিসেব কে জানে?

ঘটনা-২ : গত ২১ আগস্ট, রোববার লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার গোপালরায় পঞ্চপথী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলমকে ওই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আতাউজ্জামান কমিটির সভা চলাকালীন সময়ে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে জুতাপেটা করে। কেবল তাই করে সে থামেনি, সকলের সামনে রেজ্যুলেশন বইটি ও ছিঁড়ে ফেলে দেয়। পরদিন ২২ আগস্ট একটি জাতীয় দৈনিকে পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে সংবাদটি প্রকাশ হলে সকলে তা জানতে পারেন। ২৩ আগস্ট মঙ্গলবার ওই প্রত্রিকার শেষ পাতায় এ নিয়ে একটি সচিত্র প্রতিবেদন ছাপা হয়। ইতিমধ্যে তা দেশের একমাত্র শিক্ষা বিষয়ক অনলাইন পত্রিকা ‘দৈনিক শিক্ষায়’-এ প্রকাশিত হলে সারা দেশের শিক্ষক সমাজের মধ্যে চরম ক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। দিনাজপুর শিক্ষাবোর্ডের দুই সদস্যের তদন্ত কমিটি ওই সভাপতি ও অপর একজন সদস্যকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন।অর্থাৎ তাদের কমিটি থেকে সরিয়ে দিয়েছেন। এদের এর চেয়ে বেশী শাস্তি কে দেবে? এরা যে মহা পরাক্রমশালী!

কেন সভাপতির এ উদ্যত আচরণ? ঘটনার বিবরণে জানা যায়-স্কুলের তহবিলের ১,৫০,০০০ (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকার ওপর নজর পড়ে সভাপতি আতাউজ্জামানের। সে ওই টাকা ধার দিতে প্রধান শিক্ষককে চাপাচাপি করে। প্রধান শিক্ষক কমিটির সভা আহ্বান করেন। সভায় ৫০,০০০(পঞ্চাশ) টাকা দেবার সিদ্ধান্ত হয়। পুরো ১,৫০,০০০ (এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার) টাকা দেবার সিদ্ধান্ত না হওয়ায় সভাপতি ক্ষেপে গিয়ে প্রধান শিক্ষককে গালিগালাজ ও জুতা পেটা করে।

ঘটনা-৩ : গত ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে দাওয়াত না দেয়ায় বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলাধীন আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ মো. সাদেক হোসেনকে উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আবু সাইদ এবং তার লোকজন গালাগাল ও বেদম মারপিট করে আহত করে। মারাত্মক আহত ওই অধ্যক্ষ এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

বিবিধ: নিয়োগের ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি একচ্ছত্র ক্ষমতার মালিক। ইদানিং এনটিআরসিএ’র হাতে নিয়োগ বাছাই চলে গেলেও প্রধান ও সহঃপ্রধান এবং অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ সহ কর্মচারী নিয়োগের একচ্ছত্র ক্ষমতা এখনো তাদের। সব জায়গায় না হলেও অনেক ক্ষেত্রে নিয়োগে প্রচুর টাকা লেনদেন হয়-সে তো ওপেন সিক্রেট। কোন কোন জায়গায় নিয়োগে কেবলই টাকার ছড়াছড়ি। যোগ্যতার বিচারে নয়, ডোনেশনের জোরে কতজনে যে চাকুরি জুটিয়েছেন- সে হিসেব কারো জানা নেই। তাইতো আমাদের অনেক স্কুল-কলেজে মানসম্মত শিক্ষকের আজ বড়ই অভাব। এমনিতে তো আর আমাদের শিক্ষার মানে ধ্বস নামেনি। মানসম্মত শিক্ষার জন্য মানসম্মত শিক্ষক না থাকলে যা হবার তাই হচ্ছে।

ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও সদস্যদের মর্জি মাফিক অনেক জায়গায় প্রতিষ্ঠান চালাতে হয়। তা না হলে নানা সমস্যা। তাঁদের ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য না দিলে অসুবিধা। তাদের রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের দিকে খেয়াল রাখতেই হয়। অনেক নিয়োগে রাজনৈতিক প্রভাব পড়ে থাকে।

কোন কোন জায়গায় নাকি মাসিক বেতন বিলে স্বাক্ষর নিতে সভাপতিকে টাকা দিতে হয়। স্কুল-কলেজের তহবিল থেকে প্রয়োজনে টাকা উঠাতে সভাপতিকে নজরানা না দিলে চলে না। সচরাচর সর্বত্র না হলে ও অনেক জায়গায় এমনিই হয়।

ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন নিয়ে কোন কোন সময় দলাদলি ও গ্রুপিং-লবিং চলে। এ এক জটিল প্রক্রিয়া। দু’বছর পর পর কমিটি নির্বাচন নিয়ে এক মহা ঝামেলা পোহাতে হয়।কোন কোন স্থানে এ নিয়ে তুলকালাম কান্ড ঘটে। প্রতিষ্ঠান প্রধান সহ অন্যান্য শিক্ষকরা এতে প্রচন্ড বিব্রত বোধ করেন। অনেক জায়গায় দীর্ঘ সময়ের জন্য লেখাপড়ার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। এ নিয়ে কয়েক মাস আগে এক প্রধান শিক্ষককে খুন পর্যন্ত হতে হয়েছে ।

