একুশ থেকে শিক্ষা নিয়ে - দৈনিকশিক্ষা

একুশ থেকে শিক্ষা নিয়ে

মুজম্মিল আলী |

ফেব্রুয়ারি এলে  ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের জন্য সবার দরদ বেড়ে যায় । গলা ফাটিয়ে আমরা ভালবাসা জাহির করি ।  বাকিটা পুরো বছর এ নিয়ে মাথা ব্যথা থাকে না । নিজেদের অস্তিত্বের সাথে সে এক বড় প্রতারণা । সে আরেক অন্য রকম প্রহসন । মাতৃভাষা দিবসটি আজ শুধু আমাদের নয় । সারা দুনিয়ার সব মানুষের । পৃথিবী এ নিয়ে অহংকার করে । আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রুপে সারা দুনিয়া জুড়ে উদযাপিত হয় আমাদের একুশ । সে আমাদের গর্বিত অর্জন । এ আমাদের সামষ্টিক অহংকার । এটি আমাদের মর্যাদার প্রতীক ।

কিন্তু, ফেব্রুয়ারি চলে গেলে আমাদের ভাষা প্রীতি আর অবশিষ্ট থাকে না । ভিন দেশী সংস্কৃতিতে আমরা হাবুডুবু খেতে শুরু করি । নিজেদের আলট্রা মডার্ণ জাহির করবার জন্যে আপন অস্তিত্বকে বিসর্জন দেই । সে এক আত্মঘাতি কারবার ।

ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির প্রতি সে এক চরম অবমাননা । এ আমাদের কাম্য হতে পারে না ।

এতটা বছর পেরিয়ে এসে ও আমাদের সর্বস্তরে বাংলার প্রচলন নেই । দেশের সর্বোচ্চ আদালতে পর্যন্ত ও এর চর্চা একেবারে সীমিত। এখানে ইংরেজি ভাষায় আজো মামলার রায় লেখা হয় । সে এক বাস্তব লজ্জা আমাদের । এ লজ্জা থেকে উত্তরণের প্রয়াস নেই।

বাংলা ভাষার সংস্কারে কার্যকর উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না । কেবল বাংলা একাডেমি ছাড়া এর আর দ্বিতীয় কোন অভিভাবক নেই । ভাষা গতিময় । নিত্য এর পরিচর্যা অপরিহার্য এক বিষয় । একা বাংলা একাডেমি এর কতটা পরিচর্যা করতে পারে ?

ভিন দেশী ভাষা শেখার জন্য আমরা কত টাকা পয়সা খরচ করি । কিন্তু, নিজের মাতৃভাষার উন্নয়নে আমাদের করণীয় কিছু যেন নেই । বাংলা ভাষার যত্রতত্র অপব্যবহার চোখে পড়ার মত । বাংলা বানানে কত রকম ভুল ব্যবহার । দোকানের কিংবা নানা রকম প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড হরেক  ভুলে ভরা । বাস গাড়ী, ট্রেন, লঞ্চ ও অন্যান্য অনেক যানবাহনের গায়ের লেখায় কত ভুল থাকে । এ সব দেখার কে আছে ?  যার যার মত করে বাংলা ভাষার ব্যবহার । কেউ কিছু বলে ও না , মনে ও করে না।  এখন একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে কেবল বাণিজ্যিক চিন্তা । বই মেলার নামে সারা মাস ধরে কেবল বইয়ের বেচা কেনা । লেখক, কবি, সাহিত্যিকরা  নিজেদের সাহিত্য কর্ম নিয়ে বই মেলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন ।

প্রকাশকরা ‘টু পাইস’ কামাইয়ের ধান্ধায় লেগে পড়েন । ফেব্রুয়ারিতে সবচে’  লাভ তাদের । কবি, সাহিত্যিক এবং লেখকদের ও কম হয় না । সকলি ব্যবসার ধান্ধা । একুশ নিয়ে এ ভাবে নানা জনে নানা ব্যবসায় মেতে ওঠে । সারা বছর বসে বসে একুশের অপেক্ষা । ফেব্রুয়ারি এলেই ব্যবসার তোড়জোড় শুরু । এ জন্যে তো ভাষা সংগ্রাম সংঘটিত হয়নি । ভাষা সংগ্রাম হয়েছে নিজের মায়ের ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করার জন্যে । মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভুমির মর্যাদা সবার ঊর্ধে তুলে ধরার জন্যে । নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে। স্বাধিকার ও স্বাধীনতার জন্যে । শোষণ ও বঞ্চনার চির অবসানের জন্যে । একুশ আমাদের চেতনার বাতিঘর । এ আমাদের জাগ্রত চেতনার বহ্নিশিখা । ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রামের শপথ মঞ্চ।

একুশের সিঁড়ি বেয়ে আমাদের সকল বিজয় এসেছে । ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের বিজয় । ৬৬’র  ছয় দফার বিজয় । ৬৯’র গণ আন্দোলনের বিজয়। সর্বোপরি আমাদের ৭১’র মুক্তি সংগ্রামের বিজয় । সে আমাদের উপলব্ধিতে স্মরণীয় করে গেঁথে রাখা অপরিহার্য ।

সালাম, বরকত, রফিক, সফিক, জব্বার । এরা সবাই ভাষা শহীদ। ভাষার জন্য অকাতরে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়ে বিশ্বে আজ অমর । আমরা কেবল একুশ এলে তাদের স্মরণে গান গাই। শহীদ মিনারে ফুল দেই। প্রভাত ফেরি করি । এ করে তাদের ঋণ কতটুকু শোধ হয় ?

তাদের প্রত্যেকের জীবন ও কর্ম কী আমাদের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় না ? তাদের নামে জায়গায় জায়গায় স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা যায় না ? প্রত্যেক জেলা সদরে তাদের প্রত্যেকের ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা করা যায় না ? ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদদের নিয়ে বেশী বেশী গবেষণার ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায় না? তারা তো কোন দলের নন। তারা সকল দলের। তারা সকল গোত্রের । তারা সকলের আপন । তারা আমাদের আত্মজ । তারা সবার নমস্য ।

ভাষা সংগ্রাম আমাদের সকল ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনের সূতিকাগার । এ সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের পথ দেখিয়ে দিয়েছে । প্রশস্ত করেছে মুক্তির পথ ।  আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের যাবতীয় অনুপ্রেরণা এসেছে ৫২’র এ আন্দোলন থেকে ।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির চেতনা চিরদিন আমাদের হৃদয়ে ধারণ করতে হবে । এর শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করতে হবে আমাদের ব্যক্তিক, সামষ্টিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে । মা, মাতৃভাষা ও মাতৃভুমির জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হউক আমাদের সবার জীবন । কেবল একুশ কিংবা ফেব্রুয়ারিতে নয় , জীবনের প্রতিটি মুহুর্তে বাংলা ভাষা মায়ের ন্যায় জড়িয়ে থাকুক আমাদের একান্ত অস্তিত্বের সাথে ।

[ মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।]

মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! - dainik shiksha শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ - dainik shiksha ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0073628425598145