এনসিটিবির লুকোচুরি খেলা শেষ হবে কবে? - দৈনিকশিক্ষা

এনসিটিবির লুকোচুরি খেলা শেষ হবে কবে?

মাছুম বিল্লাহ |

এবার (২০১৭) বছরের প্রথমে দিনে বই বিতরণের আনন্দ প্রকাশ করার সাথে সাথে বের হয়ে এলো বিভিন্ন বইয়ে বিভিন্ন ধরনের ভুল।বানানে ভুল, তথ্যে ভুল, ভাষায় ভুল, বিষয়ে ভুল, ধারণায় ভুল-ভুলে ভুলে একাকার শিক্ষার্থীদের বিনামূলে পাওয়া বই। বই পাওয়ার সব আনন্দ ভেস্তে গেল, সরকারের বিনামুল্যে পুস্তক দেওয়া প্রচেষ্টার প্রশংসার বদলে দুর্নাম কুড়াতে হলো। অনেকে প্রশ্ন করেছিলেন এ বিষয়ে কিছু লিখব কিনা। আমি উত্তর দিয়েছিলাম দুটি কারণে লিখব না। প্রথমটি হচেছ এত বড় একটি কাজ করতে গেলে ভুল অনেক হবেই।

দ্বিতীয় কারণটি ছিল, লিখেও কোন লাভ নেই, ভুল যারা করে তারা  এখানে একপক্ষ  নয়, কয়েকপক্ষ জড়িত থাকে, কাকে ধরা হবে, কিভাবে ধরা হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই, কাজেই কারুর কিছুই হবে না যদিও পুরো দায়িত্ব এনসিটিবির ওপরই বর্তায়। এ বিষয়ে কেউ কেউ মন্তব্য করেছিলেন যে, এনসিটিবি ইচেছ করেই কিছু ভুল করে কারণ জানে যে, এজন্য তাদের কিছু হবেনা। দ্বিতীয়ত, সরকারী বইয়ের ভুল নিয়ে কারুরই  খুব একটা মাথাব্যাথা থাকেনা  কারন বই নিয়ে ভাবে ক’জন? দু চারজন হয়তো একটু চিকপাক দিবে বা লিখবে তাতে কারুরই কিছু আসে যায়না। আর দুএকজনের চিকপাক তারা শুনতেও চায় কারন বই সংশোধন করার জন্য এ ধরনের ফিডব্যাক দরকার । বই সংশোধন করা মানে টাকার খেলা, নতুন বাজেট, নতুন বিনিয়োগ। কথাগুলো  মাঝে মাঝে সত্যিই মনে হয়।

বোর্ড পরীক্ষার প্রশ্ন কেমন হবে বিশেষ করে ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্ন কেমন হবে এ নিয়ে প্রতি বছরই একটি ঝামেলা সৃষ্টি হয়। কোন এক অজানা কিংবা রহস্যজনক কারনে এনসিটিবি বিষয়টি নিয়ে প্রায়ই এক ধরনের খেলা খেলে থাকে।দেখা যায় বছরের শুরুতে একবার, মাঝে একবার আবার পরীক্ষার আগে আগে আর একবার এই পরিবর্তনের কথা শোনা যায় এবং দেখাও যায়।   বার বার ইংরেজি প্রশ্নের ধরন পরিবর্তন করা হয়, ইচেছ করেই করা হয়। কারণটি খুবই রহস্যজনক। ইংরেজি প্রশ্ন কেমন হবে তা বইয়ের শেষের দিকে দেয়া আছে। আমাদের শিক্ষকগন সেভাবেই শিক্ষার্থীদের পড়ান ও পরীক্ষার প্রসুÍুতি নিতে বলেন। এটিই স্ট্যান্ডার্ড, এনসিটিবি থেকে যে মডেল প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে, সেটি দেখেই  শিক্ষাদান করা হয়ে থাকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে, সর্বত্র।তারমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যায় কোন বলা নেই, কহা নেই , প্রচার নেই, কারন নেই, ব্যাখ্যা নেই হঠাৎ  ভিন্ন আঙ্গিকের কিছু প্রশ্ন এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়। আবার ক’দিন পর রহস্যজনক কারনে সেগুলো উধাও। শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অনেকেই এনসিটিবির এই খেলার সাথে পরিচিত। মাসদুয়েক আগে এক লেখায় লিখেছিলাম যে, একজন অভিভাবক আমার কাছে এসেছিলেন তার ছেলের জন্য একটি বই ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করবেন বলে কারন তার ছেলের বই ছিঁড়ে গেছে। কিন্তু ওয়েবসাইটে কোন বই ছিলনা। আমার আর এক সহকর্মী যিনি এনসিটিবর ওয়েবসাইটে বই পাওয়াকে খুব প্রশংসা করেন, তাকে বললাম বই ডাইনলোড করতে। বহু চেষ্টা করে দেখলেন আসলেই ওয়েবসাইটে কোন বই নেই।

