এমপিওভুক্তিতে এলিয়াছতন্ত্র! - দৈনিকশিক্ষা

এমপিওভুক্তিতে এলিয়াছতন্ত্র!

নিজস্ব প্রতিবেদক |

এক হাজার তিনশ আঠারো জন শিক্ষক-কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে ২৫ জুলাই। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরাধীন শিক্ষক-কর্মচারীগণের এমপিওভুক্তির চূড়ান্ত কমিটির সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। পদাধিকার বলে এ সভায় সভাপতিত্ব করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ড. এস এম ওয়াহিদুজ্জামান। ৩০ সদস্যের মিটিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চারজন প্রতিনিধি থাকেন। দৈনিকশিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, গুরুতর অভিযোগের দায় এড়াতে ২০১১ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশ জারি করে। এতে বলা হয়, শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্তিতে ভুল-ত্রুটিসহ যাবতীয় দায়-দায়িত্ব মহাপরিচালকের। সেভাবেই চলে আসছে। মন্ত্রণালয় যখন দায় এড়ানোর ওই আদেশ জারি করে তখন ম্যানুয়ালি এমপিওভুক্ত করা হতো।  জেলা শিক্ষা অফিসার কর্তৃক অগ্রায়ন করা আবেদনের চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করতো মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর। কিন্তু বিকেন্দ্রীকরণের পর এমপিওভুক্তির আবেদন হয় অনলাইনে। মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারাই মূল দায়িত্বে।

২০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মহাপরিচালকসহ এমপিও কমিটির সবাই জানতেন কতজন কীভাবে নিয়োগ ও এমপিওভুক্ত হলেন। কিন্তু অবিশাস্য হলেও সত্য বর্তমানে এমপিওভুক্তির একমাত্র সফটওয়ারের পাসওয়ার্ড জানেন শুধু অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক! ত্রুটিপূর্ণ সফটওয়ারের নির্মাতা একটি জামাতী প্রতিষ্ঠান। প্রতি বিজোড় মাসে [প্রতি দুই মাসে একবার] অনুষ্ঠিত এমপিওভুক্তির সভায় চূড়ান্ত অনুমোদন হয় হাজার হাজার নতুন শিক্ষক কর্মচারীর এমপিওভুক্তি, টাইমস্কেল, বকেয়া, সিলেকশন গ্রেড, বিএড/কামিল স্কেল ও সহকারি অধ্যাপক পদের স্কেলসহ বিভিন্ন প্রস্তাব।

বিগত পাঁচটি সভার গতিপ্রকৃতি পর্যালোচনায় দেখা যায়,  মহাপরিচালকের ভূমিকা শুধুই একজন শোতা ও প্রধান বক্তার। মহাপরিচালক নিযুক্ত হওয়ার পর ওয়াহিদুজ্জামান এ পর্যন্ত এমপিওভুক্তির পাঁচটি সভায় উপস্থিত থেকেছেন। প্রতিটি সভায় এমপিও সফটওয়ারের জটিলতায় শিক্ষকদের ভোগান্তি, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এবং উপ-পরিচালকদের দুর্নীতির প্রসঙ্গ ও পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত এমপিও দুর্নীতির প্রতিবেদন নিয়ে ছিলেন সরব। সমস্যা নিরসনে তিনি সবসময়ই উচ্চকন্ঠ। ‍উপ-পরিচালক, উপজেলা ও জেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যখনই দুর্নীতি ও হয়রানির অভিযোগ ওঠে তখনই অভিযুক্তদের পক্ষ নেন এলিয়াছ। তাকে সহযোগিতা করেন উপ-পরিচালক মো: মোস্তফা কামাল।

সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এলিয়াছের একই জবাব, ‘সবকিছু অনলাইনে হয়, সুতরাং অনলাইনে তো ঘুষ নেয়র সুযোগ নেই।”  “দুর্নীতির অভিযোগ : সব ঝুট হ্যায়!”