কোন কোন জায়গায় স্কুল-কলেজের তহবিলের প্রতি নজর থাকে কমিটির লোকজনের। প্রতিষ্ঠান প্রধান তাদের পছন্দ মতো হলে কথা নেই। তহবিল লুটপাটের কাজ চলে অনায়াসে । আর তিনি যদি তা না হন, তবে তাঁকে নানা ভাবে হেনস্তা হতে হয়। গালি গালাজ, কান ধরে উঠবস, জুতাপেটা ইত্যাদি তো আছেই।

পর্যালোচনা ও মন্তব্য: ম্যানেজিং কমিটির অনেকেই জানেন না, তাদের কাজ কী? অনেক জায়গায় এরা শিক্ষকদের অযথাই বিপক্ষে লেগে থাকেন। নারায়ণগঞ্জের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তই বিদ্যালয়টিকে এ পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে এসেছেন। সেখানে নিয়োগ বাণিজ্য সহ অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে কমিটির সাথে প্রধান শিক্ষকের বনিবনা হচ্ছিল না। তাই তাঁর বিরুদ্ধে মিছেমিছি ধর্ম অবমাননার অজুহাত রটিয়ে তাঁকে কী অপমানটাই না করলো তারা !

লালমনিরহাট জেলার কালিগঞ্জের গোপালরায় পঞ্চপথী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির বিদ্যালয় তহবিলের প্রতি যে লোভ, তা কি আরো অনেক প্রতিষ্ঠানের সভাপতির উক্তরুপ কুমতলবটি আমাদের চোখে ধরিয়ে দেয় না? প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি কোন বিধি বলে সভাপতিকে ৫০,০০০ (পঞ্চাশ হাজার) টাকা ধার দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? এটি কী তাদের এখতিয়ার বহির্ভুত নয়? স্কুল-কলেজের তহবিল কী অনেক জায়গায় এভাবে লুটেপুটে খাওয়া হচ্ছে না?

একটা সময় ছিল যখন স্কুল-কলেজে সরকারের অংশীদারিত্ব নাম মাত্র ছিল । কোন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা লগ্নে তাতে জনসাধারণের অংশগ্রহণ বেশী ও স্বতঃস্ফূর্ত থাকে। তখনকার সময়ে ম্যানেজিংকমিটর অপরিহার্যতা অস্বীকার করা যায় না। কিন্তু, বর্তমানে স্কুল-কলেজ সমূহে সরকারের অংশ গ্রহণ বহু গুণে বৃদ্ধি পেয়েছে।শিক্ষক-কর্মচারীদের সরকার স্কেলের শত ভাগ বেতন দেয়। ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে সরকার লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে।উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা অফিসার ও একাডেমিক সুপারভাইজাররা থাকেন।অনলাইনে যে কোন প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন তথ্য যাচাই বাছাই করা যায়। এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে সহকারি প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষক, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ ও কর্মচারীদের নিয়োগ দিলে নিয়োগ প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও সুন্দর হয়। সরকার ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ও উপবৃত্তি দেয়। তাহলে, এমতাবস্থায় ম্যানেজিং কমিটির প্রয়োজনীয়তা আর কী অবশিষ্ট থাকে?

একটা সময় ম্যানেজিং কমিটি স্কুল-কলেজের জন্য খুবই সহায়ক ছিল। শিক্ষিত না হয়ে ও অনেকে তখন শিক্ষার জন্য নিবেদিত প্রাণ ছিলেন । তাঁরা নিজের জমি-জিরাত বিক্রি করে স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছেন। শিক্ষকদের বেতন দিয়েছেন নিজের পকেটের টাকায়। আজকাল এমন মানুষের সংখ্যা একেবারে নগন্য। এখন অনেকেই পদের লোভী। নিজের পকেট থেকে দু’টাকা খরচ করতে নেই। বরং পকেট ভারী করার জন্য কমিটির সদস্য হওয়া চাই।

আমাদের দেশে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহে হাজারো সমস্যা। সকল সমস্যা সমাধানের একটি মাত্র সহজ উপায় হচ্ছে-একত্রে সব স্কুল-কলেজ জাতীয়করণ করা । তাহলে ক্ষেত্র বিশেষ ম্যানেজিং কমিটির দৌরাত্ম্য একেবারে চুকে যায়। অন্যদিকে সরকারের কোষাগারে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা জমা পড়বে, যা দিয়ে জাতীয়করণের সব ব্যয় পুষিয়ে ও বহু টাকা উদ্ধৃত্ত থাকবে ।

এসব বিবেচনায় সকল স্কুল-কলেজ একত্রে জাতীয়করণের বিষয়টি এখন সারা দেশে বহু ভাবে আলোচিত হচ্ছে।

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট।

উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ - dainik shiksha স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণ ও ‘বিশ্ব বই দিবস’ শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে - dainik shiksha শিক্ষার মান পতনে ডক্টরেট লেখা বন্ধ জার্মান পাসপোর্টে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0038800239562988