কোন বিষয়ের  সঠিক মূল্যায়ণ প্রতিবছর  একই ধরনের প্রশ্ন দিয়ে করা যায়না। সেটি নিয়ে অনেক বার অনেকভাবে লিখেছি কিন্তু কাজ হয়নি। অর্থাৎ আমাদের প্রশ্ন এনসিটিবির দেওয়া কাঠামো অনুযায়ীই হতে হবে। সেটি ঠিকমতো মানলেও কথা বলার থাকেনা, কিন্তু তা হয়না। পরিবর্তন, হঠাৎ পরিবর্তন। ইংরেজির মূল্যায়ণটা হবে শিক্ষার্থীদের ভাষাজ্ঞান, ভাষার চারটি দক্ষতায় ( লিসেনিং, স্পিকিং, রিডিং ও রাইটিং) তারা কতটা  দক্ষতা অর্জন করেছে সেটি দেখতে হবে। এখানে অন্য বিষয়ের মতো জ্ঞানস্তর, অনুধাবন স্তর, প্রয়োগ ও উচচতর দক্ষতার স্তর –এভাবে দেখলে আসল উদ্দেশ্য সফল হবেনা অর্থাৎ যে ভাষা শেখানোর জন্য আমরা শিক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াচিছ তা হচেছনা। কিন্তু ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে যেন অনেকটা তাই করা হয়েছে হঠাৎ দেয়া ওয়েবসাইটের প্রশ্নে।  পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করেন শিক্ষা বোর্ডগুলোর অধীনে শিক্ষকবৃন্দ। তারা কি বইয়ের শেষে যে মডেল দেয়া আছে তা দেখে প্রশ্ন করবেন না কি এনসিটিবির ওয়েবসাইট যা এক এক সময় এক ধরনের প্রশ্ন দিয়ে থাকে তা দেখে করবেন? অবশ্যই বইয়ের শেষে দেওয়া প্রশ্ন থেকে করবেন।এটিকেই স্ট্যান্ডার্ড ধরতে হবে। তাহলে এনসিটিবির হঠাৎ হঠাৎ পরিবর্তনের মানে কী? কে দেখতে যাবে এনসিটিবি কোন মাসে কোন পরিবর্তন নিয়ে এলো? কেনইবা এই পরিবর্তন বার বার হচেছ? তবে, পরিবর্তন যাই করা হোক না কেন তা  নভেম্বর বা ডিসেম্বরের মধ্যে করা উচিত কিন্তু দেখা যায় ফেব্রুয়ারী মাসে এই পরিবর্তন  করা হয়? উদ্দেশ্যটা কী? এই সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের কাছে বই চলে যায়। তারা সেভাবে সব কিছুর প্রস্তুতি নিতে থাকে।

পরিবর্তন তো এনসিটিব দু’একজন কর্মকর্তা ইচেছ করলেই পরিবর্তন করতে পারেন না। কোন পরিবর্তনের আগে ওয়ার্কশপ ডাকতে হয়, সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মতামত যাচাই করতে হয় , তারপর ন্যাশনাল কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিলে এটি অনুমোদিত হতে হয়। যেমন  মেম্বার মাধ্যমিক শিক্ষা কারিকুলামের সাক্ষরিত একটি নিয়মকানুন  ঢাকা বোর্ডের ওয়েবসাইটে  প্রকাশ করা হয়েছে, এটি যদিও এনসিটিবির ওয়েবসাইটে থাকার কথা, কিন্তু আমরা তা সেখানে পাইনি। তারপরেও এটি মেনে নেয়া যায়, আমরা কোন প্রশ্ন থাকলে সরাসরি বলতে পারি যে, মেম্বার কারিকুলামের সাক্ষর করা বিষয়। এটির একটি ভিত্তি আছে। কিন্তু ক’দিন আগে হঠাৎ দেখা গেল পরিবর্তিত আকারে ইংরেজির প্রশ্ন, তাতে কারুর কোন সাক্ষর নেই। কে করেছে, কেন করেছে, কোন ব্যাখ্যা নেই। এতে শিক্ষক সমাজ বিশেষ করে গ্রামীণ শিক্ষক সমাজ যারা মূলত শিক্ষার এক বিরাট অংশজুড়ে আছে, তারা মারাত্মক ধরনের কনফিউশনের মধ্যে পড়ে। শিক্ষার্থীদের তো কথাই নেই। আমরা  শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে বার বার খেলছি কেন?তাছাড়া অন্য কোন বিষয় নিয়ে তো এ ধরনের খেলা বেশি হয়না, ইংরেজি নিয়ে কেন হয়?