জানা যায়,  ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত সর্বশেষ সভায়ও যথারীতি উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তিনজন উপ-সচিব ও সিনিয়র সহকারি সচিব, মাউশি অধিদপ্তরের তিনজন পরিচালক, পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের একজন উপ-পরিচালক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নয়জন আঞ্চলিক উপপরিচালকসহ ত্রিশজনের বেশি কর্মকর্তা। কিন্তু নতুন এমপিওভুক্ত ১৩১৮ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে কতজন কীভাবে এবং কতদিন আগে নিয়োগ পেলেন? সহকারি শিক্ষক, প্রভাষকসহ সব এন্ট্রি লেভেল নিয়োগ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ২২ অক্টোবর থেকে বন্ধ থাকলেও কিভাবে এত শিক্ষক নিয়োগ পেলেন? কতজন সহকারি শিক্ষক অথবা প্রভাষক, কতজন প্রধান শিক্ষক, সুপার অথবা অধ্যক্ষ কিংবা সহকারি প্রধান শিক্ষক অথবা উপাধ্যক্ষ, কতজন সহকারি গ্রন্থাগারিককে এমপিওভুক্ত করা হলো? ২৫ জুলাইয়ের সভায় আটশ আটানব্বই জনের এমপিও সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু কমিটির কেউ জানেন না কী ভুল ছিলো আর কিসের ভিত্তিতে সংশোধন করা হলো? টাইমস্কেল বন্ধ থাকলেও ওই সভায় বাহাত্তর জনের টাইমস্কেলের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে। তারা কারা? ২৭ জনকে এমপিওর বকেয়াবাবদ ২৭ কোটি টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু প্রতিটি সভায় এত এত টাকা বকেয়া অনুমোদন হয় কীভাবে? মে মাসের সভায় নুতন এমপিওভুক্ত করা হয়েছে দুই হাজার সাতশ পচাঁশি জনকে। তারা কারা? সবকিছু জানেন শুধু একজন। তিনি অধিদপ্তরের পরিচালক (মাধ্যমিক) এলিয়াছ হোসাইন।

জানা যায়, এমপিওভুক্তির সভায় উপস্থিত সবাইকে যে তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ করা হয় তাতে শুধু সারাংশ বলা হয়। মাধ্যমিক শাখার পরিচালক তার হাতে থাকা একমাত্র কাগজ দেখে মৌখিকভাবে দ্রুত উচ্চারণ করে যান এত শিক্ষক ও এত কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব রয়েছে উপ-পরিচালকদের কাছ থেকে এবং আজকের আলোচনা শেষে চূড়ান্ত অনুমোদন করা হলো! সভার কার্যবিবরণীও লেখা হয় তার নির্দেশেই। নাম না প্রকাশের শর্তে এমপিও কমিটির একাধিক সদস্য দৈনিকশিক্ষাডটকমকে এসব তথ্য নিশ্চত  করেছেন।
অধিদপ্তরের একজন পরিচালক বলেন, যথাযথ পাইলটিং না করেই, গোয়ার্তুমি করে এমপিও বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে। এতে ঘুষের হাটের সংখ্যা বেড়েছে। এমপিও দুর্নীতি ছাড়াও প্রশ্নপত্র ফাঁস, নোটগাইড কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে কয়েকজন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে।

তিনি বলেন, লাবু, মেনজিস, তালেব ও আনন্দ নামের চার উপজেলা কর্মকর্তাকে দেখা যায় অধিদপ্তরের এমপিও শাখায়। তাদের কর্মস্থল ঢাকার বাইরে হলেও বেশিরভাগ সময় দেখা যায় পরিচালক ও উপ-পরিচালকের (মাধ্যমিক) কক্ষের সামনে ঘোরাঘুরি করতে। ধানমন্ডির দামী ফ্ল্যাটে থাকেন। কোন উপজেলায় এমপিওভুক্তিতে ঘুষ বেশি, কোথায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেশি সবকিছুই এই চক্রের নখদর্পণে। উপজেলা শিক্ষাকর্মকর্তা  বদলির তদবিরের জন্য মূলত এরা অধিদপ্তরে ঘোরাঘুরি করে।

দৈনিক সমকালে প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের বলা হয় যায়, ঢাকা অঞ্চলের উপ-পরিচালক গৌর মন্ডল ও ময়নসিংহ অঞ্চলের আবদুল খালেকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়না শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন নারী  অতিরিক্ত সচিবের কারণে।

এক প্রশ্নের জবাবে অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো: মোস্তফা কামাল বলেন, সরকারের একটা ভালো উদ্যোগ এমপিওবিকেন্দ্রীকরণ। যেকোনো মূল্যে এটা রক্ষা করতে হবে।

উদ্বিগ্ন অপর একজন উপ-পরিচালক বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের হাতে নিয়োগ এবং এমপিও দুটোই থাকায় এমপিওপ্রত্যাশীদের ভোগান্তিও বেড়েছে, দুর্নীতির স্তরও বেড়েছে। সফটওয়ার আর অনলাইনের নামে যা করা হচ্ছে তাতে এমপিওসভায় উপস্থিত অধিকাংশই সদস্যই উদ্বিগ্ন।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে মামলা মোকদ্দমা হলে, দুর্নীতি দমন কমিশন ডাকলে ডাকবে আমাদের সবাইকে। কারণ, আমরা সবাই সভায় উপস্থিত থাকি এবং কার্য বিবরণীতে স্বাক্ষর করি। প্রতিমাসের এমপিওশীটে আমাদের স্বাক্ষরের পর বেতন-ভাতা ব্যাংকে পাঠানো হয়।

বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদের সভাপতি অধ্যক্ষ মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান দৈনিকশিক্ষাডটকমকে বলেন, সরকার এমপিওভুক্তির কাজ বিকেন্দ্রীকরণ করেছে এমপিওপ্রত্যাশীদের সুবিধার জন্য, দুর্নীতি রোধ ও  হয়রানি বন্ধ করার জন্য কিন্তু ঘুষ-দুনীর্তি যদি আগের তুলনায় বৃদ্ধি পায় তবে নতুন করে ভাবা উচিত।

তিনি বলেন, এমপিওভুক্তির পুরো কাজটাই করেন সরকারি কলেজের শিক্ষকরা ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকরা যাদের এমপিও সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকে না। তাই এই সব গুরুত্বপূর্ণ পদে অভিজ্ঞ বেসরকারি এমপিওভুক্ত প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষদের পদায়ন করা হলে তারা দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন।

সম্প্রতি শিক্ষামন্ত্রী নুরুল  ইসলাম নাহিদও বলেছেন, হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকরা কেন উপ-পরিচালক পদে। কেন তাদের হাতে এমপিওর গুরুত্বপূর্ণ কাজ?

জানা যায়, মাউশি অধিদপ্তরের মাধ্যমিক শাখার পরিচালক পদে বসার আগ পর্যন্ত এমপিও শব্দটির সঙ্গে পরিচিতই ছিলেন না তিনি। মাগুরার একটি কলেজ থেকে হঠাৎ আনা হয়েছে বার্ষিক প্রায় এগারো হাজার কোটি টাকার এমপিওর দায়িত্বে! বি সি এস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হয়েও তিনি থাকেন ধানমন্ডি সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের বাসভবনে!

এমপিও দুর্নীতির প্রতিবেদন গায়েব: গত চার মাসে দৈনিকশিক্ষাডটকম, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক কালেরকন্ঠ ও জনকন্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এমপিওভুক্তিতে দুর্নীতি বিষয়ক কয়েকটি প্রতিবেদনের ওপর শিক্ষা অধিদপ্তরের মতামত জানতে চেয়েছেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো: সোহরাব হোসাইন। কিন্তু সচিব স্বাক্ষরিত ওই প্রতিবেদন ও চিঠির কপি গায়েব হয়ে যায় জাদু-মন্ত্রে! অনেক খোঁজাখুজি ও মন্ত্রণালয়ের তাগাদার পর তিন সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে গত সপ্তাহে।

জনকন্ঠে প্রকাশিত এমপিও দুর্নীতির প্রতিবেদনের ওপর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত চেয়ে তিন মাস আগে চিঠি দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সেই চিঠির দেয়া হয়েছে অধিদপ্তরকে। সাত দিনের মাধ্যে মতামত জানাতে বলা হলেও অদ্যাবধি তা জানায়নি বলে জানা যায়।

দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0039858818054199