দু একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরছি। মেম্বার কারিকুলাম সাক্ষরিত নিয়মে ষ্ষ্ঠ শ্রেণিতে দুটি সিন প্যাসেজ থাকার কথা, আনসিন প্যাসেজের কথা বলা হয়নি, বুঝা যাচেছ একটি আনসিন প্যাসেজ থাকবে কিন্তু ওয়েবসাইটের নতুন মড়েলে দেওয়া হয়েছে দুটি আনসিন প্যাসেজ। এটি শিক্ষার্থীদের জন্য এবং বিশেষ করে গ্রামীন শিক্ষকদের জন্য এক ঝামেলাপূর্ন অবস্থার সৃষ্টি করবে।দশম শ্রেণির ইংরেজি প্রশ্নের কথায় যদি আসি তাহলে দেখা যায় মেম্বার কারিকুলাম প্রফেসর মশিউজ্জামানের সাক্ষরকরা (২০.৯.২০১৬)  নিয়মে  সিন প্যাসেজ থেকে থাকবে মাল্টিপল চয়েস প্রশ্নে ০৭ নম্বর, প্রশ্নোত্তরে থাকবে ১০ নম্বর ও গ্যাপ ফিলিংএ থাকবে ০৫ নম্বর।এটি ওয়ার্কশপে সিদ্ধান্ত হয় এবং সেটিই দেয়া হয়েছে ওয়েবসাইটে।বইয়ের শেষে যে মডেল প্রশ্ন দেওয়া আছে সেখানেও এই নিয়মটি অনুসরণ করা হয়েছে।

কিন্তু ফেব্রুয়ারী (২০১৭) মাসে হঠাৎ করে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে যে প্রশ্ন দেওয়া হয়েছে সেখানে প্রথম দুটো ঠিক আছে কিন্তু গ্যাপ ফিলিংএর জন্য আবার আর একটি প্যাসেজ বাইর থেকে এনে করা  হয়েছে , সিন প্যাসেজ থেকে দেওয়া হয়নি। এটি এনসিটিবিরই করে দেওয়া নিয়মের সাথে সাংঘর্ষিক নয় কি? তাহলে এটি করা হলো কেন? ব্যাখ্যাটি কী? ম্যাচিং আইটেমে বইয়ের নমুনা প্রশ্নে দুটি করে কলাম কিন্তু নতুনটিতে রয়েছে তিনটি করে কলাম ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের হুটহাট পরিবর্তন। ইনফরমেশন ট্রান্সফার নমুনা প্রশ্নে একরকম আবার ওয়েবসাইটে যে নমুনা দেওয়া হয়েছে সেখানে অন্য আর রকম । এর কারণ কী?
আবার পরীক্ষার আগে আগে দেখা যায় যে, কিছু পরিবর্তন হয় এ নিয়ে আন্দোলন, হতাশা, আলোচনা, সমালোচনা চলতেই থাকে। কোমলমতি শিক্ষার্থীদেরকেই এর  ’বলি’ হতে হয়  বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থীরা ভাল স্কুলে পড়তে পারেনা, ভাল শিক্ষকের কাছে যেতে পারেনা।তাদেরকে নির্ভর করতে হয় তাদের শিক্ষক তারা যতটুকুই জানেন তার ওপর। দেখা যায় এসব শিক্ষকদেরএতকিছু পরিবর্তনের সাথে  কোন সম্পর্কই থাকেনা। নতুবা, বাজারের নিম্নমানের গাইড বা নোটের ওপর তাদের নির্ভর করতে হয় । আমরা প্রতিবছর ইচেছ করেই এই ঝামেলা কেন বাধাচিছ?

শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ ব্যাপারে কঠোর হতে হবে কারন  এনসিটিবি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান যেখানে জনগনের পুরো অধিকার রয়েছে সবকিছু জানার অথচ গুটিকয়েক কর্মকর্তার কারণে সরকারের সকল ভাল কাজ ভেস্তে যায়, সমালোচনার মুখে পড়ে সরকার। এ থেকে আমাদের সবাইকে অবশ্যই বেড়িয়ে আসতে হবে। নতুন বই যখন বের হবে তাতেই থাকবে সবকিছু, কোন কোন আইটেমে পরীক্ষা হবে, নম্বর বন্টন এবং প্রশ্ন প্রণেতাদের জন্য নিয়মাবলী। যদি কোন পরিবর্তন করতেই হয় তা ওয়ার্কশপ, সেমিনার করে যথাযথ কর্তৃূপক্ষের অনুমোদন নিয়ে করতে হবে এবং সব মিডিয়ায় স্পষ্ট করে জানাতে হবে যাতে সব ধরনের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবক পরিবর্তনের বিষয়টি ঠিকভাবে এবং সঠিক সময়ে জানতে পারে। এনসিটিবির পক্ষ থেকে  কোন ধরনের লুকোচুরি খেলা আমরা আর দেখতে চাইনা।

 

মাছুম বিল্লাহ

শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক

(প্রাক্তন ক্যাডেট কলেজ শিক্ষক ও বর্তমানে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত  )

প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0044100284576416